ঢাকা ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সন্তানের প্রতি নবীজির ভালোবাসা

শরিফ আহমাদ
সন্তানের প্রতি নবীজির ভালোবাসা

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সর্বমোট তিন পুত্র ও চারকন্যা ছিল। দুই ছেলে ও চারকন্যা ছিল খাদিজা (রা.)-এর গর্ভজাত। ছেলেদের নাম কাসেম (রা.) ও তাহের (রা.)। আর মেয়ে চারজন হলেন- ফাতেমা (রা.), জয়নাব (রা.), রুকাইয়া (রা.) ও উম্মে কুলসুম (রা.)। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তৃতীয় ছেলের নাম ছিল ইব্রাহিম (রা.)। তিনি মারিয়া কিবতিয়া (রা.)-এর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। রাসুল (সা.) ছিলেন একজন আদর্শ পিতা। তিনি সন্তানদের প্রতি ভালোবাসার সর্বোচ্চ নমুনা স্থাপন করেছেন। পৃথিবীর সমস্ত পুরুষদের জন্য সবক রেখে গেছেন। তাই সকলের এ ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া উচিত।

ছেলের প্রতি নবীর ভালোবাসা : রাসুলুল্লাহ (সা.) সকল ছেলেমেয়েদের প্রতি আন্তরিক ছিলেন। আপন সন্তানদের হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসায় লালন পালন করেছেন। পুত্র ইব্রাহিমের জন্ম হলে আবু সাইফ (রা.)-এর স্ত্রীর হাতে দুধ পান করানোর জন্য সোপর্দ করা হয়। তাদের বাড়ি মদিনার দূরবর্তী অঞ্চলে হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিয়মিত সন্তানের খোঁজখবর রাখতেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে শিশুদের প্রতি বেশি দয়া প্রদর্শনকারী কাউকে আমি দেখিনি। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ছেলে ইবরাহীম (রা.) মদিনার আওয়ালী (চড়াই) অঞ্চলে দুধপান করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) সেখানে যেতেন। আমরাও তার সঙ্গে যেতাম। তিনি সে (দাইয়ের) ঘরে প্রবেশ করতেন, আর সেখানে ধোঁয়া হতো। কেননা, তার বংশ কর্মকার ছিল। তিনি ছেলেকে কোলে নিতেন এবং স্নেহ করতেন। পরে তিনি ফিরে আসতেন। আমর ইবনে সাঈদ (রা.) বলেন, যখন ইবরাহীম (রা.) ইন্তেকাল করেন তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইবরাহীম আমার পুত্র, দুধপান করা অবস্থায় ইন্তেকাল করেছে। তার জন্য দু’জন ধাত্রী রয়েছে, যারা জান্নাতে তাকে দুধপান (করার সময়সীমা পর্যন্ত) দুধপান করাবে। (মুসলিম : ৫৮১৯)।

ছেলে ইব্রাহিমের জন্য কান্না : রাসুলুল্লাহ সা.)-এর তিন ছেলে বাল্য অবস্থায়ই ইন্তিকাল করেন। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় একমাত্র কাসেম (রা.) সওয়ারীর উপর আরোহণ করতে পারার মতো বয়সে উপনীত হয়েছিলেন। ইব্রাহিম (রা.)-এর ইন্তেকালে রাসুল (সা.) নিঃশব্দে কান্না করেছেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে আবু সাইফ কর্মকারের কাছে গেলাম। তিনি ছিলেন (নবী তনয়) ইবরাহীম (রা.)-এর দুধ সম্পর্কীয় পিতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে তুলে নিয়ে চুমু খেলেন এবং তাকে নাকেমুখে লাগালেন। এরপর (আর একদিন) আমরা তার (আবু সাইফ এর) বাড়িতে গেলাম। তখন ইবরাহীম (রা.) মুমূর্ষু অবস্থায়। এতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উভয় চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। তখন আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আর আপনিও (কাঁদছেন?) তখন তিনি বললেন, ইবনে আওফ! এ হচ্ছে মায়া-মমতা। তারপর পুনঃবার অশ্রু ঝরতে থাকল, এরপর তিনি বললেন, অশ্রু প্রবাহিত হয় আর হৃদয় হয় ব্যথিত। তবে আমরা মুখে তাই বলি যা আমাদের রব পছন্দ করেন। আর হে ইবরাহীম! তোমার বিচ্ছেদে আমরা অবশ্যই শোকাভিভূত। (বোখারি : ১২২৫)।

জয়নাব (রা.) এর প্রতি ভালোবাসা : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বড় মেয়ে জয়নাব (রা.)। আবুল আস ইবনে রবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। হিজরতের সময় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাই বদরযুদ্ধে অন্যদের সাথে তিনিও বন্দি হন। জয়নাব (রা.) তাকে মালের বিনিময়ে মুক্তির চেষ্টা করেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন মক্কাবাসীরা তাদের বন্দিদের জন্য মুক্তিপণ পাঠায়, তখন জয়নাব (রা.) আবুল আসের (তার স্বামী যিনি কাফের ছিলেন ও বদর যুদ্ধে বন্দি হন) জন্য মুক্তিপণ বাবদ এমন কিছু ধন-সম্পদ পাঠায়, যার মধ্যে একটি হারও ছিল। আসলে হারটি ছিল খাদিজা (রা.)-এর। (জয়নাব বিয়ের সময় তা হাদিয়া হিসাবে পান) এবং তা নিয়ে আবুল আসের ঘরে গমন করেন। আয়েশা (রা.) বলেন, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) এই হারখানা দেখেন, তখন তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং বলেন, যদি তোমরা ভালো মনে করো, তবে জয়নাবের স্বামীকে ছেড়ে দাও এবং তার হারখানাও তাকে ফিরিয়ে দাও। তখন তারা (সাহাবারা) বলেন, ঠিক আছে, তাই হবে। এরপর রাসুলুল্লাহ্ (সা.) এই মর্মে আবুল আসের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন যে, সে জয়নাবকে তার নিকট আসতে বাধা দেবে না। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) জায়েদ ইবনে হারিসা ও অপর একজন আনসার সাহাবীকে এই মর্মে নির্দেশ দিয়ে পাঠান যে, তোমরা বাতনে ইয়াজিজ নামক স্থানে জয়নাবের জন্য অপেক্ষা করবে, যতক্ষণ না সে তোমাদের কাছে আসে। আর সে তোমাদের কাছে পৌঁছলে তোমরা তাকে সাথে করে আমার কাছে পৌঁছে দেবে। (আবু দাউদ : ২৬৮৩)।

রুকাইয়া (রা.) এর প্রতি ভালোবাসা : রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দ্বিতীয় কন্যা রুকাইয়া (রা.)। তিনি উসমান গনি (রা.)-এর পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। হাবশায় তার সাথে হিজরত করেছিলেন। পরবর্তীতে দ্বিতীয় হিজরীতে বদর যুদ্ধের সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তার সেবা-শুশ্রুষার জন্য উসমান (রা.) কে যুদ্ধে না গিয়ে মদিনায় থাকার নির্দেশ দেন। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, উসমান (রা.) বদর যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। কেননা, রাসুল (সা.)-এর কন্যা ছিলেন তার সহধর্মিণী আর তিনি ছিলেন পীড়িত। তখন রাসুল (সা.) তাকে বললেন, বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীর সমপরিমাণ সওয়াব ও (গনীমতের) অংশ তুমি পাবে। (বোখারি : ২৯১০)।

উম্মে কুলসুম (রা.) এর জন্য কান্না : রুকাইয়া (রা.) ইন্তেকালের পর তৃতীয় হিজরিতে রাসুল (সা.) উম্মে কুলসুম (রা.) কে উসমান গনি (রা.)-এর সাথে বিবাহ দেন। এ কারণেই তার উপাধি জিন নুরাইন। নবম হিজরীতে উম্মে কুলসুম (রা.) ইন্তেকাল করেন। মেয়ের বিয়োগ ব্যথায় তখন রাসুল (সা.)-এর চোখে পানি টলমল করছিল। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসুল (সা.)-এর এক কন্যা উম্মে কুলসুম (রা.)-এর জানাজায় উপস্থিত হলাম। রাসুল (সা.) তার কবরের পাশে বসেছিলেন। আনাস (রা.) বলেন, তখন আমি তার চোখ থেকে পানি ঝরতে দেখলাম। রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে, যে আজ রাতে স্ত্রী মিলন করেনি? আবু তালহা (রা.) বললেন, আমি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তাহলে তুমি (কবরে) অবতরণ কর। তখন তিনি তার কবরে অবতরণ করলেন। (বোখারি : ১২১০)।

ফাতেমা (রা.) এর প্রতি ভালোবাসা : ফাতেমা (রা.) রাসুল (সা.)-এর মেয়েদের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন। তার বিবাহ ১৫ বছর সাড়ে ৫ মাস বয়সে আলী (রা.)-এর সাথে সম্পন্ন হয়। তার মাধ্যমেই রাসুল (সা.) বংশধারা পৃথিবীতে টিকে আছে। তিনি পিতার অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ফাতিমা (রা.)-এর চাইতে আর কাউকে কথা-বার্তায় ও চাল-চলনে রাসুল (সা.)-এর সাথে অধিক মিল দেখিনি। যখন তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছে আসতেন, তখন তিনি দাঁড়িয়ে তাকে চুমা দিতেন এবং তার হাত ধরে নিজের আসনে বসাতেন। একইভাবে যখন নবী কারিম (সা.) তার কাছে যেতেন, তখন তিনি দাঁড়িয়ে তাকে চুমা দিতেন এবং হাত ধরে তাকে নিজের আসনে বসাতেন। (আবু দাউদ : ৫১২৭) রাসুল (সা.) ইন্তেকালের পর আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে তিনিই প্রথম ইন্তেকাল করেছেন। এই সুসংবাদ তিনি পিতার থেকে পেয়েছেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী কারিম (সা.)-এর চলার ভঙ্গিতে চলতে চলতে ফাতেমা (রা.) আমাদের নিকট আগমন করলেন। তাকে দেখে নবীজি বললেন, আমার স্নেহের কন্যাকে অনেক অনেক মোবারকবাদ। তারপর তাকে তার ডানপাশে অথবা বামপাশে বসালেন এবং তার সাথে চুপিচুপি (কি যেন) কথা বললেন। তখন তিনি কেঁদে দিলেন। আমি আয়েশা (রা.) তাকে বললাম, কাঁদছেন কেন? নবী কারীম (সা.) পুনরায় চুপিচুপি তার সাথে কথা বললেন। তিনি এবার হেসে উঠলেন। আমি আয়েশা (রা.) বললাম, আজকের মতো দুঃখ ও বেদনার সাথে সাথে আনন্দ ও খুশি আমি আর কখনো দেখিনি। আমি তাকে ফাতেমা (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম, নবীজি কি বলেছিলেন?

তিনি উত্তর দিলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর গোপন কথাকে প্রকাশ করব না। পরিশেষে নবী কারিম (সা.)-এর ইন্তেকাল হয়ে যাওয়ার পর আমি তাকে (আবার) জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি কি বলেছিলেন? তিনি বললেন, তিনি নবীকারীম (সা.) প্রথমবার আমাকে বলেছিলেন, জিবরাঈল (আ.) প্রতিবছর একবার আমার সঙ্গে পরস্পর কোরআন পাঠ করতেন, এ বছর দু’বার এরূপ পড়ে শুনিয়েছেন। আমার মনে হয় আমার বিদায়কাল ঘনিয়ে এসেছে এবং এরপর আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সাথে মিলিত হবে। তা শুনে আমি কেঁদে দিলাম। দ্বিতীয়বার বলেছিলেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, জান্নাতবাসি মহিলাদের অথবা মুমিন মহিলাদের তুমি নেত্রী হবে। এ কথা শুনে আমি হেসেছিলাম। (বোখারি, হাদিস : ৩৩৬৪) আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে রাসুল (সা.)-এর মত শরীয়তের ভেতরে থেকে সন্তানদের ভালোবাসার তৌফিক দান করুন, আমিন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত