বিশ্ব রাজনীতির আদর্শ মহানবী (সা.)। তিনি যেমন আচার-অনুষ্ঠান-ইবাদতে অনন্য ও সর্বজন অনুসৃত ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তেমনি রাজনীতির অঙ্গনেও মহাকালের মহামানব ছিলেন। তিনি ছিলেন দুনিয়াবিমুখ, নির্মোহ সাধক পুরুষ। যুদ্ধের ময়দানে সিপাহসালার। সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধন রক্ষাকারী। ঈমান ও তাওহিদের প্রশ্নে আপসহীন। কল্যাণ ও সঠিক পথের আহ্বানকারী। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তার জীবনের নানান ঘটনায়। মক্কার জীবনে ইসলামের শুরু যুগে কালিমার দাওয়াত থেকে বিরত থাকার জন্য তৎকালীন কাফের নেতাদের পক্ষ থেকে সুন্দরী নারী ও প্রচুর সম্পদের প্রস্তাব পেয়েও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আর দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, তাওহিদের দাওয়াত বন্ধ করার বিনিময়ে আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চাঁদ এনে দিলেও আমি তা কখনোই পরিত্যাগ করব না। বিপুল সম্পদ ও সুন্দরী নারীর প্রলোভনের সামনে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে তা প্রত্যাখ্যান করা একজন দায়ী ইল্লাল্লাহ ও আদর্শ রাজনৈতিকের বৈশিষ্ট্য। এ ঘটনার মধ্যদিয়ে রাসুল (সা.) নজির স্থাপন করে উম্মতকে শিক্ষা দিলেন, সৎ ও কল্যাণকর লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামে লোভ ও ব্যক্তি স্বার্থ পরিহার করা জরুরি। লোভ ছাড়তে না পারলে নীরব বার্তা হলো, মুষ্টিমেয় নেতস্থানীয় লোকের লোভ পুরো জাতির জন্য গজব হয়ে ধেয়ে আসে। জুলুম ও দুর্ভোগে ছেয়ে যায় সমাজ। হারাতে হয় স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা।
দ্বীন প্রচার, তাওহিদি আদর্শ বাস্তবায়ন এবং এপথে লক্ষ্য অর্জনে অটল থাকায় রাসুল (সা.) মক্কাজীবনে আত্মত্যাগের মহাকালীন প্রামাণ্য ইতিহাস রচনা করেছেন। কালের মূর্তিপূজক জালেম কর্তৃক নির্যাতন ভোগ করেও নীরবে সয়েছেন সব যাতনা। পরবর্তীতে মহানবীর মদিনায় হিজরত, মদিনায় যাপিত জীবন, যুদ্ধাভিযান, হুদায়বিয়ার সন্ধি, মক্কাবিজয় এবং মক্কাবিজয় পরবর্তীকালীন নানান ঘটনা ও পদক্ষেপ তাকে বিশ্বনেতার মর্যাদা এনে দিয়েছে। তিনি বিভিন্ন রাজাবাদশার কাছে পত্র প্রেরণ করেন, মদিনাসনদ প্রণয়নসহ রাষ্ট্র শাসনের এক নতুন রূপরেখা বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করেন। ফলে তিনি হয়ে উঠলেন রাষ্ট্রনায়ক। মদিনা এ রাষ্ট্রের প্রধান শহর। দারুল খিলাফাহ। মসজিদে নববি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলকেন্দ্র। মহানবী (সা.) এর রাজনীতি ছিল শান্তি ও শৃঙ্খলার। কল্যাণ ও মানবতার। তাওহিদের ও আরাধনার। সম্প্রীতি ও ভালোবাসার। সাম্য ও উদারতার। পক্ষপাতহীন কল্যাণকামিতার। তার রাজনীতিতে ছিল না স্বদলপ্রীতি, প্রতিহিংসা, লুটপাট ও ব্যক্তি স্বার্থের হীন প্রয়াস। ভোগবিলাসের জীবন গঠনের অভিপ্রায়ে তিনি নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হননি। তার আদর্শে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত সাহাবিগণও রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যক্তি ভোগবিলাসকে পরিহার করে জনসেবার রাজনীতি করেছেন। চার খলিফা; আবুবকর, ওমর, উসমান ও আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর শাসনামলে খোদ খলিফাদের সাদাসিধে জীবনযাপন এবং সাধারণ জনগণের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার খেলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা আর ইতিহাসখ্যাত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের প্রবাদতুল্য দেশব্যাপী সর্বময় শান্তির শাসনব্যবস্থা ছিল রাসুল (সা.)-এর কল্যাণকামী রাজনীতিরই সুদীর্ঘ প্রতিফলিত ফসল। তাই বলা যায়,মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামি খেলাফত ব্যবস্থা ছিল তার সফল নেতৃত্ব ও কল্যাণকামী রাজনীতির গভীর ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তারক এক উজ্জ্বল নমুনা। যা আজকের বিশ্বরাজনীতিতে অনুপস্থিত ও অপ্রতুল। অনস্বীকার্য, মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন বিশ্বনেতা ও বিশ্বনবী। ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে এসে জনকল্যাণ সাধন ও মানবসেবাকে একদিকে ইবাদত অন্যদিকে রাজনীতির মূলনীতি হিসেবে স্থির করেছেন তিনি। রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে প্রায়োগিক জীবনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যদিয়ে এর নজিরও স্থাপন করেছেন তিনি। যা ইতিহাস ও সীরাতের কিতাবে সবিস্তার বর্ণিত হয়েছে।
রাজনীতিও যখন ইবাদত : আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে উম্মতের কল্যাণ, স্বার্থহীনভাবে অন্যের উপকার করার চিন্তা ও তার বাস্তবায়ন এবং মানুষের মাঝে পারস্পরিক শান্তি বজায় রাখার সদিচ্ছা যদি কোনো রাজনৈতিক নেতার থাকে, তাহলে সে রাজনীতি তার জন্য ইবাদতে পরিণত হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোনো কল্যাণ নেই, তবে কল্যাণ আছে যে নির্দেশ দেয় দান খয়রাত, সৎকর্ম ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের; আল্লাহর সš‘ষ্টি লাভের আকাঙ্ক্ষায় কেউ তা করলে, তাকে অবশ্যই আমি মহাপুরস্কার দেব। (সুরা নিসা : ১১৪)। চিন্তা করলে দেখা যাবে এ আয়াতে যেকোনো কাজে নিয়তের বিশুদ্ধতাসহ এমন তিনটি জিনিসের কথা বলা হয়েছে, যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে একটি সুস্থসমাজ গঠন করা যায়। একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব।
কেননা, সুস্থসমাজের ভিত্তি মূলত এগুলোর ওপরই। ভিত্তি তিনটি হলো: ১. সাদাকাহ ২. মারুফ তথা সকল কল্যাণকর কাজ ও ৩. ইসলাহ বাইনান্নাস তথা মানুষের মাঝে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা। শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষা করা। উন্নত চরিত্র অর্জনে একে অপরকে সহায়তা করা। পারস্পারিক বিরোধ নিরসন করা। এ তিনটি ভিত্তিকে সামনে রেখে কেউ রাজনীতি করলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কখনো দুর্নীতিগ্রস্ত হবে না। রাষ্ট্রের সর্বত্র কল্যাণ, সমতা, শান্তি ও সুখ বিরাজ করবে। বর্তমানে রাজনীতি ও নেতাদের অবস্থা তো এমন পর্যায়ে নেমে এসেছে, রাজনীতির আলাপে বা বৈঠকে কিংবা পরিকল্পনায় অন্যের ক্ষতির চিন্তা, নিজে অসদোপায়ে সুবিধাভোগের চেষ্টা, মিথ্যাচার, অপবাদ,কাদা ছোড়াছুড়ি, বে-ইনসাফি, জুলুমণ্ডনির্যাতন, দমন-পীড়ন, প্রতিহিংসা আর অষ্টপ্রহরের অহেতুক দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যা কখনো কাম্য নয় সচেতন নাগরিক ও রাজনৈতিকের কাছে। কিন্তু এটাই হালে হচ্ছে দেদারছে। জাতি বিধ্বংসী এ রাজনীতি থেকে উত্তরণের পথ হলো- ১. সাদাকাহ, ২. মারুফ তথা সব কল্যাণকর কাজ ও ৩. ইসলাহ বাইনান্নাস এ তিন মূলনীতির ব্যাপক চর্চা করা। এ তিনটি মূলনীতি কীভাবে সমাজে ও রাষ্ট্রে শান্তি নিশ্চিত করবে তা একটু আলোচনা করা যাক।
প্রথম মূলনীতি সাদাকাহ : এর আবেদন হলো, সমাজে সাদাকাহ এর ব্যাপক চর্চা করতে হবে। সাদাকাহ কী? সাদাকাহ একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। গরিব-মিসকিন বা অসহায়কে দান করাকেও সাদাকাহ বলে। আবার হাসি মুখে কারও সঙ্গে কথা বলাও সাদাকাহ। কোমল গলায় ভালো কথা বলাও সাদাকাহ। রাস্তা থেকে কাঁটা ও কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়াও সাদাকাহ। অন্যের উপকার করাও সাদাকাহ। সাদাকাহ এর অসংখ্য ও অগণিত রূপ ও ধরন আছে। ব্যাপ্তীময় অগণিত ধরন সাদাকাহ শব্দের অন্তর্ভুক্ত। কল্যাণকামিতা, পরোপকার, প্রার্থনা ও সহযোগিতার মানসিকতা ছাড়া কোনো সমাজ ও সামাজিক জীবনব্যবস্থা কখনো অস্তিত্বে আসতে পারে না। যদি অস্তিত্বে চলেও আসে, তাহলে সেটি টিকে থাকতে পারে না। টেকসই হয় না। তখন ধীরে ধীরে সভ্য সমাজের সব কাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। তাই নবী (সা.)-এর আদর্শে পরিচালিত রাজনীতিতে সাদাকাহ একটি অপরিহার্য অংশ। এ সাদাকাহ পরোপকার ও মার্জিত আচরণের প্রতি অনুপ্রাণিত করে। যার ফলে সম্প্রীতি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার জায়গা দৃঢ় ও বিস্তৃত হয়। এটা সুস্থসমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের অন্যতম উপাদান।
দ্বিতীয় মূলনীতি মারুফ : এটি পবিত্র কোরআনের এমন একটি শব্দ, যার নির্দিষ্ট কোনো অনুবাদ করা সম্ভব নয়। বোধগম্য ও ফায়দাজনক সকল ভালো বিষয়ই-এর অন্তর্ভুক্ত। সুস্থরুচিবোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা সমাজে প্রচলিত যে বিষয়কে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে ভালো বলবেন, সেটি মারুফ বলে বিবেচিত হবে। আর আয়াতে এমন বিষয়ের নির্দেশদাতার মাঝে কল্যাণ থাকার কথা বলা হয়েছে। তাই শুরুতে উল্লিখিত আয়াতে মারুফ বলতে বুঝাবে একেক জায়গায় একেক রকম। এক বিবেচনায় এক জায়গার মারুফ হবে এক রকম। অন্য বিবেচনায় অন্য জায়গায় মারুফ হবে অন্য রকম। যেমন- অফিসের ফাইলে ঘুষ না নিয়ে সাইন করা মারুফ। হাজতমান্দকে টাকা ধার দেয়া মারুফ, কিন্তু সুদ নেয়া মুনকার তথা পাপ। রাষ্ট্রীয় সম্পদ হেফাজত করা মারুফ, কিন্তু লুণ্ঠন, ধ্বংস বা আত্মসাৎ করা পাপ। পণ্যের ন্যায্য মূল্য বজায় রাখা মারুফ, কিন্তু সিন্ডিকেট করে মূল্যস্ফীতি পাপ। দুর্নীতি ও অন্যায় প্রতিরোধে অপরাধীকে যথাযথ শাস্তির আওতায় আনা মারুফ, কিন্তু এসব অপরাধমূলক কাজকে প্রশ্রয় দেয়া পাপ।এভাবে স্থান-কাল-পাত্রভেদে সুস্থ রুচিবোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা সমাজে প্রচলিত যে বিষয়কে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে ভালো বলবেন, সেটাই মারুফ তথা ভালো কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। ওই ভালো কাজটাই সবাই করতে হবে। এর চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। এভাবে ভালো কাজটা করা আর মন্দ কাজটা ছাড়ার মাধ্যমে একটি সুস্থসমাজ ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব।
তৃতীয় মূলনীতি ইসলাহ বাইনান্নাস : এর অর্থ হলো, মানুষের মাঝে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমানে গোত্রে-গোত্রে, দলেদলে, বংশে-বংশে মানুষের মাঝে পারস্পরিক বিশৃঙ্খলা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায়, গ্রামে-গ্রামে এই ব্যাধি ছড়িয়ে আছে। বিশেষভাবে যেখানে নেতস্থানীয়দের বসবাস সেখানে এই ব্যাধির ছড়াছড়ি বেশি। এ বিরোধ ও বিশৃঙ্খলা নিরসন করাই হলো ‘ইসলাহ বাইনান্নাস’। তাই সাদাকাহ, মারুফ ও ইসলাহ বাইনান্নাস- এই তিনটি বিষয় সর্বত্রই থাকা প্রয়োজন। যেখানে সাদাকাহ বন্ধ হয়ে যায়, সেখানে স্নেহ-মমতা ও শ্রদ্ধা-ভক্তির দরজাও রুদ্ধ হয়ে যায়। কারণ সাদাকাহকে ধারণ করে সমাজের মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত একে অন্যের প্রতি প্রকৃত সহমর্মিতা পোষণ না করবে, অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করার প্রবল তাড়নায় হৃদয় উদ্বেলিত না হবে, একে অন্যকে নিজের ওপর প্রাধান্য না দেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত একটি সুস্থসমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না।তাই আর্থিক ও আচরণগত সাদাকাহ এর প্রচলন ব্যাপক করা সম্ভব হলে খুব সহজেই একটি সুস্থসমাজও নির্মাণ সম্ভব।
আফসোসের বিষয় হলো- সাদাকাহ, মারুফ ও ইসলাহ বাইনান্নাস এ তিনটি বিষয় আজ সমাজের প্রতিটি জায়গায় এর বিপরীত প্রান্তে অবস্থান করছে। কোথাও সাদাকাহ নেই, কোথাও মারুফ নেই। আবার কোথাও এগুলো যদি থাকে, সেখানে আবার ইসলাহ বাইনান্নাসের লোক সমাজের মানুষের সংখ্যানুপাতে কম। তখন মন্দের তুলনায় ভালোর সংখ্যা কম হয়। ফলে বিশৃঙ্খলাকারী বেড়ে যায় আর সংশোধনকারী কমে যায়। তাই সুষ্ঠু সমাজ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তে হলে এবং রাজনীতি করে রাজনীতিকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করতে চাইলে জনগণের সর্বস্তর থেকে উপরিউক্ত তিনটি মূলনীতির যথাযথ চর্চা জরুরি।
প্রতিদানের শর্ত : নিয়ত সহিহ করা অর্থাৎ পূর্বোক্ত তিনটি বিষয় একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করা। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় কেউ রাজনৈতিকভাবে ভালো কাজ করলে, সে এর প্রতিদান আল্লাহর কাছে পাবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আর যে তা করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় অচিরেই আমি তাকে মহাপুরস্কার দান করব।’
লেখক : মুহাদ্দিস ও মিডিয়াকর্মী