স ত্যের সন্ধানে একজন মানুষ ছুটে বেরিয়েছেন পারস্য থেকে সিরিয়ায়, মুসেল থেকে নাসিবীনে, নাসিবীন থেকে আম্বুরিয়ায়, আম্বুরিয়া থেকে মদিনায়। মদিনাতে এসে তিনি কাঙ্ক্ষিত সত্যকে খুঁজে পেয়েছেন এবং শেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাহাবি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। এই মানুষটির নাম হজরত সালমান ফারসি (রা.)। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তার নাম ছিল মাহবা। ইসলাম গ্রহণের পর তার নাম হয় সালমান। তিনি পারস্যের অধিবাসী ছিলেন বলে তাকে ফারসি বলা হয়। হজরত সালমান ফারসি (রা.) ছিলেন উম্মাতে মুহাম্মাদির সবচেয়ে দীর্ঘায়ু ব্যক্তি। তিনি বলেন, আমি রামাহুরমুয-এর অধিবাসী। বোখারি, কিতাবুল মানাকিব)। তার পিতা ছিলেন এলাকার সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তি এবং মাজুসী অর্থাৎ অগ্নিপূজারী। বালক সালমানের ওপরে দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তাদের বাড়িতে সর্বদা আগুন জ্বালিয়ে রাখার।
একদিন তার পিতা তাকে বাড়ির বাইরে পাঠালেন তাদের খামারগুলো দেখে আসার জন্য। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন : 'আমি খামারের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হলাম। এরই মধ্যে আমার কানে ভেসে এলো প্রার্থনার সুমিষ্ট আওয়াজ। আমি সেদিকে আকৃষ্ট হলাম এবং প্রার্থনাগৃহের দিকে গেলাম। সেটা ছিল খ্রিষ্টানদের গীর্জা। তাদের প্রার্থনায় আমি মুগ্ধ এবং অভিভূত হয়ে পড়লাম। দীর্ঘক্ষণ গভীরভাবে তাদের প্রার্থনা নিরীক্ষণ করে তাদের দ্বীনের প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম। মনে মনে বললাম, আল¬াহর কসম! আমরা যে দ্বীনের অনুসারী সে দ্বীনের চেয়ে এ দ্বীন কতোই না উত্তম। আমি খামারে না গিয়ে তাদের কাছে সারাদিন কাটিয়ে দিলাম। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম- এ দ্বীনের উৎস কোথায়? তারা বলল- সিরিয়ায়। সূর্যাস্ত হলো। অতঃপর আমি বাড়িতে ফিরে এলাম।’ (সিয়ারু আ'লাম আন-নুবালা, শামসুদ্দীন যাহাবী)। হজরত সালমান ফারসি (রা.) বাড়িতে ফিরলে তার পিতা জানতে চাইলেন, সে তার দায়িত্ব পালন করেছে কি না। তিনি যা ঘটেছে তা সত্য সত্য বললেন। তখন তার পিতা বললেন- ‘তোমার দ্বীন এবং তোমার বাপ-দাদাদের দ্বীন ওদের দ্বীনের চেয়ে উত্তম।' সালমান (রা.) বললেন : 'কখনোই নয়, আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই তাদের দ্বীন আমাদের দ্বীনের চেয়ে উত্তম।’ এ কথা শুনে তার পিতা তার ধর্মত্যাগী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে তার পায়ে শিকল পরিয়ে গৃহবন্দি করে রাখলেন।
সালমান (রা.) গোপনে খ্রিষ্টানদের কাছে সংবাদ পাঠালেন যে, যদি এখান থেকে কোনো কাফেলা সিরিয়ায় যায় তবে যেনো তাকে খবর দেয়া হয়। কিছুদিনের মধ্যেই সিরিয়া থেকে খ্রিষ্টানদের একটি বাণিজ্য কাফিলা তাদের কাছে এলে তারা সালমানকে খবর দিলো। কাফেলাটি যেদিন সিরিয়ায় প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি নিলো, সেদিন সালমান (রা.) কৌশলে তার পায়ের শিকল খুলে তাদের কাছে হাজির হলেন এবং তাদের সঙ্গে সিরিয়ায় এলেন। সেখানে তিনি এক খ্রিষ্টান ধর্মযাজকের খিদমতে মগ্ন হলেন। কিন্তু ধর্মযাজকটি ছিল অসৎ। লোকজন দ্বীনি কার্যক্রম পরিচালনা এবং গরিব-দুঃখীদের কল্যাণের জন্য যে অর্থ তার হাতে তুলে দিত, তা সে নিজেই আত্মসাৎ করত।
সালমান (রা.) তাকে ঘৃণা করতেন এবং সে মারা গেলে তিনি লোকদের ডেকে তার জমানো সম্পদের গোপন ভান্ডারটি দেখিয়ে দিলেন।
এই ব্যক্তির মৃত্যুর পর একজন উত্তম লোক তার স্থলাভিষিক্ত হলেন। প্রায় এক যুগ সালমান (রা.) তার খেদমত করেন। এই ব্যক্তি যখন অন্তিম শয্যায় শায়িত হলেন, তখন সালমান (রা.) তাকে বললেন : আমাকে অসিয়ত করুন, আপনার অবর্তমানে আমি কার সোহবতে থাকব। তিনি বললেন, আমি যে সত্যকে আঁকড়ে রেখেছিলাম, এখানে সে সত্যের ধারক-বাহক হিসেবে অন্য কাউকে আমার জানা নেই। সকলেই দ্বীনকে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করেছে। তবে মুসেলে এখনো একজন লোক দ্বীনের উপর কায়িম আছেন। তুমি তার সোহবতে থাকবে। এই বলে তিনি ইন্তেকাল করলেন। (মুখতাছার সীরাতির রাসুল (সা.)। সালমান (রা.) মুসেলে গিয়ে সেই লোকটির সোহবতে থাকলেন। কিছুদিন পর ওই ব্যক্তিও ইন্তেকাল করলেন এবং মৃত্যুর আগে তিনি সালমান (রা.)-কে বললেন নাসিবীন শহরের এক ব্যক্তির সোহবত লাভ করতে।
সালমান (রা.) নাসিবীনে গিয়ে সেই লোকটির সঙ্গে অবস্থান করতে লাগলেন এবং তাকে আগের দু'জনের মতো সত্যের ওপর অবিচল দেখলেন। কিছুদিন পর এই ব্যক্তিও ইন্তেকাল করলেন এবং মৃত্যুর পূর্বে সালমান (রা.)-কে অসিয়ত করলেন আম্বুরিয়া শহরের এক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তিনি আম্বুরিয়াতে গিয়ে সেই লোকটির কাছে অবস্থান করতে লাগলেন। এই ব্যক্তি যখন অন্তিম শয্যায় শায়িত হলেন, তখন বললেন: হে বৎস! আমরা যে দ্বীনের ওপর কায়িম ছিলাম, সে দ্বীনের ওপর মুখলিসভাবে কেউ এ ভূপৃষ্ঠে কায়িম আছে এমন কোনো সন্ধান আমার জানা নেই। তবে অদূর ভবিষ্যতে আরব দেশে দ্বীনে ইবরাহীমের মতো দ্বীন নিয়ে একজন নবী আবির্ভূত হবেন। তিনি নিজের জন্মভূমি থেকে হিজরত করে কালো পাথরের ভূমির মাঝখানে খেজুরের বাগানবিশিষ্ট ভূমিতে যাবেন। তার কিছু আলামত থাকবে। তিনি সাদাকাহ খাবেন না, তবে হাদিয়া গ্রহণ করবেন। তার কাঁধের মাঝখানে নবুওয়াতের মোহর থাকবে। যদি তুমি পারো, তবে সে দেশে চলে যেও। এই ব্যক্তির মৃত্যুর পর সালমান (রা.) কিছুদিন আম্বুরিয়াতে থাকলেন। কিছুদিন পর আরবের ‘কালব’ গোত্রের একদল বণিক সেখানে এলো। তিনি তাদের বললেন : যদি তোমরা আমাকে আরব দেশে নিয়ে যাও, তবে আমার সব গরু এবং ছাগল আমি তোমাদের দিয়ে দেব। তারা তাকে তাদের সঙ্গে নিলো। কিন্তু ‘সিরিয়া ও মদিনার মাঝে ওয়াদীউল কুরা নামক স্থানে পৌঁছলে তারা তার সাথে গাদ্দারী করল। তারা সালমান (রা.)-কে এক ইহুদির কাছে বিক্রি করে দিল। (মুখতাছার সীরাতির রাসুল (সা.)। সালমান (রা.) বলেন, ‘এক মালিক থেকে আরেক মালিক, এভাবে আমি ১০ জন মালিকের হাতে বদল হয়েছি।’
সালমান (রা.)-এর কোনো এক মনিব তাকে মদিনাতে নিয়ে আসে। এ সময় রাসুলল্লাহ (সা.) মক্কায় ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। যেদিন তিনি হিজরত করে মদিনার শহরতলী কুবাতে পৌঁছেন সেদিন সম্পর্কে সালমান (রা.) বলেন, ‘আমি খেজুরের গাছে উঠে কাজ করছিলাম। আমার মনিব গাছের নিচেই বসেছিলেন। তার ভাতিজা দৌড়ে এসে তাকে বলল, ‘হে চাচা! বনু কায়লা ধ্বংস হোক, আল¬াহর কসম! কুবাতে মক্কা থেকে একজন লোক এসেছেন, তিনি নাকি নিজেকে নবী বলে দাবি করছেন। লোকেরা তার কাছে জমা হয়েছে। এ কথা শুনতেই মনে হলো ঝাঁকুনি দিয়ে আমার শরীরে জ্বর এসে গেল, শরীরের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠল। আমার শরীর এমনভাবে কাঁপতে লাগল যে, আমি ভয় করলাম গাছ থেকে আমার মনিবের ঘাড়ের ওপর ধপাস করে পড়ে যাই কি না। এরপর দ্রুত গাছ থেকে নেমে মনিবের ভাতিজাকে বললাম, ব্যাপার কী, আমাকে খোলাসা করে বল। এ কথা বলতেই আমার মনিব আমার ওপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন এবং আমার গালে একটা প্রচণ্ড থাপ্পর বসিয়ে দিয়ে বললেন- এগুলো জেনে তোমার লাভ কী? তোমার কাজ তুমি কর।’ (সিয়ারু আ'লাম আন-নুবালা)।
সালমান (রা.) একদিন কিছু খেজুর নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট হাজির হলেন এবং বললেন যে, এগুলো সদাকার খেজুর এবং এগুলো আমি আপনাকে দান করতে চাই। রাসুলুল্লাহ (সা.) তা থেকে নিজে নিলেন না, কিন্তু দরিদ্র সাহাবিদের দিতে বললেন। অন্য একদিন তিনি কিছু খেজুর সংগ্রহ করে রাসুলল্লাহ (সা.)-এর নিকট গেলেন এবং জানালেন যে, তিনি এই খেজুরগুলো তার জন্য হাদিয়া হিসেবে এনেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তা থেকে নিজে খেলেন এবং সাহাবীদেরও দিলেন। আরেকদিন সালমান (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট গেলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) একটা চাদর গায়ে সাহাবীদের মাঝে বসে ছিলেন। সালমান (রা.) তাকে সালাম দিলেন এবং আম্বুরিয়ার ওস্তাদের বর্ণিত নবুওয়াতের মোহর দেখার জন্যে ঘন ঘন তার কাঁধের দিকে তাকাচ্ছিলেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন এবং পিঠ থেকে তার চাদর সরিয়ে ফেললেন।
সালমান (রা.) নবুওয়াতের মোহর দেখতে পেয়ে তাতে চুম্বন করতে লাগলেন এবং অঝোরে কাদতে শুরু করলেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কাঁদছ কেন? এই বলে তিনি তাকে তার পাশে বসালেন।
সালমান (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তার জীবনের সকল ঘটনা খুলে বললেন। তিনি তার কাহিনী শুনে খুবই বিস্মিত ও অভিভূত হলেন এবং তাঁর সাহাবাদেরকেও এ কাহিনী শোনানোর ইচ্ছে প্রকাশ করলেন।
সালমান (রা.) তার কাহিনী সাহাবাদেরও শোনালেন। তারও খুবই বিস্মিত ও অভিভূত হলেন। এরপর তিনি রাসুলল্লাহ (সা.)-এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হলেন। (মুখতাছার সীরাতির রাসুল (সা.)।
বদরের যুদ্ধ হয়ে গেল। উহুদের যুদ্ধও হয়ে গেল। হজরত সালমান (রা.) তখনো অমুসলিমের দাস।
একদিন রাসুলল্লাহ (সা.) সালমান (রা.)-কে ডেকে বললেন : সালমান তুমি তোমার মনিবের সঙ্গে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্যে চুক্তি কর। তিনি তাঁর মনিবের সঙ্গে এই চুক্তিতে সম্মত হলেন যে, তিনি তাকে ৩০০ খেজুরের চারা রোপণ করে দেবেন আর চল্লিশ আওকিয়া স্বর্ণও দেবেন। এর বিনিময়ে সে তাকে মুক্তি দেবে।
রাসুলল্লাহ (সা.)-কে এ শর্তের কথা জানালে তিনি সাহাবাদের বললেন : তোমরা যে যতটুকু পার তোমাদের ভাইকে সাহায্য কর। সাহাবীরা কেউ দশটা, কেউ বিশটা, কেউ পঁচিশটা এভাবে চারা দিতে লাগলেন। এভাবে ৩০০' চারা সংগৃহীত হয়ে গেল। সালমান (রা.) গর্ত খনন করলেন আর রাসুল (সা.) নিজহাতে চারাগুলো রোপণ করলেন। আল্লাহর রহমতে একটি চারাও মরল না। এরপর একদিন এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে স্বর্ণের একটি পি- হাদিয়া দিলে সেটি তিনি সালমান (রা.)-কে দিলেন। সালমান (রা.) গোলামী থেকে মুক্তি লাভ করলেন। রাসুল (সা.) সালমান (রা.) এবং আবু দারদা (রা.)-এর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করলেন। (অসমাপ্ত)