স্মৃতিকথা

স্মৃতিতে অমলিন ফজিলাতুল কদর

শামীম ফাতেমা মুন্নী

প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবীর অলিখিত নিয়ম, চোখের আড়াল হলেই ভুলে যাওয়া; কিন্তু আসলেই কি ভোলা যায়? হয়তো সাড়ম্বরে স্মরণ করা যায় না পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতায়, কিন্তু নীরবে নিঃশব্দে স্মৃতিতে আসা-যাওয়া তাঁর অশ্রুত প্রার্থনায় প্রতিনিয়ত। বুকের গভীরে কিছু মায়াকষ্ট নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মত বইতে থাকে আমরণ একান্ত আপন হয়ে- এটা তেমনই এক মায়াকষ্ট আমাদের।

বেগম ফজিলাতুল কদর আমার শ্রদ্ধেয়া নানী, যাকে আমি ডাকতাম সোনাবন্ধু বলে। আপন যোগ্যতা ও গুণ-গরিমায় যিনি এককালে হাসনাহেনা ফুলের সুবাস ছড়িয়ে চট্টগ্রামের সাহিত্য অঙ্গনে হয়ে উঠেছিলেন অনন্যা, ঐশ্বর্যময়ী, সুবাসিত হয়েছিলেন স্রষ্টাপ্রেমে ‘ঐশী প্রেমের কবি’ রূপে।

মহাকালের মায়াচক্রে হারিয়ে ফেলেছি অনেককে- একান্ত আপন প্রিয় কিছু মুখ, যাদের মমতা ও ভালোবাসা আজো মিশে আছে আমার নিঃশ্বাসে উচ্ছ্বাস হয়ে। অনেক কিছুই নেই, সময়ের করাল গ্রাসে আজ! বেগম ফজিলাতুল কদর- আমার নানু, যাকে আমি সোনাবন্ধু বলে ডাকতাম, তার ছোট্ট মুনিয়া পাখি ছিলাম আমি। তার নিজের পরিচয়ে তিনি পরিচিত সবখানে, চট্টগ্রামের সাহিত্যাঙ্গনে ঐশী কবি বলে খ্যাত বেগম ফজিলাতুল কদর এর জন্মদিন ৮ সেপ্টেম্বর।

মৃত্যুদিন আমি মনে রাখি না, জানি আপন মানুষ কখনো হারায় না, বটবৃক্ষ রূপে থেকে যায় আত্মার অংশ হয়ে হৃদয়ের অভয়ারণ্যে। আর তাই জন্মদিন মনে রাখি মায়াডোরে বেঁধে অতলান্ত ভালোবাসায়। আল্লাহপাক তোমাকে, নানাজানকে, প্রিয় মুখগুলোকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন, আমীন। চোখের আড়ালে চলে গেছ, তবে হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত হয়ে আছো আমাদের সবার। শুভ জন্মদিন সোনাবন্ধু আমার...জীবনের আলো আঁধারি ধাঁধায় তোমারেই চিনেছি, তোমাকেই জেনেছি, তোমারি আঁচল বেঁধে রেখেছি অদ্ভুত সুবাসে হাতের মুঠোয়...! আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখে মহান স্রষ্টার কাছে আর্জি দিয়েছি, জান্নাতি সুবাসে সুবাসিত রাখুন তোমাকে তিনি।

বুকজুড়ে থাকো তুমি, শুধু তোমাকে ভালোবাসি

তুমি নেই, তোমার প্রকাশিত বইগুলোর অধিকাংশ আছে পরম যতনে আমার কাছে, তোমার ছোঁয়া পাই, তোমার কবিতায় তোমাকেই খুঁজে ফিরি। ৮ সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন। ভাগ্যক্রমে নানা-নানীর সংস্পর্শে আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে, আমার শিক্ষার বুনিয়াদের ভিত্তি তিনি- আমার নানী। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, উনি সমস্ত কাজের ফাঁকে, ইবাদতের ফাঁকে সময় পেলেই লিখতেন; কিন্তু লেখা পর্যন্তই শেষ, প্রকাশে যত অনীহা তার। একসময় আমি ও একটু আধটু তার সংস্পর্শে লেখতে শিখলাম, ছন্দ মেলাতে শিখলাম, অনুভব করলাম লেখার মাঝে একটা নিভৃত আপন ভুবন আছে, যার সৃষ্টির আনন্দ সারাদিন মনে ছুঁয়ে থাকে, যা একান্ত নিজের ভালোলাগা! একসময় তার লেখাগুলো গুছিয়ে আমি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পাঠাতে উৎসাহিত করলাম। তিনি সর্বপ্রথম যে লেখা শুরু করেন তা হচ্ছে- আল কোরআনের সুরাসমূহের কাব্যে ভাবানুবাদ।

তিনি সুরা ফাতেহা, সুরা বাকারা, সুরা আল ইমরান, সুরা নিছা এই চারটি সুরারই কাব্যে ভাবানুবাদ করেন যা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সংগ্রামে প্রতি শনিবার। তার রচিত ‘স্ত্রী লোকের হজ’ বইটিও ধারাবাহিকভাবে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও জাতীয় দৈনিক যেমন-দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক দেশকাল, দৈনিক আজাদী, দৈনিক পূর্বকোণ, দৈনিক নয়াবাংলা, দৈনিক পূর্বতারা, সাপ্তাহিক বেগম, মাসিক সাম্পান, সবুজপাতা, ময়ূরপঙ্খি, আলমদীনা, আততাওহীদ, দ্বীন দুনিয়া এমন অসংখ্য পত্র-পত্রিকায় স্বনামে বেনামে প্রচুর লেখা প্রকাশিত হয়েছে নিয়মিত। কখনো পুরস্কারের জন্য লিখেননি তিনি, মনের খোরাকের জন্য লিখে যেতেন। এই সমাজের ব্যর্থতা- আমরা প্রকৃত মেধাকে মূল্যায়ন করতে পারি না যথা সময়ে।

বেগম ফজিলাতুল কদরের প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো- স্মৃতিতে গোলাপ (গল্প গ্রন্থ) বাণীতে নিহিত শান্তি (কাব্যগ্রন্থ),তারা ফুল(কাব্যগ্রন্থ) (দুই খণ্ড) (হীরা জহরত মুক্তা পান্না (কাব্য গ্রন্থ), ঐশী ভালোবাসা (কাব্য গ্রন্থ), শতদলে ফোটে মুগ্ধ হৃদয় (দুই খণ্ডে কাব্য গ্রন্থ), হাজার কবিতা (কাব্য গ্রন্থ), আমার টেবিলে একগুচ্ছ হাস্নাহেনা (কবিতা গ্রন্থ), নীলা চৌধুরীর কবিতা (কবিতা গ্রন্থ), শুভা চৌধুরীর ছড়া (শিশুতোষ ছড়া গ্রন্থ), মন উড়ে যায় পাখির সাথে (শিশুতোষ ছড়া গ্রন্থ), স্ত্রী লোকের হজ্ব (নারী শিক্ষা মূলক গ্রন্থ), সুরা আল বাকারার কাব্যানুবাদ ইত্যাদি।

ফরিদপুর জেলার নীলকমল গ্রামে ১৯৩৩ সালে ৮ সেপ্টেম্বর এক খানদানী পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দাদা আব্দুল জব্বার ছিলেন ফারায়েজী আন্দোলনের নেতা। পিতা এম আবদুল্লাহ (এম.এ.), মাতা খাদিজা দেওয়ান।

শৈশব থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি পিতার চাকরিসূত্রে পিতার সাথে নানাদেশ ভ্রমণ করে কলকাতায় বসবাস করেন কিছুদিন। দেশবিভাগের পর আপনগ্রামে ফিরে আসলে চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার বিয়ে হয় আলহাজ বাদশা মিয়া চৌধুরীর সাথে। চার কন্যা ও তিন পুত্র নিয়ে বিশাল একান্নবর্তী সংসারের কর্ণধার ছিলেন তিনি। জন্মের পর আরো দুই পুত্র সন্তান তাঁর মারা যায় শৈশবেই, তাদের কথা ভুলতে পারেননি তিনি কখনো।

একজন কর্মীর জীবনালেখ্য তার কর্মেই পাওয়া যায়। কর্মের সফলতাই তার সাফল্য, তার সার্থকতা, তার সৌরভ, তার গৌরব। মানুষ ব্যক্তিগত পরিচয়ে অমরত্ব লাভ করে না, অমরত্ব আসে তার কর্মে। বেগম ফজিলাতুল কদরের ক্ষুরধার লেখনীতে ফুটে উঠতো, ঐশীপ্রেম, রাসুল (সা.)-এর মুহাব্বত, দেশপ্রেম, মানবপ্রীতি, সমাজের অসঙ্গতি, প্রতিচ্ছবি। এই লেখনীই তাকে দিয়েছে অনন্য এক জীবন পরিচিতি। আত্মপ্রচার বিমুখ, নির্জনতাপ্রিয়, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ঐশ্বর্যময়ী এই নারী, নীলকমল গ্রামের বারার আদরের হেনা, আট ভাই-বোনের বুবু সীমানা পেরিয়ে তার আপন গুণে সুঘ্রাণ ছড়িয়ে হয়ে উঠেছিলেন আমাদের কারো নানী, দাদী, কারো মা, খালাম্মা, কারো বুবু, কারো আপা, স্বামীর একনিষ্ঠ স্ত্রী, আমার সোনাবন্ধু। চট্টগ্রামের এখনকার প্রতিষ্ঠিত অনেক প্রথিতযশা সামাজিক ব্যক্তিত্ব, স্বনামধন্য সাহিত্যিক তার স্নেহধন্য হয়েছেন।

অনলস-পরিশ্রমী এবাদতে, লেখনীতে, পরিবার ও সমাজের প্রতি কর্তব্যপালনে নিষ্ঠাবান অসম্ভব মায়াবতী বেগম ফজিলাতুল কদর অজ্ঞতার আঁধার থেকে চট্টগ্রামের নারী সমাজকে জ্ঞানের অনির্বাণ ঐশী আলোয় আনার জন্য চট্টগ্রামের আরো কয়েকজন নারী একত্র করে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত করেন চট্টগ্রাম মহিলা ইসলামী পাঠাগার, যে প্রতিষ্ঠান আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে নিজস্ব ভবনে উত্তরসূরিদের কর্মতৎপরতায় সগৌরবে, তিনি তার প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী। তিনি বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব, লেখিকাসংঘ, চট্টগ্রাম একাডেমি, মা ও শিশু হাসপাতাল, ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং আরো অনেক দাতব্য সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।

৮ সেপ্টেম্বর বেগম ফজিলাতুল কদরের জন্মদিন এবং বিয়েবার্ষিকী ও একই তারিখে। নানাজান বেঁচে থাকতে আমরা নাতি-নাতনীরা খুব ঘটা করে দিনটি পালন করতাম। ২০০৩ সালে মহীরুহ নানাজান ইন্তেকাল করেন। তারপর নানী ছিলেন আমাদের বটবৃক্ষ, আমাদের বাতিঘর। কারণ তিনি তেমন করেই আগলে রেখেছিলেন সবাইকে, সবকিছুকে আমৃত্যু।

২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর সোনাবন্ধু ইন্তেকাল করেন, আঁকাবাঁকা পথের শেষে সবুজের ছায়ায় বোয়ালখালীর পারিবারিক কবরস্থানে নানাজানের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। আপাদমস্তক কালো বোরখা এবং কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিতা সদা হাস্যময়ী সেই চিরপরিচিত ছবিটি তার নামের (হাসনাহেনা) সুবাস লুকোতে পারেনি, ছড়িয়ে গেছে সবার অন্তরে। হাসনাহেনা ফুলের মনপাগল করা সৌরভ তাই আজো আমাদের কাঁদায়, আমাদের হাসায়, স্মৃতির উত্তাল জোয়ারে ভাসায়। জীবনের জোয়ার-ভাটায় গড়িয়েছে সময়ের জল। একে একে হারিয়েছে অনেক প্রিয় মুখ, প্রিয় স্বজন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের সবাইকে জান্নাতি বাগিচার বুলবুল বানিয়ে রাখুন- আমিন।