ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যৌতুকের নিষ্ঠুরতা ও ইতিবৃত্ত

মুফতি হুমায়ুন কবির মুহিউদ্দিন
যৌতুকের নিষ্ঠুরতা ও ইতিবৃত্ত

যৌতুক প্রথার নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা আজকাল সর্বজনবিদিত। আমাদের সমাজে নারী নির্যাতনে যৌতুক এক মরণব্যাধি রোগ। যৌতুক প্রথা নারীর মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করে। মানুষ হিসাবে মর্যাদা দেবার প্রশ্নে যৌতুক বড় রকমের বাধা। বিবাহের মতো অবশ্য কর্তব্য ও পবিত্র দায়িত্ব পালনে পুরুষের কোনো দায় রাখছে না। অথচ নারীকে এর বিনিময়ে অর্থ প্রদান করতে হবে, এর চেয়ে জঘন্য প্রতারণা আর কী হতে পারে যৌতুক প্রথার অভিশাপে নারী পাচ্ছে না তাদের সঠিক স্বাধীনতা। হনন হচ্ছে তাদের অধিকার। যৌতুককে কেন্দ্র করেই স্বামীর পাশবিক অত্যাচারে মুমূর্ষু অবস্থায় মৃত্যুর দিন গুনছে কত অসহায় নারী। যৌতুকলোভী কত স্বামীর দাবি মেটাতে কত পরিবার ধ্বংস হচ্ছে! বিরান হচ্ছে কতভিটে! কত বিবাহিতা নারী পাচ্ছে না স্বামীর সোহাগ। শুধু তাই নয়, এই যৌতুকের কারণেই কত তাজা প্রাণ অকালে ঝড়ে পড়ছে তা হিসাব করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। এ এমন ঘৃণ্য কুণ্ডপ্রথা যার ভয়াল থাবায় হাজার হাজার নিরীহ মায়ের স্বপ্ননীড় ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, মেহেদীর রং যাওয়ার আগেই ভেঙে যাচ্ছে কত নববধূর ঘরসংসার। কত তরুণী, যুবতী সোহাগের পরিবর্তে পাচ্ছে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, নিগ্রহ, নিপীড়ন। আর কত সহস্র মহিলার বিয়ের সময় পার হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু যৌতুক সংগ্রহে অপারগ বিধায় তাদের বিয়ে হচ্ছে না। এভাবেই যৌতুকের ভয়াল থাবায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আজকের সমাজ।

মুসলিম সমাজে যৌতুক অনুপ্রবেশের ইতিবৃত্ত : ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যৌতুক নামে মুসলিম সমাজে কোনো বস্তুই ছিল না। যৌতুক প্রথা যখন অস্থির করে তুলেছিল হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজকে। যখন যৌতুক ছাড়া বিবাহ ছিল অকল্পনীয়, তখনো মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ যৌতুকের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত ছিল। এছাড়া ইসলাম পূর্ব অন্ধকার যুগে পৃথিবীর বিজাতিসমূহে প্রচলিত রীতি-নীতি অনুযায়ী নারীর মর্যাদা অন্যান্য ব্যবহার্য তৈজসপত্রের মতোই ছিল। নারীর কোনো প্রকার মর্যাদা ছিল না, তাই ওরা বিবাহের সময় বরকে খুশি করতে হতো অঢেল উপঢৌকন দিয়ে। মূলত ভারতীয় হিন্দু সমাজে এই প্রথা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। এখনো প্রচলিত আছে। হিন্দুসমাজে এর কারণ হিসেবে বলা হয়, হিন্দু মেয়েরা পিতার সম্পদের কোনো অংশ পেত না, ফলে হিন্দুরা মেয়ের বিয়ের সময় প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র প্রদান করত। দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম সমাজ ও হিন্দু সমাজ একত্রে বসবাসের কারণে এই কুণ্ডপ্রথা মুসলিম সমাজে সংক্রমিত হয়। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে মুসলিম সমাজে এ বিষাক্ত কুণ্ডপ্রথাটি ছিল না বললেই চলে।

হিন্দু পরিবারে নারীর কোনো অধিকার ছিল না, নারী ছিল খেলনাস্বরূপ। পৈতৃক সহায় সম্পত্তিতে কন্যার কোনো অংশ নিরুপিত হত না। স্বামীর মৃত্যুর পর সম্পদের মালিক হতেন মৃতের স্ত্রী অর্থাৎ পুত্র ও কন্যার মাতা। এমতাবস্থায়, কন্যাদায় এড়ানোর জন্য বিবাহের সময় বিত্তবানরা উপযুক্ত উপঢৌকন দ্বারা কন্যা দায় নিরসন করতেন। কেন না, তারা জানতেন যে, পিতার মৃত্যুর পর কন্যা পৈতৃক সম্পত্তির অংশীদার হবে না। সে কালের সেই কুণ্ডপ্রথা বর্তমানে মুসলিম সমাজে আত্মপ্রকাশ করেছে। আজকাল আমাদের সমাজে দেখা যায় সর্বাধিক বিত্তবান কন্যাকে যেমন পাহাড় পরিমাণ যৌতুক দিয়ে সম্প্রদান করা হচ্ছে। ঠিক তেমনি দুস্থ ও ভিখারীর কন্যাকেও কিছু না কিছু যৌতুক দিয়ে বরের হাতে তুলে দিতে হচ্ছে। আর অভিশপ্ত যৌতুক দিতে না পারলেই নারীকে হতে হচ্ছে অবহেলিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত। আবার কখনো অসহ্য জ্বালাতন সহ্য করতে না পেরে নিজেই আত্মহননের মাধ্যমে যৌতুকের গ্লানি থেকে নিজের চির মুক্তির পথ বেছে নিচ্ছে নারী। দীর্ঘদিন হিন্দু-মুসলিম একসাথে থাকায় সামাজিক পরিবেশের প্রভাবের কারণে যৌতুকের এ অভিশপ্ত প্রথা মুসলিম সমাজেও ক্রমশ বিস্তার লাভ করে। এভাবেই মুসলিম সমাজে যৌতুকের অনুপ্রবেশ ঘটে। আল্লাহতায়ালা আমাদের এই সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি দান করুন, আমিন।

লেখক : আলেম ও মাদ্রাসা শিক্ষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত