ঢাকা ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জীবন সায়াহ্নে মহানবীর আমল

শরিফ আহমাদ
জীবন সায়াহ্নে মহানবীর আমল

বিদায় হজের পর থেকেই রাসুল (সা.)-এর মাঝে আখেরাত সফরের আনন্দ অনুভূতি প্রকাশ হতে থাকে। ১১ হিজরির সফর মাসের শেষ দিকে রাসুল (সা.) শারীরিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, অন্তিম রোগে আক্রান্ত অবস্থায় আল্লাহর রাসুল (সা.) আবু বকর (রা.) কে লোকদের নিয়ে নামাজ আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই তিনি লোকদের নিয়ে নামাজ আদায় করেন। এরই মধ্যে আল্লাহর রাসুল (সা.) একটু সুস্থতা বোধ করলেন এবং নামাজের জন্য বেরিয়ে এলেন। তখন আবু বকর (রা.) লোকদের ইমামতি করছিলেন।

তিনি নবী (সা.) কে দেখে পিছিয়ে আসতে চাইলেন। নবী (সা.) তাকে ইঙ্গিত করলেন যেভাবে আছ সেভাবেই থাক। অতঃপর আল্লাহর রাসুল (সা.) আবু বকর (রা.)-এর বরাবর তার পাশে বসে গেলেন। তখন আবু বকর (রা.) আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর অনুসরণ করে নামাজ আদায় করছিলেন আর লোকেরা আবু বকর (রা.) কে অনুসরণ করে নামাজ আদায় করছিল। (বোখারি : ৬৮৩)।

অন্য একটি হাদিসে এসেছে হজরত আনাস ইবনে মালিক আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুল (সা.) অন্তিম রোগে আক্রান্ত অবস্থায় আবুবকর (রা.) সাহাবীগণকে নিয়ে নামাজ আদায় করতেন। অবশেষে যখন সোমবার এলো এবং লোকেরা নামাজের জন্য কাতারে দাঁড়াল তখন নবী (সা.) হুজরার পর্দা উঠিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন তার চেহারা যেন কোরআনে? কারিমের পৃষ্ঠার (এর ন্যায় ঝলমল করছিল) তিনি মুচকি হাসলেন। নবী (সা.) কে দেখতে পেয়ে আমরা খুশিতে প্রায় আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম এবং হজরত আবু বকর (রা.) কাতারে দাঁড়ানোর জন্য পেছন দিকে সরে আসছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন নবী (সা.) হয়তো নামাজে আসবেন। নবী (সা.) আমাদের ইশারায় বললেন যে, তোমরা তোমাদের নামাজ পূরণ করে নাও। এরপর তিনি পর্দা ফেলে দিলেন। সে দিনই তিনি ইন্তেকাল করেন।? (বোখারি : ৬৪৬)।

ইন্তেকালের আগে নবীজি (সা.) তার কলিজার টুকরা মেয়ে হজরত ফাতেমা (রা.)-এর কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এ সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, নবী (সা.) মৃত্যুর সময় ফাতেমা (রা.) কে ডেকে আনলেন এবং চুপেচুপে কিছু বললেন, তখন ফাতেমা (রা.) কেঁদে ফেললেন। এরপর নবী (সা.) পুনরায় তাকে ডেকে চুপেচুপে কিছু বললেন, তখন তিনি হাসলেন।? আমরা এই সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, নবী (সা.) যে রোগে আক্রান্ত আছেন, এই রোগেই তার ইন্তেকাল হবে। এ কথা তিনি গোপনে আমাকে বলেছেন। তখন আমি কাঁদলাম। আবার তিনি আমাকে চুপেচুপে বললেন, তার পরিজনের মধ্যে সর্বপ্রথম আমি তার সঙ্গে মিলিত হব। তখন আমি হাসলাম। (বোখারি : ৪৪৩৪)।

প্রচণ্ড অসুস্থ অবস্থার মধ্যেও তিনি উম্মতকে ভুলে যাননি। তাদের শেষবারের মতো উপদেশ দিয়েছেন। তার অবর্তমানে তার মোবারক কবরকে যেন কেউ মাজার বানিয়ে না ফেলে সে বিষয়ে সাবধান করেছেন। এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, অসুস্থ অবস্থায় সাহাবায়ে কেরামের একটি দল রাসুল (সা.)-এর ঘরে একত্র হলে তিনি সবার জন্য দোয়া করলেন এবং বললেন আমি তোমাদের অসিয়ত করছি তাকওয়া অর্থাৎ খোদাভীতি অর্জনের জন্য আর আল্লাহর বান্দাদের উপর অহংকারী হইও না। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের উপর আল্লাহর অভিশাপ। তারা নবীগণের কবরকে সেজদাগাহ বানিয়েছে। আমার মৃত্যুর পর ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মতো তোমরা আমার কবরকে সেজদাগাহ বানিও না। (বোখারি : ৪৪৪৩)। অন্য আরেকটি হাদিস এসেছে মৃত্যুর কিছুক্ষণ পূর্বে তিনি বলেন, তোমরা নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হও আর তোমাদের অধীনদের সঙ্গে দয়া ও ন্যায়ের আচরণ কর। (আবু দাউদ : ৫১৫৬)।

মহানবী মৃত্যুর আগে শুধু সাহাবায়ে কেরামকে উপদেশ দিয়ে ক্ষান্ত হননি, বরং তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। এটাই ছিল তার জীবনের শেষ প্রার্থনা। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি মৃত্যুর আগ মুহূর্তে রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছেন, নবীজি (সা.) তার বুকে হেলান দিয়েছিলেন আর তিনিও তার দিকে কান পেতে রেখেছিলেন। তখন নবীজি বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মাফ করো, দয়া করো এবং আমাকে আমার বন্ধুর সঙ্গে মিলিত করো। ( মুসলিম : ৬১৮৭)।

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে আরো বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আব্দুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.), (আয়েশা (রা.) এর ভাই একটি মেসওয়াক হাতে নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে (নবী (সা.)-এর অন্তিম অবস্থায়) তাঁর ঘরে প্রবেশ করলেন। নবী কারীম (সা.) তার দিকে তাকালেন। (আয়েশা (রা.) বলেন, আমি তাকে বললাম, হে আব্দুর রহমান! মেসওয়াকটি আমাকে দাও। সে আমাকে দিয়ে দিলো। অতঃপর আমি ব্যবহৃত অংশ ভেঙে ফেলে তা চিবিয়ে নবী কারীম (সা.) কে দিলাম। তিনি আমার বুকে হেলান দিয়ে তা দ্বারা মেসওয়াক করলেন। (বোখারি : ৮৯০)। হাদিসে আরো বলা হয়েছে মৃত্যুর আগে তিনি মেসওয়াক করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। মেসওয়াকরত অবস্থায় তিনি ঘামতে শুরু করেন। আর পাশে রাখা পানি দিয়ে পবিত্র মুখমণ্ডল মাসেহ করতে লাগলেন। হঠাৎ হাত থেকে মেসওয়াক পড়ে যায়। আর তখনই তিনি আল্লাহুম্মা রফিকাল আলা বলে সর্বোত্তম বন্ধু প্রভু ডাকে সাড়া দিয়ে পরকালে পাড়ি জমান। (বোখারি : ৪৪৪৯)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত