ঢাকা ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম

মাহদি হাসান
ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম

ইন্দোনেশিয়া। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। ঐতিহাসিক মাসউদি এ অঞ্চলের নাম উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছিলেন ‘জুযুরুল মাহারাজ’ মানে মহারাজার দ্বীপপুঞ্জ। অপর ঐতিহাসিকরা এ অঞ্চলের পরিচয় দিয়েছেন সুমাত্রা, জাভা প্রভৃতি বিভিন্ন দ্বীপের মাধ্যমে। কেউ বলেন, ইন্দোনেশিয়া শব্দটি ইন্দো এবং নেশিয়া এ দুটি শব্দের মাধ্যমে গঠিত। ইন্দো মানে হচ্ছে হিন্দু এবং নেশিয়া মানে হচ্ছে দ্বীপপুঞ্জ। এমনিভাবে অনেক ঐতিহাসিক এ অঞ্চলকে হিন্দুস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় দ্বীপপুঞ্জ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। কেউ এর নাম দিয়েছেন সবুজ ভূখণ্ড। তবে খ্রিস্টীয় উনবিংশ শতাব্দী থেকে এ অঞ্চলটি ইন্দোনেশিয়া হিসেবে পরিচিত লাভ করে। ভৌগোলিকভাবে এ অঞ্চলে বড় ছোট মিলিয়ে প্রায় ১৭ হাজার দ্বীপ রয়েছে। এর পাশাপাশি ঐতিহাসিকভাবে মালয়েশিয়া এবং মালদ্বীপ প্রভৃতি রাষ্ট্রগুলোও ছিল এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। ৬০০টি দ্বীপে জনবসতি রয়েছে। যেখানকার ৯৭ থেকে ৮৫ শতাংশ জনগণই মুসলিম।

ইসলামের আগমন : বৃহৎ এই অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটেছিল কোনো যুদ্ধবিগ্রহ এবং তীর-তলোয়ারের নিগ্রহ ব্যতিরেকেই। ইতিহাসের বিকৃত উপস্থাপনকারীরা জোর গলায় দাবি করেছে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুদ্ধবিগ্রহ এবং তলোয়ারের জোরে। ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলে ইসলাম আগমন তাদের এই দাবিকে মিথ্যা প্রমাণিত করে। এ অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটেছিল প্রায় আট অথবা নয় শতাব্দী আগেই। ঐতিহাসিক সূত্রগুলো বলছে, হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষে অথবা তৃতীয় শতাব্দীর শুরুলগ্নে সুমাত্রা এবং মালয় দ্বীপপুঞ্জের কিছু বন্দরে মুসলিম ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসায়িক ঘাঁটি স্থাপন করেন। আম্মান, হাজরামাউত এবং ইয়ামানের দক্ষিণ উপকূলের ব্যবসায়ীরা সবার আগে এই অঞ্চলে আগমন করেন এবং সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলে নিজেদের ব্যবসায়িক ঘাঁটি স্থাপন করেন। এই ব্যবসায়ীরা ছিলেন শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী। কতক সূত্রের ভাষ্য হচ্ছে, আব্বাসি খলিফা হারুনুর রশিদের সময় কজন ইন্দোনেশীয় ব্যবসায়ী বাগদাদে সফর করেন। সফর থেকে ফেরার পথে তারা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে নিয়ে যান ইসলামের শ্বাশ্বত আকিদা-বিশ্বাস। অতঃপর নিজ নিজ অঞ্চলে পৌঁছে তারা ইসলামের দাওয়াতকে বিস্তৃত করার মহতি মিশনে নিবেদিত হন।

এদিকে প্রাচ্যবিদ টমাস আরনল্ড ‘দ্য প্রিচিং অব ইসলাম’ গ্রন্থে বলছেন, ‘খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষদিকে এসে শ্রীলংকার পথ ধরে চীনের সঙ্গে মুসলিমদের ব্যবসায়িক প্রসার ঘটে। এর ফলে অষ্টম শতাব্দীতেই সেখানে আরব ব্যবসায়ীদের দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করতে দেখা গেছে। পর্তুগিজ ফিরিঙ্গিদের আগমনের আগ পর্যন্ত খ্রিষ্টীয় দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়ে প্রাচ্যের আরবরাই ছিল এ অঞ্চলের বাণিজ্যে শীর্ষ অবস্থানে। ছিল না তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী। এ থেকে আমরা জোরালোভাবেই এই ধারণা পেতে পারি যে, আরবরা বেশ আগেই এ অঞ্চলে তাদের ব্যবসায়িক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছিল।’

ইবনে বতুতার সাক্ষ্য : ঐতিহাসিক সূত্রগুলো থেকে জানা যায় যে, জাভা দ্বীপের মারাসিলু অঞ্চলের রাজা ‘সামাদরাহ’ খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে একদল মুসলিম ধর্মপ্রচারকের হাতে সর্বশেষ ইসলাম গ্রহণ করেন। যাদের নেতৃত্বে ছিলেন শাইখ ইসমাইল নামক একজন মনীষী। এই রাজাই পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের দক্ষিণে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালাক্কা প্রণালী সংলগ্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে অবদান রাখেন। ইসলাম গ্রহণের পর এই রাজা ‘আল মালিকুস সালিহ’ নামধারণ করেন এবং নিকটবর্তী বারলাক রাজ্যের রাজকুমারীকে বিয়ে করেন। তাদের ঔরসে জন্ম নেয় দুটি পুত্রসন্তান। জ্যৈষ্ঠ পুত্রের নাম ছিল আল-মালিকুজ জাহির। ৭৪৩ হিজরি মোতাবেক ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এ অঞ্চলে সফর করেন এবং আল-মালিকুজ জাহিরকে জাভার বাদশাহ হিসেবে অধিষ্ঠিত দেখতে পান। ইবনে বতুতা তার সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি ছিলেন সম্মানিত এবং সম্ভ্রান্ত বাদশাহ। শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী। ফকিহদের কাছে তিনি ছিলেন আস্থার এক নাম। ফকিহরা তার কাছে এসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। এই বাদশাহ অনেক জিহাদ এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। পায়ে হেঁটেই তিনি জুমার নামাজে এসে হাজির হতেন। তার প্রজারা ছিল শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী এবং জিহাদের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী। স্বেচ্ছায় তারা তাদের বাদশাহর সঙ্গে জিহাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেত এবং বিপক্ষের কাফিরদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করত। কাফিররা তার সঙ্গে সন্ধি করে জিজিয়া কর আদায় করত।’

ইবনে বতুতার এই সাক্ষ্য থেকে বুঝা যায় যে, এ অঞ্চলের অধিবাসীদের ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম প্রজন্ম মুসলিম প্রচারকদের হাতে স্বেচ্ছায় ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করে। এই প্রচারকদের অনেকে ছিলেন ব্যবসায়ী, অনেকে ছিলেন আলিম। কেউ ছিলেন আরব, কেউ ছিলেন ভারত অথবা পাকিস্তান অঞ্চলের। পরবর্তী সময়ে তাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম এসে ইন্দোনেশিয়া এবং পার্শ্ববর্তী মালয়েশিয়া অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয় এবং এ লক্ষ্যে জিহাদেও অংশগ্রহণ করে। তাদের শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী হওয়া প্রমাণ করে যে, তাদের কাছে প্রথম দাওয়াত পৌঁছেছিল হাজরামাউত অঞ্চলের শাফেয়ী মুসলিমদের মাধ্যমে। এমনিভাবে ভারতবর্ষের দক্ষিণের মালাবার অঞ্চলের মুসলিমদেরও ছিল ইসলাম প্রচারে প্রশংসনীয় অবদান। তারাও ছিল শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী। মালয় দ্বীপপুঞ্জ এবং বর্তমান ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে তাদেরও ছিল অগ্রগণ্য অবদান।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত