আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রত্যেক নবী-রাসুলকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দিয়ে প্রেরণ করেছেন। তাদের সবাইকে কমবেশি অলৌকিক কিছু ক্ষমতা প্রদান করেছেন। যেন নবুওয়াত ও রিসালাতের সত্যতার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সহজেই গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়ে যায়। এগুলোকে শাস্ত্রীয় ভাষায় নিদর্শন বা মুজিজা বলা হয় । রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সমগ্র জীবনে শত শত মুজিজা প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা ফুটে ওঠে এবং তিনি যে সত্য নবী তা প্রমাণিত হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য চারটি মুজিজা উল্লেখ করা হলো।
কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ মুজিজা :
পূর্ববর্তী নবী রাসুলগণের মুজিজাগুলো তাদের সময়ের সাথে খাস ছিল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) কে দেয়া আল কোরআন একটি চিরন্তন মুজিজা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত।? নবী কারিম (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক নবীকেই কোনো না কোনো বিশেষ নিদর্শন প্রদান করা হয়েছে। যার অনুরূপ তার উপর ঈমান আনা হয়েছে, কিংবা লোকেরা তার উপর ঈমান এনেছে। আর আমাকে যা দেয়া হয়েছে, সে হলো অহি, যা আল্লাহতায়ালা আমার ওপর অবতীর্ণ করেছেন। সুতরাং আমি আশা করি যে, কেয়ামতের দিন আমার অনুসারীর সংখ্যা তাদের তুলনায় সর্বাধিক হবে। (বোখারি : ৬৭৭৮)।
চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়া : একদা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে হঠাৎ করে মুশরিকরা এসে নবুওয়াতের নিদর্শন দেখতে চাইল। তখন ছিল চন্দ্রোজ্জ্বল রাত। আঙুলের ইশারায় তিনি চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করার সুস্পষ্ট অলৌকিক ঘটনা দেখিয়ে দিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মিনায় আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। এমতাবস্থায় হঠাৎ করে চন্দ্রবিদীর্ণ হয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। এক খণ্ড পাহাড়ের এপাশে পড়ল এবং অপর খণ্ড পড়ল পাহাড়ের ওপাশে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা সাক্ষী থাক। (মুসলিম : ৬৮১৫, তিরমিজি : ৩২৮৫)।
হুদাইবিয়ায় প্রকাশিত মুজিজা : ষষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসে ঐতিহাসিক সন্ধি সংঘটিত হয়। ওই সময় হুদাইবিয়া স্থানে রাসুল (সা.)-এর একটি আশ্চর্যকর মুজিজা প্রকাশ পায়। বারা ইবনে আজিব (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, তোমরা মক্কা বিজয়কে বিজয় রূপে গণ্য করে থাকো; কিন্তু আমরা হুদাইবিয়ায় সংঘটিত বাইয়াতে রিজওয়ানকে বিজয় হিসেবে গণ্য করি। আমরা ১৪০০ সাহাবী আল্লাহর রাসুলের সঙ্গে এই ঘটনাস্থলে ছিলাম। হুদাইবিয়া নামক একটি কূপ ছিল। আমরা ওই কূপ থেকে আমাদের প্রয়োজন মতো পানি নিতে শুরু করি। অল্পক্ষণ পরে ওই কূপের সমস্ত পানি শুকিয়ে যায়। এক ফোটা পানিও অবশিষ্ট ছিল না। কূপের পানি শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত রাসুলের কানেও পৌঁছে। তিনি কূপের কাছে এসে তার ওপর বসে পড়েন। অতঃপর এক বালতি পানি চেয়ে নিয়ে অজু করেন। এরপর তিনি কুলি করেন। তারপর দোয়া করেন এবং ওই পানি ওই কূপে ফেলে দেন। অল্পক্ষণ পরে আমরা দেখলাম কূপটি সম্পূর্ণরূপে পানিতে ভরে গেছে। ওই পানি আমরা নিজেরা পান করলাম। আমাদের সাওয়ারি উটগুলোকে পান করালাম। নিজেদের প্রয়োজন পুরা করলাম এবং পাত্রগুলো পানিতে ভরে নিলাম (ফাতহুল বারী : ৭/৫০৫)।
এক পেয়ালা দুধ : রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম দীনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম ও অসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বিশেষ করে আবু হুরায়রা (রা.) ইলম অন্বেষণের পেছনে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। এক পেয়ালা দুধ নিয়ে তার সঙ্গে প্রকাশিত হয় বিশেষ একটি মুজিজা। আবু হুরায়রা (রা.) বলতেন, আল্লাহর কসম! যিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। আমি ক্ষুধার জ্বালায় আমার পেটকে মাটিতে রেখে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতাম। আর কোনো সময় ক্ষুধার জ্বালায় আমার পেটে পাথর বেঁধে রাখতাম। একদিন আমি ক্ষুধার যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে নবী কারিম (সা.) ও সাহাবীগণের বের হওয়ার পথে বসে থাকলাম। অতঃপর আবু বকর (রা.) যেতে লাগলে আমি কোরআনের একটা আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি তাহলে আমাকে পরিতৃপ্ত করে কিছু খাওয়াবেন। কিন্তু তিনি চলে গেলেন। কিছু করলেন না। কিছুক্ষণ পর উমর (রা.) যাচ্ছিলেন। আমি তাকে কোরআনের একটি আয়াত সম্বন্ধে প্রশ্ন করলাম। এ সময়ও আমি প্রশ্ন করলাম এ উদ্দেশ্যে যে, তিনি আমাকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়াবেন। কিন্তু তিনি চলে গেলেন। আমার কোনো ব্যবস্থা করলেন না। তার পরক্ষণে আবুল কাসিম (সা.) যাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে দেখেই মুচকি হাসলেন এবং আমার মধ্যকার অস্থিরতা বিরাজমান এবং আমার চেহারার অবস্থা থেকে তিনি তা আঁচ করতে পারলেন। তারপর বললেন, হে আবু হুরায়রা! আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি হাজির আছি। তিনি বললেন, তুমি আমার সঙ্গে চলো। এ বলে তিনি চললেন, আমিও তার অনুসরণ করলাম। তিনি ঘরে ঢুকবার অনুমতি চাইলেন এবং আমাকেও ঢুকবার অনুমতি দিলেন। তারপর তিনি ঘরে প্রবেশ করে একটি পেয়ালার মধ্যে কিছু পরিমাণ দুধ পেলেন। তিনি বললেন, এ দুধ কোথা থেকে এসেছে? তারা বললেন, এটা আপনাকে অমুক পুরুষ অথবা অমুক মহিলা হাদিয়া দিয়েছে। তখন তিনি বললেন, হে আবু হুরায়রা! আমি বললাম, লাব্বাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ! তিনি বললেন, তুমি সুফফাবাসীদের কাছে গিয়ে তাদের আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো।
রাবী বলেন, সুফফাবাসীরা ইসলামের মেহমান ছিলেন। তাদের কোনো পরিবার ছিল না এবং তাদের কোনো সম্পদ ছিল না এবং তাদের কারো উপর নির্ভরশীল হওয়ারও সুযোগ ছিল না। যখন কোন সাদকা আসত, তখন তিনি তা তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। তিনি এর থেকে কিছুই গ্রহণ করতেন না। আর যখন কোনো হাদিয়া আসত, তখন তার কিছু অংশ তাদের দিয়ে দিতেন এবং এর থেকে নিজেও কিছু রাখতেন। এর মধ্যে তাদের শরীক করতেন- এ আদেশ শুনে আমার মনে কিছুটা হতাশা এলো। মনে মনে ভাবলাম যে, এ সামান্য দুধ দ্বারা সুফফাবাসীদের কি হবে? এ সামান্য দুধ আমার জন্যই যথেষ্ট হতো। এটা পান করে আমি শরীরে কিছুটা শক্তি পেতাম। এরপর যখন তারা এসে গেলেন, তখন তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন যে, আমিই যেন তা তাদের দেই, আমার আর আশা রইল না যে, এ দুধ থেকে আমি কিছু পাব। কিন্তু আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশ না মেনে কোন উপায় নেই। তাই তাদের কাছে গিয়ে তাদের ডেকে আনলাম। তারা এসে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইলে তিনি তাদের অনুমতি দিলেন। তারা এসে ঘরে আসন গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, হে আবু হুরায়রা! আমি বললাম, আমি হাজির ইয়া রাসুলাল্লাহ! তিনি বললেন, তুমি পেয়ালাটি নাও আর তাদের দাও। আমি পেয়ালা নিয়ে একজনকে দিলাম। তিনি তা পরিতৃপ্ত হয়ে পান করে পেয়ালাটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। আমি আরেকজনকে পেয়ালাটি দিলাম।
তিনিও পরিতৃপ্ত হয়ে পান করে পেয়ালাটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। এমন কি আমি এরূপে দিতে দিতে নবী কারিম (সা.) পর্যন্ত পৌঁছলাম। তারা সবাই তৃপ্ত হয়েছিলেন। তারপর নবী কারিম (সা.) পেয়ালাটি নিজ হাতে নিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। আর বললেন, হে আবু হুরায়রা ! আমি বললাম, আমি হাজির ইয়া রাসুলাল্লাহ! তিনি বললেন, এখন তো আমি আর তুমি আছি। আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি ঠিক বলছেন। তিনি বললেন, এখন তুমি বসে পান কর। তখন আমি বসে কিছু পান করলাম। তিনি বললেন, তুমি আরো পান করো। আমি আরো পান করলাম। তিনি বারবার আমাকে পান করার নির্দেশ দিতে লাগলেন। এমন কি আমি বলতে বাধ্য হলাম যে, আর না। যে সত্তা আপনাকে সত্য ধর্মসহ পাঠিয়েছেন, তার কসম! (আমার পেটে) আর পান করার মত জায়গা আমি পাচ্ছি না। তিনি বললেন, তাহলে আমাকে দাও। আমি পেয়ালাটি তাকে দিয়ে দিলাম। তিনি আলহামদুলিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ বলে বাকিটা পান করলেন। (বোখারি : ৬০০৮)।
লেখক : কবি ও শিক্ষক