সাহাবিদের ভ্রাতৃত্ব ও মানবপ্রেম
শাহাদাত হোসাইন
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সৃষ্টিজীব আল্লাহর পরিবারভুক্ত আর মানুষ আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি। নবীজির গোটা জীবন মানব প্রেমের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিল। তিনি ছিলেন, অসহায়ের সহায়। দুর্বলের বল। সেবাবঞ্চিত লোকের উত্তম সেবক। দরিদ্র, ক্ষুধার্ত আর তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির আশ্রয়স্থল। সাহাবিরা নবীজির একান্ত সহোচর ছিলেন। নবীজির হৃদয় যেমন মানবপ্রেমে টইটম্বুর ছিল, তাদের মননও মানবপ্রমের হিতৈষী ছিল। যেখানেই সাহায্যের বিষয় এসেছে, সেখানেই নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে মানুষের সেবায় ব্রতি হয়েছেন। সাহাবিদের মানবপ্রেমের দাস্তান অন্তহীন এক-উপাখ্যান। মানব প্রেমে ওসমান (রা.) এর অসামান্য অবদান। ‘ওসমান’ ইসলামি ইতিহাসে নক্ষত্র তুল্য একটি নাম। ইসলামের তৃতীয় খলিফা। নবীজির দুই মেয়ে জামাতা ছিলেন ধনাঢ্য, সম্পদশালী। আল্লাহ তাকে যে পরিমাণ সম্পদ দিয়েছিলেন, তার থেকেও বড় একটি হৃদয় দিয়েছিলেন। যার কারণে তৎকালীন মুসলমানদের বড় বড় প্রয়োজনগুলো তার সম্পদ দ্বারা পূরণ হয়েছিল। মদিনায় মিঠা পানির সংকট ছিল। মুহাজিররা মদিনায় এলে পানি সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করে। রুমা কূপ ছিল মিঠা পানির একমাত্র উৎস। নবীজি কূপের মালিককে ডেকে বললেন, তুমি কী জান্নাতের বিনিময়ে কূপটি বিক্রয় করবে? লোকটি বললেন, ইয়ারাসুলাল্লাহ! এটি ব্যতীত আমার কোনো আয়ের উৎস নেই। ওসমান (রা.) নবীজির কথা শুনে পঁয়ত্রিশ হাজার দিরহামে কূপটি কিনে নেয় এবং নবীজিকে জিজ্ঞাসা করেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার জন্যও কি সেই বিনিময় থাকবে, যা লোকটির জন্য ছিল? নবীজি বললেন, হ্যাঁ। এবার ওসমান (রা.) বললেন, আমি কূপটি মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত করে দিলাম (বোখারি : ২৭৭৮)। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, কূপটি একজন ইহুদির ছিল। ওসমান (রা.) বিশ হাজার দিরহামে ক্রয় করে তা মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন (ফাতহুল বারি:৫:৪০৮)। ওসমান (রা.) বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। চাইলে এখান থেকে বে-হিসাব মুনাফা অর্জন করতে পারতেন কিন্তু তিনি দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী লাভের দিকে না তাকিয়ে আখেরাতের চিরস্থায়ী লাভের আশা করেছেন। পেয়েছেনও। নবীজি দুনিয়াতেই তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। আমাদেরও উচিত মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছু ব্যবসা একমাত্র আল্লাহর জন্য করা।
সা’দ ইবনে রাবি আনসারীর উদারতা : ইসলামের ইতিহাসে আনসারদের মানবপ্রেম চির-অমলীন। মক্কা থেকে আগত সহায় সম্বলহীন মুহাজিরদের জন্য তারা যা করেছেন, মানব ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল। ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে তারা নিজেদের সম্পদে মুহাজিরদের সমান অংশ দিয়েছেন। আব্দুর রহমান ইবন আউফ (রা.) মদিনায় আসলে, নবীজি সাদ ইবনে রাবির সাথে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দেন। সাদ ইবনে রাবি আব্দুর রহমানকে বললেন, আনসাররা জানে, আমি একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি। আমি আমার সম্পত্তি দু’ভাগ করে আপনাকে এক ভাগ দিতে চাই। আর আমার দুজন স্ত্রী আছেন। আমি চাই আপনি তাদের দেখে, একজনকে পছন্দ করেন। অতপর আমি তাকে তালাক দিলে, আপনি তাকে বিবাহ করে নিবেন। জবাবে আব্দুর রহমান বলেছিলেন, ভাই! আল্লাহ আপনার সম্পদ এবং পরিবারে বরকত দান করুণ! আমাকে বাজারের রাস্তা দেখিয়ে দিন (আহমাদ:৩:১৯০)। একজন ব্যক্তি কতটা উদার হলে, নিজের সম্পত্তি, এমনকি স্ত্রীকেও অন্যের সাহায্যে ত্যাগ করা যায়?
তালহা আনসারির মেহমানদারি : আবু হুরায়রাহ (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবীজিকে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি ক্ষুধার্ত। নবীজি তার স্ত্রীদের ঘরে কোনো কিছু না পেয়ে সাহাবিদের মাঝে ঘোষণা করলেন যে, এই ব্যক্তিকে মেহমান হিসাবে গ্রহণ করবে, আল্লাহ তার প্রতি সদয় হবেন। আবু তালহা বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি গ্রহণ করব। মেহমানসহ বাসায় গিয়ে জানতে পারলেন, বাচ্চাদের খাবার ছাড়া কোনো খাবার নেই। সেটাও এতই অল্প যা কেবলমাত্র একজন ব্যক্তির চাহিদা মেটাতে পারে। আবু তালহা স্ত্রীকে বললেন, বাচ্চাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। মেহমানের সামনে খাবার পরিবেশনের পর, সুযোগ বুঝে বাতি নিভিয়ে দেবে। অন্ধকারে আমরা খাবারের ভান করে শুধু মুখ নাড়াচাড়া করব, এ সুযোগে মেহমান পেট ভরে খেয়ে নিবেন। যেমন কথা তেমন কাজ। স্বামী স্ত্রী মেহমানকে পেট ভরে আহার করালেন আর নিজেরা সন্তানসহ অনাহারে রইলেন। সকালে আবু তালহা নবীজির দরবারে গেলে, তিনি বললেন, মেহমানের সাথে তোমাদের রাতের আচরণ আল্লাহ খুব পছন্দ করেছেন (মুসলিম:২:১৯৮)। তাদের প্রশংসায় আল্লাহ সুরা হাশরে বলেছেন, নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদের (মুহাজিরদের) অগ্রাধিকার দেন। মূলত, যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত তারাই সফলকাম (৯)।
আবু বকর ও ওমরের মানবসেবা : ওমর (রা.) যিনি উম্মতের দ্বিতীয় সর্বোত্তম ব্যক্তি। তিনি বলেন, আমি প্রতিদিন সকালে এক-অন্ধ বৃদ্ধার ঘরের কাজ করে দিতাম। প্রতিদিনের ন্যায় একদিন সকালে বৃদ্ধার বাড়িতে গেলে তিনি জানালেন, আজ কোনো কাজ নেই। একজন-নেককার ব্যক্তি তোমার আগেই কাজগুলো শেষ করে গেছেন। পরের দিনেও এমনটি ঘটলে, সেই ব্যক্তি তালাশে তৃতীয় দিন তিনি একটু আগে গেলেন। দেখতে পেলেন খলিফা আবু বকর নিজে অন্ধ বৃদ্ধার ঘরের কাজ করে দিচ্ছেন। (কানযুল উম্মাল : ৩৭৪৩৭)। উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তিদ্বয়ের হৃদয় মানবপ্রেমে ভরপুর ছিল। ছিল অফুরন্ত মায়া-মমতা। যশ-খ্যাতি, পদণ্ডপদবির অহমিকা মানব সেবা থেকে তাদের বিচ্যুত করতে পারেনি। নবীজি বলেছেন, দয়াময় আল্লাহ দয়াকারীদের ওপর দয়া করেন। পৃথিবীবাসীর ওপর দয়া কর, তাহলে আসমানওয়ালা তোমার ওপর দয়া করবেন (তিরমিযি : ১৯২৪)।
ইয়ারমুকের যুদ্ধ এবং পানিকাণ্ড : ইয়ারমুকের যুদ্ধে মারমার কাটকাট অবস্থার একপর্যায়ে ইকরামা ইবনে আবি জাহল চিৎকার দিয়ে বললেন, কে আছ, যে মৃত্যুর শপথ নিবে? তার আহ্বানে চাচা হারিস এবং দিরার ইবনে আযওয়ারসহ প্রায় চারশ’ অশ্বারোহী শহিদ হওয়ার শপথ নিলেন। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে প্রায় সবাই আহত হন। অনেকেই শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেন। যাদের অন্যতম ছিলেন দিরার ইবনে আযওয়ার। ঐতিহাসিক ওয়াকেদি বলেন, তারা আহত হয়ে লুটিয়ে পড়লে, পিপাশা কাতর অবস্থায় পানি চাইতে থাকেন। পানি সংকট ছিল বিধায় তাদের কাছে যতসামান্য পানি আনা হয়। প্রথমজনের কাছে পান করার জন্য পানি পেশ করা হলে, অন্য একজন সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন। তা দেখে প্রথমজন বললেন, আগে তাকে দিন। তার নিকট পানি পেশ করা হলে, অন্য একজন সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাই তিনি পান না করে তৃতীয় জনের কাছে পাঠিয়ে দেন। এভাবে তারা একে অন্যের নিকট পানি পাঠাতে থাকেন। এমনিভাবে পুনরায় প্রথম ব্যক্তির কাছে এসে দেখেন তিনি শাহাদত বরণ করেছেন। দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে এসে দেখেন তিনিও শাহাদত বরণ করেছেন। এমনি করে সবাই পানি পান করা ছাড়াই শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নেহায়া:৭:৩০)। প্রত্যেকের পানির প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অন্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এটাই ইসলামের সৌর্ন্দয, প্রকৃত মানবপ্রেম। এমন মানবপ্রেম দুনিয়ায় আর কোথায় পাওয়া যাবে না। ইসলাম মানুষকে দয়ালু হতে শেখায়। শেখায় নিজের প্রয়োজনের ওপর অন্যের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিতে। তাতে যে, সুখানুভূতি আছে তা অন্য কোথাও নেই। সেজন্যই হয়তো বলা হয়, ভোগে সুখ নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। নবী (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেটাই পছন্দ করে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে (বোখারি:১৩)।
লেখক: খতিব, বাইতুল আজিম জামে মসজিদ রংপুর।