ইয়ারমুকের যুদ্ধ : পানি পান করানোর অমর শিক্ষা

শাহাদাত হোসাইন

প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইয়ারমুকের যুদ্ধে মারমার কাটকাট অবস্থার এক-পর্যায়ে ইকরামা ইবনে আবি জাহল চিৎকার দিয়ে বললেন, কে আছ, যে মৃত্যুর শপথ নেবে? তার আহ্বানে চাচা হারিস এবং দিরার ইবনে আযওয়ারসহ প্রায় চারশ’ অশ্বারোহী শহিদ হওয়ার শপথ নিলেন। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে প্রায় সকলেই আহত হন। অনেকেই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। যাদের অন্যতম ছিলেন দিরার ইবনে আযওয়ার। ঐতিহাসিক ওয়াকেদি বলেন, তারা আহত হয়ে লুটিয়ে পড়লে, পিপাসা কাতর অবস্থায় পানি চাইতে থাকেন। পানি সংকট ছিল বিধায় তাদের কাছে যৎ-সামান্য পানি আনা হয়। প্রথমজনের কাছে পান করার জন্য পানি পেশ করা হলে, অন্য একজন সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন। তা দেখে প্রথমজন বললেন, আগে তাকে দিন। তার নিকট পানি পেশ করা হলে, অন্য একজন সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাই তিনি পান না করে তৃতীয়জনের কাছে পাঠিয়ে দেন। এভাবে তারা একে অন্যের কাছে পানি পাঠাতে থাকেন। এমনিভাবে পুনরায় প্রথম ব্যক্তির কাছে এসে দেখেন তিনি শাহাদাত বরণ করেছেন। দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে এসে দেখেন তিনিও শাহাদাত বরণ করেছেন। এমনি করে সকলেই পানি পান করা ছাড়াই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নেহায়া : ৭ : ৩০)। প্রত্যেকের পানির প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অন্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এটাই ইসলামের সৌর্ন্দয, প্রকৃত মানবপ্রেম। এমন মানবপ্রেম দুনিয়ায় আর কোথায় পাওয়া যাবে না। ইসলাম মানুষকে দয়ালু হতে শেখায়। শেখায় নিজের প্রয়োজনের ওপর অন্যের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিতে। তাতে যে, সুখানুভূতি আছে, তা অন্য কোথাও নেই। সে জন্যই হয়তো বলা হয়, ভোগেই সুখ নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। নবী (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেটাই পছন্দ করে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে (বোখারি : ১৩)।

তালহা আনসারির মেহমান নাওয়াজি : আবু হুরায়রাহ (রা.) বলেন, এক-ব্যক্তি নবীজিকে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি ক্ষুদার্থ। নবীজি স্ত্রীদের ঘরে কোনো কিছু না পেয়ে সাহাবিদের মাঝে ঘোষণা করলেন, যে এই ব্যক্তিকে মেহমান হিসাবে গ্রহণ করবে, আল্লাহ তার প্রতি সদয় হবেন। আবু তালহা বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি গ্রহণ করব। মেহমানসহ বাসায় গিয়ে জানতে পারলেন, বাচ্চাদের খাবার ছাড়া কোনো খাবার নেই। সেটাও এতই অল্প যা কেবলমাত্র একজন ব্যক্তির চাহিদা মেটাতে পারে। আবু তালহা স্ত্রীকে বললেন, বাচ্চাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। মেহমানের সামনে খাবার পরিবেশনের পর, সুযোগ বুঝে বাতি নিভিয়ে দেবে। অন্ধকারে আমরা খাবারের ভান করে শুধু মুখ নাড়াচাড়া করব, এ সুযোগে মেহমান পেট ভরে খেয়ে নেবেন। যেমন কথা তেমন কাজ। স্বামী-স্ত্রী মেহমানকে পেট ভরে আহার করালেন আর নিজেরা সন্তানসহ অনাহারে রইলেন। সকালে আবু তালহা নবীজির দরবারে গেলে, তিনি বললেন, মেহমানের সঙ্গে তোমাদের রাতের আচরণ আল্লাহ খুব পছন্দ করেছেন (মুসলিম : ২ : ১৯৮)। তাদের প্রশংসায় আল্লাহ সুরা হাশরে বলেছেন, নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদের (মুহাজিরদের) অগ্রাধিকার দেন। মূলত, যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত তারাই সফলকাম (৯)।

আবু বকর ও ওমরের মানবপ্রেম : ওমর (রা.) যিনি উম্মতের দ্বিতীয় সর্বোত্তম ব্যক্তি। তিনি বলেন, আমি প্রতিদিন সকালে এক-অন্ধ বৃদ্ধার ঘরের কাজ করে দিতাম। প্রতিদিনের ন্যায় একদিন সকালে বৃদ্ধার বাড়িতে গেলে তিনি জানালেন, আজ কোনো কাজ নেই। একজন-নেককার ব্যক্তি তোমার আগেই কাজগুলো শেষ করে গেছেন। পরের দিনেও এমনটি ঘটলে, সেই ব্যক্তি তালাশে তৃতীয় দিন তিনি একটু আগে গেলেন। দেখতে পেলেন খলিফা আবু বকর নিজে অন্ধ বৃদ্ধার ঘরের কাজ করে দিচ্ছেন। (কানযুল উম্মাল : ৩৭৪৩৭)। উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তিদ্বয়ের হৃদয় মানবপ্রেমে ভরপুর ছিল। ছিল অফুরন্ত মায়া-মমতা। যশ-খ্যাতি, পদণ্ডপদবির অহমিকা মানব সেবা থেকে তাদের বিচ্যুত করতে পারেনি। নবীজি বলেছেন, দয়াময় আল্লাহ দয়াকারীদের ওপর দয়া করেন। পৃথিবীবাসীর ওপর দয়া করো, তাহলে আসমানওয়ালা তোমার ওপর দয়া করবেন (তিরমিযি : ১৯২৪)।

লেখক : খতিব, বাইতুল আজিম জামে মসজিদ রংপুর