মহানবীর স্ত্রীর প্রতি আচরণ
আবদুল কাইয়ুম শেখ
প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মুহাম্মদ (সা.) আমাদের নবী। তিনি বিশ্বনবী। সবার প্রিয়নবী। সবার কাছে প্রিয় হওয়ার মূল কারণ তার উন্নত চরিত্র ও কোমল আচরণ। বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর এই মহোত্তম চারিত্রিক সুষমা তার ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। ব্যক্তি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো সাংসারিক জীবন। এই সাংসারিক জীবনেও মহানবী (সা.) ছিলেন উত্তম চরিত্রের মূর্ত প্রতীক। সংসার জীবনে মহানবী (সা.) এমন অনন্য পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, যার ফলে তার দাম্পত্য জীবন হয়ে উঠেছিল সুখময়, শান্তিময় ও প্রেমময়।
স্ত্রীর সঙ্গে খোশআলাপ করা : আনন্দ-বিনোদন, হাসি-কৌতুক ও হাস্যরসবিহীন সংসার ধূসর মরুভূমির মতো। সুখ, শান্তি ও প্রশান্তিময় দাম্পত্য জীবনের জন্য হাস্যরস থাকা অপরিহার্য। হালাল বিনোদন, হাসি কৌতুক ও হাস্যরসের মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর দাম্পত্য জীবন সুখময়, শান্তিময় ও প্রেমময় ছিল। তিনি উম্মাহাতুল মোমিনিনের সঙ্গে সময়ে সময়ে হাসি-কৌতুক, আনন্দ-বিনোদন ও হাস্যরস করতেন। একবার আয়েশা (রা.)-এর খেলনাসমূহের মধ্যে ডানাবিশিষ্ট একটি পুতুল দেখতে পেয়ে মহানবী (সা.) জিজ্ঞেস করেন, এটা কী? আয়েশা (রা.) জবাবে বলেন, ঘোড়া! মহানবী (সা.) হেসে বলেন, এটা আবার কেমন ঘোড়া, যার পাখা রয়েছে? এ প্রসঙ্গে আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) তাবুক অথবা খায়বরের যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তন করলেন। ঘরের তাকের ওপর পর্দা ঝুলানো ছিল। বায়ুপ্রবাহের ফলে তার একপাশ সরে যায়, যাতে তার খেলার পুতুলগুলো দৃশ্যমান হয়ে পড়ে। তিনি পুতুলগুলো দেখে বললেন, হে আয়েশা! এগুলো কী? উত্তরে তিনি বললেন, এগুলো আমার মেয়ে। আর তিনি এগুলোর মধ্যে কাপড়ের তৈরি দুই ডানাবিশিষ্ট একটি ঘোড়াও দেখতে পেলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, এগুলোর মধ্যে ওটা কী দেখতে পাচ্ছি? তিনি বললেন, ঘোড়া। নবী করিম (সা.) বললেন, তার ওপর আবার ওটা কী? তিনি বললেন, দুটো পাখা। তিনি বললেন, এ আবার কেমন ঘোড়া, যার পাখা আছে? আমি বললাম, আপনি কি শুনেননি, সুলাইমান (আ.)-এর ঘোড়ার কয়েকটি পাখা ছিল! আয়েশা (রা.) বলেন, একথা শুনে রাসুল (সা.) হেসে দিলেন, যাতে আমি তার সামনের সারির দাঁত দেখতে পেলাম। (সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৩২)।
স্ত্রীর সঙ্গে প্রেমময় আচরণ : মা-বাবা, ভাই-বোন ও পরিবার-পরিজন ছেড়ে যখন কোনো মেয়ে স্বামীর গৃহে আসে, তখন সে স্বামীর ভালোবাসার কাঙাল থাকে। শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর চেয়ে বেশি আপন আর কেউ স্ত্রীর থাকে না। এমতাবস্থায়, স্বামীর কর্তব্য হলো স্ত্রীর সঙ্গে দয়া, মমতা, হৃদ্যতা, আন্তরিকতা ও প্রীতিপূর্ণ আচরণ করা। মহানবী (সা.) তার স্ত্রীদের সঙ্গে দয়া, মমতা, হৃদ্যতা ও প্রীতিপূর্ণ আচরণ করতেন। আম্মাজান আয়েশা (রা.) যদি তার মিসওয়াক দিয়ে মিসওয়াক করতেন, তাহলে তিনি বিষয়টি সমর্থন করতেন ও নীরব থাকতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) মিসওয়াক করে তা ধোয়ার জন্য আমাকে দিতেন। আমি নিজে প্রথমে তা দিয়ে মিসওয়াক করতাম, অতঃপর সেটা ধুয়ে তাকে দিতাম।' (সুনানে আবু দাউদ : ৫২) বিশ্বনবী (সা.) কর্তৃক স্ত্রীর সঙ্গে প্রেমময় ও প্রীতিপূর্ণ আচরণ করার অনন্য নজির হলো, আয়েশা (রা.) ঋতুবতী থাকা অবস্থায় পানি পান করলে পানপাত্রের যেস্থান দিয়ে তিনি পানি পান করতেন মহানবী (সা.)ও সে স্থান দিয়ে পানি পান করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি ঋতুবতী অবস্থায় পানি পান করতাম এবং পরে মহানবী (সা.) কে অবশিটুকু প্রদান করলে আমি যেখানে মুখ লাগিয়ে পান করতাম তিনিও পাত্রের সে স্থানে মুখ লাগিয়ে পান করতেন। আবার আমি ঋতুবতী অবস্থায় হাড় খেয়ে তা নবী (সা.) কে দিলে, আমি যেখানে মুখ লাগিয়েছিলাম তিনি সেখানে মুখ লাগিয়ে খেতেন। (মুসলিম : ৫৭৯)।
সঙ্গ দেয়া ও খোঁজখবর নেয়া : কিছু পুরুষ এমন আছেন যারা কর্মব্যস্ততার দোহাই দিয়ে স্ত্রীকে সময় দেন না ও তার যথাযথ খোঁজ নেন না। কিন্তু মহানবী (সা.) একজন রাষ্ট্রনায়ক, সমরনায়ক, প্রধান বিচারপতি ও ইমামণ্ডকাম খতিব হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীদের প্রয়োজন পরিমাণ সময় দিতেন ও তাদের খোঁজখবর নিতেন। স্ত্রীদের মধ্য হতে কারো কোনো প্রয়োজন থাকলে তাদের প্রয়োজন পূরণ করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, যখন মহানবী (সা.) আসরের নামাজ শেষ করতেন, তখন নিজ স্ত্রীদের মধ্য থেকে যে কোন একজনের কাছে গমন করতেন। একদিন তিনি স্ত্রী হাফসা (রা.)-এর কাছে গেলেন এবং সাধারণত যে সময় কাটান তার চেয়ে বেশি সয় কাটালেন।' (বোখারি : ৫২১৬)।
স্ত্রীকে প্রহার না করা : স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর চলাফেরা খানিক সময়ের নয়, বরং সারা জীবনের। এজন্যই হয়তো স্ত্রীকে পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী বলা হয়। স্বামীর সঙ্গে জীবনযাপন করতে গিয়ে অনেক সময় স্ত্রীর ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এই ভুলভ্রান্তি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে পারা উত্তম পুরুষের পরিচায়ক। কিন্তু অনেক পুরুষ জীবন সাথীর ভুলভ্রান্তিকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিতে পারে না। পান থেকে চুন খসলেই রাগান্বিত হয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর ওপর হামলে পড়ে। কারণে-অকারণে স্ত্রীকে বকাবকি করতে থাকে এবং অনেক সময় মেজাজ খারাপ করে স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। কিন্তু বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) কখনো এমন করেননি। তিনি স্ত্রীদের ভুলভ্রান্তি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন। তার জীবনে কোন স্ত্রীকে কিংবা যুদ্ধের ময়দান ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে প্রহার করার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি কখনো আল্লাহর রাসুল (সা.) কে তার কোন সেবক এবং তার কোন স্ত্রীকে প্রহার করতে দেখিনি। তিনি আল্লাহর পথে জিহাদরত থাকা ছাড়া কোনো সময় কাউকে প্রহার করেননি। (মুসনাদে আহমদ : ২৫৩৯২)।
স্ত্রীর ভুলত্রুটি ক্ষমা করা : সংসার জীবনে স্ত্রীর ভুলভ্রান্তি হওয়া স্বাভাবিক। স্ত্রীর ভুলভ্রান্তি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে না দেখলে সংসার অনেক সময় অগ্নিগর্ভ ও অশান্তিময় হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু স্বামী এমন আছেন, যারা স্ত্রীর ভুলভ্রান্তি সহ্য করতে চান না। মহানবী (সা.) এমন ছিলেন না। তিনি স্ত্রীদের ভুলভ্রান্তি সহ্য করতেন। জাতুর রিকার যুদ্ধের সফরে আয়েশা (রা.)-এর অন্যমনস্কতার কারণে তার গলার হার ছিঁড়ে পড়ে যায়। যে স্থানটিতে হারটি হারায়, সেখানে পানি ছিল না এবং বাহিনীর লোকদের সঙ্গেও পানি ছিল না। ফলে পুরো বাহিনীকে চরম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মহানবী (সা.) আয়েশা (রা.) কে বকাবকি বা তিরস্কার করেননি। তিনি বিষয়টি সহ্য করেন এবং বাহিনীর লোকদের নিয়ে হারের সন্ধানে লেগে পড়েন। স্ত্রীর এত বড় ভুল সহ্য করে নেয়া এবং তাকে শাসন বা তিরস্কার না করা মহানবীর সহনশীল ও প্রেমময় গুণ ছিল। এ ঘটনাটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, আমরা আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে এক যুদ্ধের সফরে গিয়েছিলাম, তখন আমার হারটি গলা হতে ছিঁড়ে পড়ে যায়। হারটি খোঁজার জন্য মহানবী (সা.) সেখানে অবস্থান করেন। এজন্য সাহাবিরাও তার সঙ্গে সেখানে অবস্থান করেন। সেখানে পানি ছিল না এবং তাদের সঙ্গেও পানি ছিল না। তাই সাহাবিরা আবু বকর (রা.)-এর কাছে এসে বললেন, আপনি কি দেখছেন না, আয়েশা (রা.) কি করলেন? তিনি আল্লাহর রাসুল (সা.) এবং তার সঙ্গে সাহাবিগণকে এমন স্থানে অবস্থান করালেন, যেখানে পানি নেই এবং তাদের সঙ্গেও পানি নেই। তখন আবু বকর (রা.) আমার নিকট এলেন।
এ সময় আল্লাহর রাসুল (সা.)আমার উরুর ওপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে বলতে লাগলেন, তুমি আল্লাহর রাসুল (সা.) ও সাহাবিগণকে এমন এক স্থানে আটকিয়ে রেখেছ, যেখানে পানি নেই এবং তাদের সঙ্গেও পানি নেই। আয়েশা (রা.) বলেন, তিনি আমাকে অনেক বকাবকি করলেন। এমনকি তিনি হাত দ্বারা আমার কোমরে খোঁচা মারতে লাগলেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) আমার উরুর ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকার কারণে আমি নড়াচড়াও করতে পারছিলাম না। এমনি পানি না থাকা অবস্থায় আল্লাহর রাসুল (সা.) সকাল পর্যন্ত ঘুমন্ত থাকলেন। তখন আল্লাহতায়ালা তায়াম্মুমের আয়াত অবতীর্ণ করলেন এবং সকলেই তায়াম্মুম করলেন। উসাইদ ইবনু হুযাইর (রা.) বলেন, হে আবু বকর রা. এর পরিবারবর্গ, এটা আপনাদের প্রথম বরকত নয়। আয়েশা (রা.) বলেন, অতঃপর আমরা সে উটটিকে উঠালাম যে উটের উপর আমি সওয়ার ছিলাম। আমরা হারটি তার নিচে পেয়ে গেলাম।' (বোখারি: ৩৬৭২)।