ফেরাউনের পতন ও শিক্ষা
জুনাইদ ইসলাম মাহদি
প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আল্লাহ মহান। ইনসাফগার। তিনি অত্যাচার করেন না এবং অত্যাচারীকে প্রশ্রয়ও দেন না। পৃথিবীতে যত অত্যাচারী-জালেম শাসক এসেছে, তাদের অন্যতম হলো, ফেরাউন। ফেরাউন মূলত একটি পদবি। হাল-যামানায় রাষ্ট্রপতি যেমন একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির পদবি। তেমনি ফেরাউনও একটি পদবি যা তৎকালীন মিসরের শাসকরা ধারণ করত। মুসা (আ.)-এর যুগের ফেরাউনের প্রকৃত নাম হলো, দ্বিতীয় রামসিস বা মিনফাতাহ। যিনি জুলুম, অত্যাচার, অহংকার, অহমিকা, পাপাচার আর অনাচারে দুনিয়ার অন্যসব জালেমকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে নিজেকে খোদা দাবি করেছিল। আল্লাহতায়ালা ছাড় দেন; কিন্তু ছেড়ে দেন না। তিনি এমনভাবে এই দাম্ভিকের ধ্বংস ও পতন ঘটিয়েছেন যে, পৃথিবী ও পৃথিবীবাসী যতদিন থাকবে, তার ধ্বংসের কথা স্মরণে রাখবে। পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন সুরায় তার ঘটনার বিবরণ এসেছে- আল্লাহতায়ালা মুসা (আ.) কে নবী বানিয়ে তার কাছে পাঠালেন। প্রেরিত নবীকে আদেশ করলেন, একত্ববাদের দাওয়াত দিতে। আর সীমালঙ্ঘন করা থেকে বারণ করতে।
আল্লাহ বলেন, ফেরাউনের কাছে যাও, নিশ্চয়ই সে সীমালঙ্ঘন করেছে (সুরা ত্ব-হা : ২৪)। অন্য আয়াতে এসেছে- মুসা (আ.) স্বীয় ভাই হারুনসহ ফেরআউনের কাছে এলেন এবং বললেন, আমরা জগৎ প্রতিপালকের রাসুল, বনী ইসরাইলকে আমাদের সঙ্গে যেতে দাও (সুরা শু’আরা : ১৭-১৮)। মুসা (আ.) যুক্তি তর্কের মাধ্যমে ফেরাউনকে বোঝানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন; কিন্তু দাম্ভিক ফেরাউন নিজেকেই বড় রব হিসাবে দাবি করল। সভাসদদের ডেকে বলল, হে পরিষদবর্গ! আমি ব্যতীত তোমাদের কোনো ইলাহ আছে বলে আমার জানা নেই (সুরা কাসাস : ৩৮)। আবার জনসাধারণকে জমায়েত করে ঘোষণা করল, আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক (সুরা নাযিয়াত : ২৩-২৪)।
ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হলেন না বরং মন্ত্রীদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, যারা তাকে রব মানবে না। বরং মুসা এবং তার খোদাকে রব মানবে তাদের ছেলেদের হত্যা করা হবে আর মেয়েদের জীবিত রাখা হবে। কোরআনে এসেছে- যারা তার সঙ্গী হয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাদের পুত্রদের হত্যা কর আর নারীদের জীবিত রাখ (সুরা মুমিন : ২৫)। যুগে যুগে জালেমরা এমনটাই করে এসেছে। তারা আইনের যাতাকলে পিষ্ট করে জনসাধারণকে।
ফেরাউনের পতন ও শিক্ষা : ফেরাউন যখন পানিতে ডুবে যাচ্ছিল। পরিত্রাণের কোনো উপায় পাচ্ছিল না। তখন সে চিৎকার করে বলত থাকে, আমি বিশ্বাস করলাম বনী ইসরাইল যাতে বিশ্বাস করে, নিশ্চয়ই তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই (সুরা ইউনুস : ৯০)। হাদিসে এসেছে, তার ঈমানের কথা শুনে জিবরাইল (আ.) তার মুখে সমুদ্রের কাদা নিক্ষেপ করেন। যাতে সে আর ঈমানের কথা বলতে না পারে। হতে পারে, আল্লাহর রহমত তার ক্রোধের ওপর প্রাধান্য পাবে এবং তিনি তাকে মাফ করে দিবেন (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া : ৬০৮)। আল্লাহতায়ালা তার এমন ধোঁকাপূর্ণ ঈমান কবুল করেননি। ধ্বংস হয়েছে জালিমের। পতন হয়েছে প্রবল অহংকারী ও অত্যাচারীর। তার এমন ধ্বংসাত্মক মৃত্যু থেকে দুনিয়াবাসীর জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষা। যেমন-
এক. তার মৃত্যু আমাদের শিক্ষা দেয়, কোনো ব্যক্তির জন্য অহংকারী, স্বৈরাচারী ও দাম্ভিক হওয়া উচিত নয়। কারণ ফেরাউনের ধ্বংসের পেছনে প্রধান কারণ ছিল অহংকার। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ বলেন, অহংকার আমার চাঁদর, যে আমার চাঁদর নিয়ে টান দেবে আমি তাকে লাঞ্ছিত করব, (ইবনে মাজাহ : ৪১৭৫)। দুই. ফেরাউন বনী ইসরাইলের অন্যান্য ঈমানদারকে লাঞ্ছনা, অপদস্থতা ও হত্যার পরে স্বয়ং মুসা (আ.) কেউ হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। কোরআনে এসেছে- ফেরাউন তার সভাসদদের বলল, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মুসাকে হত্যা করি (সুরা ইউনুস : ৯০)। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ, অভদ্র ও অশোভন আচরণ কারো জন্যই কল্যাণকর নয়। এতে শুধু নিজের ধ্বংসকেই ত্বরান্বিত করা হয়। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, যে আমার বন্ধুদের সঙ্গে শত্রুতা রাখে আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দেই (বোখারি : ৬৫০২)। আর এটা স্পষ্ট, আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ করে কেউ বিজয়ী হয় না। সুনিশ্চিত ধ্বংস হয়। তাই ধ্বংস থেকে বাঁচতে আল্লাহর প্রিয়বান্দাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। শত্রুতা বর্জন করতে হবে। তিন. ফেরাউন সীমালঙ্ঘনের সীমা পার করেছিল নিজেকে আল্লাহ হিসাবে দাবি করে। সে বলেছিল, আমিই তোমাদের বড় রব (সুরা নাযিয়াত : ২৩-২৪)। এর দ্বারা সে নিজের ধ্বংকে আহ্বান করেছিল। চার. এমন অত্যাচারী, অহংকারী, স্বৈরাচারী জালেম হওয়া কারো জন্য উচিত নয়। যার মৃত্যুতে শোকের বদলে মানুষ খুশি হয়। যেমনটা হয়েছিল ফেরাউন ও তার বাহিনীর ক্ষেত্রে এদের ধ্বংসে কেউ কষ্ট পায়নি, কাঁদেনি। কোরআনে এসেছে- তাদের ধ্বংসে (ফেরাউন ও তার বাহিনী) আসমান, জমিন কেউ কাদেনি (সুরা দুখান : ২৯)। তাই এমনভাবে জীবন গড়া উচিত, যাকে হারানোর বেদনায় পুরো জগৎ ব্যথিত হয়। পাঁচ. আল্লাহ প্রেমিদের বদণ্ডদোয়া নিতে নেই। আজ বা কাল তাদের বদণ্ডদোয়ার ফলাফল সামনে এসে যায়। যেমনটা হয়েছিল, ফেরাউনের সাথে। তার মৃত্যুর অন্যতম বড় কারণ মুসা (আ.) এর বদণ্ডদোয়া। সে মুসাকে এত-পরিমাণ যাতনা ও কষ্ট দিয়েছিল যে, তিনি বদণ্ডদোয়া করত বাধ্য হয়েছিলেন। ছয়. তার মৃত্যু আমাদের শিক্ষা দেয়, যে নিজে পথহারা সে অন্যকে পথ দেখাতে পারে না। ফেরাউন নিজে জানত না, সমুদ্রে রাস্তা কীভাবে হলো? সে বলে দিল আমিই তৈরি করেছি, আর সবাই অন্ধভাবে বিশ্বাসও করেছে। একবারও ভাবেনি তার দ্বারা এটা কীভাবে সম্ভব? ফেরাউন নিজে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং তার জাতিকেও ভ্রষ্ট করেছে। কোরআনে এসেছে- ফেরাউন তার জাতিকে পথভ্রষ্ট করেছে, তাদের পথ দেখাতে পারেনি (সুরা ত্ব-হা : ৭৯)।
সাত. আল্লাহ যাকে বাঁচাতে চান তাকে কেউ মারতে পারে না, সে যত দুর্বলই হোক। আর আল্লাহ যাকে মারতে ইচ্ছা করেন, তাকে কেউ বাঁচাতে পারে না, সে যতই শক্তিশালী হোক। আট. মৃত্যু এসে গেলে ঈমান আর তওবায় কোনো লাভ হবে না। তাই তওবা করতে চাইলে মৃত্যু আসার আগেই করা উচিত। আল্লাহ বান্দার তওবা মৃত্যুকালীন গড়গড়া আসার পূর্ব পর্যন্ত কবুল করেন, এর পরে নয়। (তিরমিযি : ৩৫৩৭)। ফেরাউনও শেষ সময়ে ঈমানের স্বীকারোক্তি দিয়েছিল; কিন্তু সেই ঈমান কবুল হয়নি। সে নিজেকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। জ্ঞানীদের উচিত, ফেরাউনের ঘটনা থেকে সঠিক শিক্ষা নেয়া এবং সকল ধরনের সীমালঙ্ঘন করা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। কারণ ফেরাউনরা যুগে যুগে আসে এবং তাদের পরিণতিও হয় করুণ। ফেরাউনদের পতনে সাধারণ মানুষ জুলুম থেকে নিষ্কৃতি পায়, আর মহান আল্লাহ জালেমকে সংশোধনের সুযোগ দেন। জালেম সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে তওবা করে সঠিক পথে ফিরে না এলে আল্লাহতায়ালা তাকে সাহায্য করেন না। পরিণামে কলঙ্কিত ভরাডুবিই হয় তার কর্মের ফল।