দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকের করুণ পরিণতি

শাহাদাত হোসাইন

প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিচারালয় এবং বিচারক মানুষ্য সমাজে ন্যায়ের প্রতিক হিসাবে চিহ্নিত। সমাজব্যবস্থাকে স্বচ্ছ-গতিশীল রাখতে। শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। জানমালের নিরাপত্তা কার্যকর করতে। অন্যায়, অপরাধ ও অব্যবস্থাপনার দূষণ হতে সমাজকে কলূষতামুক্ত করতে, বিচারালয় এবং বিচারকের গুরুত্ব অসীম। বিচারালয় এবং বিচারক মানুষের সর্বশেষ আস্থার ঠিকানা। সেই ঠিকানা যদি দুর্নীতিগ্রস্তÍ, পক্ষপাতপরায়ণ, অবিবেচক বিচারকের আতুরঘর হয়ে যায়। তবে মানুষের শেষ আশ্রয়টুকুও নষ্ট হয়ে যায়। এই গুরুত্ব অনুধাবনে ইসলাম দুর্নীতিগ্রস্তÍ বিচারকদের জন্য ভয়াবহ পরিণতির হোশিয়ারি বাণী উচ্ছারণ করেছেন।

বিচারকার্যে স্বচ্ছতা অবলম্বনে দাউদ (আ.)-এর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ : বিচারকার্য মানুষের মৌলিক অধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয়। তাতে ইচ্ছাকৃত খেয়ানত ও বিচ্ছুতি ক্ষমা আযোগ্য অপরাধ। অধিকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনুমোদন ব্যতীত আল্লাহ নিজেও এমন অপরাধ ক্ষমা করবেন না। সেজন্য বিচারকার্যে সচ্ছতা বজায় রাখতে তিনি কঠোরভাবে আদেশ করেছেন। দাউদ (আ.) কে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দেয়ার পর আল্লাহ তাঁকে বলেছিলেন, হে দাউদ! আমরা আপনাকে জমিনে খলিফা বানিয়েছি। অতএব, আপনি লোকদের মধ্যে সুবিচার করুণ এবং খেয়াল খুশির অনুসরণ করবেন না। কেননা, এটা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট হয় তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি, কারণ তারা বিচারদিনকে ভুলে আছে (সুরা সোয়াদ : ২৬)।

বিচারকার্যে ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করতে নবীজিকে নির্দেশ : কোরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহতায়ালা মানুষকে ন্যায়ের পথে পরিচালিত হওয়ার আদেশ করেছেন। নবীজি, যিনি ছিলেন ন্যায়-নীতির প্রতিক। তাকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেছেন, আমরা আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি। যাতে করে আল্লাহর দেখানো পথে আপনি বিচার করতে পারেন। আর আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ্যে বিতর্ককারী হবেন না (সুরা নিসা : ১০৫)। অন্যত্র জগতের সব মানুষকে সতর্ক করে আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে ফিরে দিতে। আর তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচারকার্য সম্পাদনা করবে (সুরা নিসা : ৫৮)।

নবীজির বর্ণনায় তিন শ্রেণির বিচারক এবং তাদের পরিণতি : নবীজি বিচারকদের তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন এবং তাদের শেষ পরিণতি সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন। বুরাইদা (রা.) স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন। নবীজি বলেছেন, বিচারক তিন শ্রেণির। তন্মধ্যে দুই-শ্রেণি জাহান্নামি আর এক-শ্রেণি জান্নাতি। যে বিচারক মানুষের অধিকার বুঝে সে অনুযাই বিচারকার্য করবেন তিনি জান্নাতি। আর যে বিচারক মানুষের অধিকার বুঝেছেন কিন্তু তা অনুযাই বিচারকার্য করেননি এবং যে বিচারক মানুষের অধিকার না বুঝে মূর্খতাবসত বিচারকার্য করবেন, তারা উভয়ে জাহান্নামি (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : ২১৫৭১)।

 

ন্যায়বিচ্যুত বিচারকের পরামর্শক শয়তান : ন্যায়পরায়ণ বিচারকের সাহায্যকারী স্বয়ং আল্লাহ। পক্ষান্তরে ন্যায়বিচ্যুত জালেম বিচারকের বন্ধু অভিশপ্ত ইবলিস। আর ইবলেস যার সঙ্গী হবেন তার ধ্বংস অনস্বীকার্য। নবীজি বলেছেন, আল্লাহতায়ালা ততক্ষণ পর্যন্ত বিচারকের সঙ্গে থাকেন, যতক্ষণ সে জুলুম না করে ন্যায়ের ওপর অটল থাকেন। কিন্তু যখনই সে অন্যায় করে, তখন আল্লাহ তার থেকে মুক্ত হয়ে যান। তখন শয়তান তাকে ধরে ফেলে। তার সঙ্গী এবং পরামর্শক হয়ে যায় (তিরমিজি : ১৩৩০)।

উৎকোচ গ্রহণকারী বিচারকের প্রতি নবীজির অভিশাপ : বিচারকার্যে অন্যায়-অন্যায্য রায় প্রদানের জন্য যারা উৎকোচ গ্রহণ করেন, ঘুষ নেন। তাদের জন্য নবীজি অভিশাপ করেছেন। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি বলেছেন, বিচারকার্যে ঘুষদাতা ও গ্রহীতার প্রতি নবীজি অভিশাপ করেছেন। (মুসনাদে আহমাদ : ৯০২৩)। অন্য হাদিসে এসেছে, নবীজি বলেছেন, ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ে জাহান্নামি (মুসনাদুল বাজ্জার : ১০৩৭)। বিচারকরা সমাজ ও রাষ্ট্রের সঞ্চালক। অন্ধকারে আলোর ঝলক। তাদের দেখানো ন্যায়ের পথ মানুষের প্রতি অন্যায়কে প্রতিহত করবে। তারা ধনী-বণিক, শক্তিশালী ব্যক্তি থেকে সহায়-সম্বলহীন, রিক্তহস্ত দুর্বলকে যেমন ন্যায় দেবেন। তেমনি পদচ্যুত জালিম শাহীকেও সঠিক পথে পরিচালিত হতে বাধ্য করবেন। মনে রাখবেন, টাকা-পয়সা নিয়ে কারো পক্ষে রায় দেয়া যেমন ঘুষ ও অন্যায্য। তেমনি পদণ্ডপদবির লোভে সরকারের অন্যায় মতের পক্ষে রায় দেয়ায়ও এক-ধরনের ঘুষ যা ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

দুর্নীতিগ্রস্তÍ বিচারক জাহান্নামি : আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন। যে ব্যক্তি বিচারক হয়ে মানুষের মাঝে বিচারকার্য করবে। জাহান্নামের দারোগা মালেক ফেরেস্তা তার ঘাড়ের পেছনের অংশে শক্তভাবে ধরে জাহান্নামের তীরে উঁচিয়ে ধরবেন। এরপর সে মাথা উত্তোলন করবেন। তাকে যখন বলা হবে, নিক্ষেপ করো। তখন সে সজোরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। যার কারণে সেই বিচারক জাহান্নামের ৪০ খরিফ নিচে তলিয়ে যাবে (আখবারুল-কুজাত : ১৯)।

লেখক : খতিব, বাইতুল আজিম জামে মসজিদ রংপুর