বিশ্বরাজনীতিতে মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন শান্তির দূত

আমীনুল ইসলাম আরাফাত

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবীতে আগমন ও উদ্দেশ্য : রবিউল আউয়াল মাসে সমগ্র বিশ্ব মানবের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের মুক্তির পয়গাম নিয়ে মহাবিশ্বের বুকে আগমন করেন- মহান আল্লাহতায়ালার প্রিয়নবী, বিশ্বনবী ও শান্তির অগ্রদূত হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল¬াম। তিনি দুনিয়ার বুকে আগমন করেন সত্যের বার্তবাহক হিসেবে। মিথ্যার বেসাতি থেকে মানুষকে দূরে রাখার জন্য। অন্যায়, অপরাধ ও মন্দ কাজের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার জন্য। ন্যায়, কল্যাণকামিতা ও সৎকাজের শুভ পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করে কল্যাণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য। তার আগমনের প্রধান লক্ষ্য ছিল সমগ্র মানবজাতিকে ইহজগতে চিরশান্তি, পরকালে চিরমুক্তি ও চিরকল্যাণের পথ প্রদর্শন করা। এ প্রসঙ্গে তিনি ইরশাদ করেন : ‘আমি প্রেরিত হয়েছি মানবজাতির চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যে।’ মহান আল্লাহতায়ালা বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-কে সাধারণ কোনো লক্ষ্য দিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করেননি। বরং বিশ্বমানবতার পরিপূর্ণ কল্যাণের মহৎ লক্ষ্যেই মহানবী (সা.)-কে এই জগতে প্রেরণ করা হয়েছে। আমরা পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.)-এর ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাই- পূর্ববর্তী নবী রাসূলদের নির্দিষ্ট একটি এলাকা কিংবা নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের হেদায়েতের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের দাওয়াতি কার্যক্রম কেবল উক্ত এলাকা ও উক্ত সম্প্রদায়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। যেমন মহান আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন- ‘হে নবী প্রকৃত ব্যাপার হলো আপনি তো কেবল সতর্ককারী। আর প্রত্যেক জাতির হেদায়েতের জন্যই ছিল পথপ্রদর্শক।’ (আর-রাদণ্ড৭)। আলোচ্য আয়াতের শেষাংশে স্পষ্টভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে: পূর্ববর্তী প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যই ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র নবী রাসুল প্রেরিত হয়েছিলেন।

অপরদিকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নির্দিষ্ট অঞ্চল কিংবা নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হননি। তিনি প্রেরিত হয়েছেন সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য। মহানবী (সা.)-এর দাওয়াতি কার্যক্রম নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চল কিংবা সম্প্রদায়ভিত্তিক ছিল না। বরং তার দাওয়াতি কার্যক্রম ছিল সমগ্র বিশ্বব্যাপী। আল্লাহতায়ালা মহানবী (সা.)-কে পুরো বিশ্ববাসীর জন্য করুণার আধার রূপে প্রেরণ করেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন- ‘হে নবী (সা.)! আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আল আম্বিয়া: ১০৭)। আল্লাহতায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করেন- ‘আর আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সমগ্র মানবতার জন্য সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী হিসেবে; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ (সুরা আস সাবা: ২৮)। আলোচ্য আয়াতদ্বয় থেকে এবিষয়টি সুস্পষ্ট প্রতীয়মাণ হয় যে, মহানবী (সা.)-এর নবুওয়ত, রিসালাত, দাওয়াত ও সার্বিক কার্যক্রম কেবল আরব ভিত্তিক ছিল না। বরং তা সমগ্র বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত ছিল। মহানবী (সা.)এর আনিত বিধান ও প্রবর্তিত সংবিধান কেয়ামত পর্যন্তই সমানভাবে কার্যকরী থাকবে। যেমন আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘মহিমাময় সত্তা, যিনি তার বান্দার প্রতি ফয়সালাকারী কিতাব প্রেরণ করেছেন। যাতে করে তা বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হয়।’ (সুরা:আল ফুরকান:১)। এ আয়াত থেকে প্রতীয়মাণ হয় যে, মহানবী (সা.) ও তার উপর অবতীর্ণ কোরআনুল কারীম নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চল কিংবা নির্দিষ্ট কোনো সময় ভিত্তিক ছিল না। বরং তা কেয়ামত পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ববাসীর উপরই সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। কোনো কোনো জ্ঞানপাপী এমর্মে দাবি উত্থাপন করে- কোরআনুল কারীম শুধুমাত্র নির্দিষ্ট আরব জাতির জন্যই অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং মুহাম্মদ (সা.) কেবল নির্দিষ্ট আরব অঞ্চলেরই নবী। তিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত নয়। তারা বলে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন: এ কোরআন প্রবল পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু আল্লাহর কাছ থেকে নাজিলকৃত। যাতে আপনি সতর্ক করতে পারেন এমন এক জাতিকে যাদের পিতৃ পুরুষদের সতর্ক করা হয়নি, সুতরাং তারা গাফিল। (সুরা ইয়াসীন:৫, ৬)। এ আয়াত দুটোতে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা নবীজীর আগমনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে বলেন, তাকে পাঠানো হয়েছে এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট যাদের কাছে পূর্বে কোনো সতর্ককারী বা নবী আসেনি এবং নবীজীর ওপর কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে যাতে নবী উক্ত সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারেন। আর বাহ্যত উক্ত সম্প্রদায় দ্বারা আরব জাতিই উদ্দেশ্য। কিন্তু তাদের এই দাবি সম্পূর্ণ অসার ও অবান্তর। যা মূলত কোরআনুল কারীমের বাচনভঙ্গি সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতার পরিচায়ক। শাব্দিক উপস্থাপনের দিক বিবেচনায় কোরআনুল কারীমের কিছু আয়াত আরব কিংবা নির্দিষ্ট সম্প্রদায় কেন্দ্রিক বটে; তবে অর্থ ও প্রয়োগ ক্ষেত্রের বিবেচনায় তা সার্বজনীনই হয়ে থাকে। তাদের আলোচ্য আয়াতটি এই শ্রেণির আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। নচেৎ আল্লাহতায়ালা মহানবী (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেন- ‘আর আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সমগ্র মানবতার জন্য সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী হিসেবে; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ (সুরা আস সাবা: ২৮)। অনুরূপ নবী কারীম (সা.) ইরশঅদ করেন: সমস্ত নবী প্রেরিত হতেন কেবল তাদের সম্প্রদায়ের জন্য, আর আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে সমগ্র মানব জাতির জন্য। (বোখারি:৩৩৫)। অন্য আরেকটি হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, নবী কারীম (সা.) নিজের আগমনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করত বলেন, নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা আমাকে সমগ্র দুনিয়াবাসীর জন্য রহমত এবং পথ-প্রদর্শক হিসেবে প্রেরণ করেছেন। মহান আল্লাহ আমাকে সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র, দেব-দেবীর মূর্তি ও শূলি ক্রুশ এবং জাহিলী যুগের সকল কুপ্রথা মূলোৎপাটন করার নির্দেশ দিয়েছেন। (আহমাদ ২২৩০৭)। আলোচ্য আয়াত ও হাদিস দ্বারা নবী কারীম (সা.)-এর আগমন কেয়ামত পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বের জন্য সার্বজনীন হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে।

বিশ্বব্যাপী দাওয়াতি কার্যক্রমের সূচনা: নবুওয়ত প্রাপ্তির পর নবী কারীম (সা.) সুদীর্ঘ তেরো বছর মক্কায় অবস্থান করেন। এই সময়কালে মক্কার লোকদের দাওয়াত দেয়ার পাশাপশি দূরদূরান্ত থেকে আগত হজ্জের কাফেলার মাঝেও দ্বীন প্রচার করেন। মদিনায় হিজরতের পর হুদাইবিয়ার সন্ধি পর্যন্ত কাফেরদের সাথে ময়দানি লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। অতঃপর ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি শেষে যখন মদিনায় ফিরে আসেন; নবী কারীম (সা.) দ্বীনে ইসলামের দাওয়াত সমগ্র বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য মনস্থির করলেন। কেননা দ্বীনে ইসলাম শুধুমাত্র আরব কেন্দ্রিক কোন ধর্ম ছিল না। দ্বীনে ইসলাম সর্বজনীন বৈশ্বিক ধর্ম এবং নবী কারীম (সা.) পুরো বিশ্বজগতের নবী। নবুওয়তের প্রথম দিন থেকেই নবী কারীম (সা.) তার সার্বজনীনতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি তখনই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, এই আহ্বান একদিন পৃথিবীর সব প্রান্তে পৌঁছে যাবে। হিজরতের বহু বছর পূর্বেই মক্কার অধিবাসীদের লক্ষ্য করে নবী কারীম সা. ইরশাদ করেছিলেন- ‘তোমরা বলো আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তবেই তোমরা সফলকাম হবে। তোমরা স্বীকার করে নাও আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তবেই তোমরা এই আরব অনারব সমগ্র বিশ্বের রাজত্বের অধিকারী হবে।’ বৈশ্বিক দাওয়াতের পরিকল্পনা নবুওয়তের প্রথম দিকেই নবীজীর পরিকল্পনায় ছিল। কিন্তু হুদায়বিয়ার সন্ধির পূর্বে তিনি তা ব্যাপকভাবে বাস্তবায়ন করেননি। অতঃপর হুদায়বিয়র সন্ধির পর নবী কারীম সা. সমগ্র বিশ্বব্যাপী দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি পারস্যের সম্রাট, রোমান সম্রাট, ইথিওপীয় রাজা বাদশাহ আরমাহ, বাহারাইনের গভর্নর মুনজির ইবনে সাওয়া আল তামিমি, মিশরের শাসক মুকাওকিস ও ওমানের শাসকের নিকট একত্ববাদ ও নবুয়তের দাওয়াত সম্বলিত চিঠি প্রেরণ করেন। পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী এই দাওয়াতের কাজ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবয়ে তাবেয়িনসহ সর্বযুগের উম্মতে মুহাম্মাদি আঞ্জাম দিয়েছেন। সর্বোপরি মুহাম্মদ (সা.) বিশ্ববাসীর জন্য সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ মানবাধিকার প্রবর্তন করেন। তিনি ছিলেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী। তিনি ছিলেন বিশ্বনেতা। আর তিনিই হবেন কেয়ামত পর্যন্ত আগত সমগ্র বিশ্ববাসীর প্রকৃত আদর্শ ও পথিকৃৎ।

লেখক : মুহাদ্দিস