ঢাকা ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হিলফুল ফুজুল : সমাজ গঠনের প্রথম ধাপ

মুফতি উবাইদুল্লাহ তারানগরী
হিলফুল ফুজুল : সমাজ গঠনের প্রথম ধাপ

সুস্থ, সুন্দর, নিরাপদ, পৃথিবী গঠন করেছিলেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)। তাঁর দেখানো পথেই রয়েছে মানবতার মুক্তি। তাঁর আদর্শেই রয়েছে শান্তি। মানবজীবনের যে কোন পরিস্থিতিতে যে কোনো সংকটে সমাধান রয়েছে নবীর সীরাতে। মানুষ জয়ের মালা পড়ুক বা পরাজয়ের গ্লানি ভোগ করুক, তার উপর কেউ আধিপত্য বিস্তার করুক বা সে কারো উপর আধিপত্য বিস্তারে সফল হোক, প্রাচুর্যের মালিক হোক বা রিক্তহস্ত, পরিবারের সঙ্গে হোক বা অপরিচিতের সঙ্গে, বন্ধুদের আড্ডায় হোক বা চরম শত্রুর কব্জায়, সর্বাবস্থায় সর্বক্ষেত্রে নবীজির সীরাত হলো চলার পথের আলোকবর্তিকা ও পরম রাহবার। আল্লাহতায়ালা বলেন; যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রয়েছে রাসুলের মধ্যে উত্তম নমুনা। (সুরা আহজাব, আয়াত : ২১)। বৈষম্যহীন সমাজ কিংবা সুন্দর পৃথিবী আকাশ থেকে নাজিল হয় না, মাটি ফুঁড়েও বের হয় না। অধিবাসীদের সৎ ও সুন্দর চরিত্রবান হতে হয়। তাহলেই পৃথিবী হয় শান্তিময়, গঠিত হয় ইনসাফভিত্তিক সুন্দর সমাজ। নবীজি (সা.) জীবনের মধ্যবয়স থেকেই শুধু ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী ছিলেন না বরং তাঁর বয়স যখন ১৫-১৬-১৭ ইবনে ইসহাক মতে ২০, মতান্তরে ২৫, তখনই তিনি একটি 'শান্তি সংঘ' গঠন করেন। যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জাহেলি যুগের সব অপকর্ম ও যুদ্ধবিগ্রহ জুলুমণ্ডনির্যাতন অরাজকতা বন্ধ করে সুশৃঙ্খল পৃথিবী গড়া। নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় যা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। সেই সংগঠনের নাম হলো; হিলফুল ফুজুল। সমাজপতি বিত্তবান আব্দুল্লাহ বিন জুদআনের বাড়িতে গোত্রের বিশিষ্ট নেতাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল সংঘটি।

হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠার নেপথ্য লক্ষ্য-উদ্দেশ্য

১. দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। ২. বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করা। ৩. অত্যাচারিতকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করা। ৪. দুর্বল, অসহায় ও এতিমদের সাহায্য করা। ৫. বিদেশি বণিকদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ৬. সর্বোপরি সব ধরনের অন্যায়-অবিচার অবসানের দৃঢ় সংকল্প। এই চুক্তি ও সংগঠনের গুরুত্ব বুঝাতে একবার নবী (সা.) বলেন, ‘আমি আবদুল্লাহ বিন যা‘দানের ঘরে (যেখানে ‘হিলফুল ফুযূল’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল) এমন একটি চুক্তিতে শরীক ছিলাম, যার মূল্য আমার কাছে লাল উটনীর চেয়েও বেশি। এই ইসলামের যামানায়ও যদি সেই চুক্তি ও অঙ্গীকার পূরণের জন্য ডাকা হয় তাহলেও আমি লাববাইক বলব।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৬৫৫)। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান মূল লক্ষ্য হলেও ‘শান্তি মিশন’ গঠনের প্রেক্ষাপট ছিল অসহায় এক পাওনাদারের পাওনা বুঝিয়ে দেয়াকে কেন্দ্র করে। বনী যাবীদ বা যুবাইদ গোত্রের এক লোক মক্কা নগরীতে এসে মক্কার প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী আস বিন ওয়াইল সাহমির কাছে ব্যবসায়িক পণ্য বিক্রি করে। আস ক্রয়কৃত পণ্যের মূল্য আদায়ে বিভিন্ন বাহানা ও গড়িমসি করতে থাকে। একপর্যায়ে সে মূল্য আদায়ে অস্বীকার করে বসে। অনেক অনুনয় বিনয় করেও অর্থ আদায় করা গেল না। অতঃপর সে আহলাফ গোত্রের আবদুদ্দার, মাখজুম, জুমাহ, সাহাম ও আদি বিন কাবের এর কাছে গিয়ে অর্থ উদ্ধার করে দিতে তাঁদের সাহায্য প্রার্থনা করল। কথায় আছে না!শক্তের ভক্ত নরমের যম। তাঁরা আসের বিত্ত ও প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে ওই অসহায় ব্যবসায়ীকে সাহায্য তো করলোই না বরং উল্টো তাকেই প্রাণনাশের হুমকি দিল। এমন অসহায় পরিস্থিতিতে জুবাইদ গোত্রের ব্যবসায়ী হতাশ হয়ে পড়ে। পরদিন সূর্যোদয়ের সময় তিনি আবু কুবাইস পাহাড়ে চড়ে উচ্চকণ্ঠে একটি কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল। সে সময় কুরাইশ নেতারা কাবার আঙিনায় বসা ছিলেন। শলাপরামর্শ করছিলেন।

কবিতাটি ছিল এ রকম-

হে আলে ফিহর (কুরাইশ)! এ মজলুমকে সাহায্য করো!

যার ব্যবসায়িক পণ্য ছিনতাই করে নেয়া হয়েছে।

‘সে এখানে ভিনদেশি!/ নিজ বন্ধু–স্বজন থেকে অনেক দূরে।/ সে ইহরাম বেঁধে আছে অথচ সে পেরেশান!/ এখনো ওমরা পূর্ণ করতে পারেনি।/হে হাজরে আসওয়াদ ও হাতিমে আগমনকারী লোকেরা!/ আমাকে সাহায্য করো! / মান-সম্মান শুধু ওই ব্যক্তির, যার কর্ম ভালো হয়।/প্রতারক ও মন্দলোকের চাদরের কোনো সম্মান নেই।’ তাঁর আর্ত ফরিয়াদ শুনে জুবাইর বিন আবদুল মুত্তালিব তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘এই মজলুমকে কি এমন অসহায় ও নিরুপায় ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে? স্বমস্বরে সবাই না বলল। অতপর, বিভিন্ন গোত্রের বিভিন্ন নেতাগণ আব্দুল্লাহ বিন জুদআনের ঘরে সমবেত হয়ে উপরে উল্লেখিত কর্মসূচি অনুযায়ী চুক্তি করেন। যা ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে খ্যাত। যার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন নবীজির চাচা যুবায়ের ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। এর নামকরণের কারণ হলো- কুরায়শের আগে জুরহুম গোত্রও এধরনের একটি সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলো। যাদের তিনজনের নামই ছিল ফজল। এর সাদৃশ্য অবলম্বনেই ‘হিলফুল ফুজুল’ নাম রাখা হয়। (সীরাতে ইবনে কাসীর, ১/২৫৭-৫৯)। সীরাতে মুস্তফায় (১ম খণ্ড ১২৩পৃ.) নামগুলো এসেছে; ফজল ইবনে ফুজালাহ, ফজল ইবনে ওয়াদা'আহ, ফুজাইল ইবনে হারিছ) চুক্তির অন্যতম লক্ষ্য ছিল ব্যবসায়িক নিরাপত্তা, ছোট ব্যবসায়ীকে বড় ব্যবসায়ী কর্তৃক জুলুমণ্ডনির্যাতন বন্ধ করা, ওঁতপেতে থাকা ডাকাতদের হামলা থেকে বণিকদের বাঁচানো, অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো। এই চুক্তিতে শরীক ছিলেন বনী হাশিম, বনী আব্দুল মুত্তালিব, আসাদ বিন আব্দুল উজ্জাহ, যুহরাহ বিন কালব এবং তামিম বিন মুররাসহ নানা গোত্র।

(তথ্যসূত্র: সীরাতে ইবনে হিশাম, সীরাতে মুস্তফা, নবীয়ে রহমত, প্রিয় নবীর প্রিয় সীরাত, আররাহীকুল মাখতুম)।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ইবনে আব্বাস (রা.) সামান্তপুর, জয়দেবপুর, গাজীপুর সিটি

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত