জা’ফর। আবু তালিবের ছেলে। জন্ম মক্কার কোরাইশ বংশের হাশেমী শাখায়। প্রিয় নবীজির চাচাত ভাই। আলির সহোদর। দৈহিক গঠন ও স্বভাব-চরিত্রে নবীজির অবিকল। আহ! কত সৌভাগ্য তার। কত উঁচু মর্যাদা অধিকারী তিনি। নবীজির প্রিয় সাহাবী, আদরের চাচাত ভাই, আবার আকার-আকৃতি আর স্বভাব-চরিত্রেও নবীজির মতো। এখানেই শেষ নয়, স্বয়ং নবীজি নিজেও তাকে বলতেন, জা’ফর, তুমি সিরত-সূরতে আমার মতোই। আহ!, এ কেমন সৌভাগ্য ভাবা যায়! নবীজির সাহাবী সংখ্যা তো অনেক। কিন্তু ক’জন অর্জন করতে পেরেছেন জাফরের মতো এমন সৌভাগ্য?
আবু তালিব। মক্কার সরদার আব্দুল মুত্তালিবের তৃতীয় সন্তান। কোরাইশদের মধ্যে উচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। আর্থিক অবস্থা অসচ্ছল। বড় পরিবার। সন্তান-সন্ততিও অনেক। এমনিতেই তাদের ভরণপোষণ চালিয়ে নেয়া তার পক্ষে কষ্টকর। ওদিকে আবার মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। টানা অনাবৃষ্টির কারণে কোরাইশরা মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার। ফসল পুড়ে গেছে, খাদ্যের অভাবে গবাদি পশুগুলোও শেষ। মাক্কায় হাহাকার অবস্থ। আর আবু তালিবের অবস্থা আরও নিদারুণ।
হাশেমীরা কষ্টের মধ্যে আছেন। এ সময় নবীজি এবং তার চাচা আব্বাস ভালোই সচ্ছল। নবীজি একদিন আব্বাসকে বললেন, ‘চাচা, আপনার ভাই, আবু তালিবের অনেক সন্তানাদি। ওরা সবাই দুর্ভিক্ষ ও অন্নকষ্টে আছে। চলুন, তার কিছু বোঝা আমাদের কাঁধে তুলে নিই। তার এক ছেলেকে আমি নিই এবং অন্যজনকে আপনি নিন। এতে তার কিছুটা হলেও সহায়তা হবে।’
আব্বাস বললেন, ‘ঠিক বলেছো। এটা ভালো উদ্যোগ। চলো, তার কাছে যাই।’
দু’জন গেলেন আবু তালিবের কাছে। বললেন-
: ‘আমরা আপনার পরিবারের বোঝা কিছুটা লাঘব করতে চাই। আমরা চাই এই দুর্ভিক্ষ থেকে আপনি কিছুটা হলেও মুক্তি পান। আমরা দু'জন আপনার দুই সন্তানের দায়িত্ব নেব।
: ‘আচ্ছা, আমার জন্য আকীলকে রেখে তোমরা যা খুশী তাই করতে পারো।’ আবু তালিবের উত্তর।
অতঃপর নবীজি আলীর দায়িত্ব নিলেন আর আব্বাস নিলেন জা’ফরকে।
চাচা আব্বাসের কাছেই প্রতিপালিত হলেন জা’ফর।
একদিনের ঘটনা, আবু তালিব দেখলেন, নবীজির পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছেন আলী। দৃশ্যটা তার খুবই ভালো লাগলো। পাশেই ছিলেন জা’ফর। তিনি জা’ফরকে বললেন, জা’ফর, তুমিও তোমার চাচাতো ভাই মুহাম্মাদের একপাশে দাঁড়িয়ে যাও। জা’ফর নবীজির বাম পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন। নবীজির সাথে নামাজ আদায় করলেন। প্রশান্ত হলো জা’ফরের আত্মা। মনে স্বর্গীয় সুখ ছুঁয়ে গেল। প্রভাবিত হলেন তিনি। মনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। হৃদয়ে স্থান করে নেয় ঈমানের নূর। মন ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বে মাত্র একত্রিশ বা বত্রিশ জন ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
ইসলামের প্রথম যুগ। নবীজি ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন। তাকে দমানোর অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কোরাইশদের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ। কোনো ভাবেই থামানো যাচ্ছে না। ইসলামের প্রচারকাজ অব্যাহত গতিতে চলছে। দিনদিন বাড়ছে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা। এখন তারা নিরুপায়। এবার শেষ চেষ্টা। মরণ চেষ্টা নিয়ে মাঠে নামে তারা। রাস্তাঘাটে, অলিতে-গলিতে মুসলমানদের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। যখন যেখানে যেভাবে পারা যায় দুর্বল মুসলমানদের উত্যক্ত করে। ফলে মক্কায় মুসলমানদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। নারী-পুরুষ কেউই রেহাই পায় না ওদের হিংস্র থাবা থেকে। সবসময়ই মুসলমানদের ওপর ওঁৎপেতে থাকে। সবমিলিয়ে মক্কায় শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ। ইসলামের অনুশীলন করা তো দূরের কথা, স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসতটুকুও নেই মক্কার কোথাও। সবসময় তাদের ওপর চলে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন। এমন পরিস্থিতিতে হিজরাতের অনুমতি চান কিছু সাহাবী। বেদনা ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নবীজি অনুমতি দেন। স্ত্রীকে নিয়ে জা’ফরও ওই কাফেলায় রওয়ানা হন। নবুয়াতের পঞ্চম বর্ষে হিজরত করেন হাবশায়। আহ! কী নিদারুণ নিষ্ঠুর মক্কার মানুষগুলো। তাদের অত্যাচারে সৎ ও পবিত্র-আত্মাগুলো প্রিয় জন্মভূমি, শৈশব, কৈশোরের স্মৃতি ও যৌবনের চারণভূমি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। কারণ, তারা এক আল্লাহে বিশ্বাস করেন। নবীজিকে তাঁর রাসুল হিসেবে মানেন। এই তাদের অপরাধ।
জীবনের পনেরটি বছর কাটেছে হাবশায়। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর নবীজি মদীনায় আসার জন্য চিঠি দেন। সপ্তম হিজরিতে স্ত্রীকে নিয়ে দ্বিতীয়বার হিজরত করেন মদীনায়। খায়বার বিজয় হয়েছে। এদিকে জা’ফরও এসেছেন। জা’ফরকে দেখে নবীজি খুশী। জড়িয়ে ধরলেন। আদর করলেন। দু’চোখের মাঝখানে চুমু খেলেন। আহ! কত চমৎকার সে দৃশ্য। কত বরকতময় ক্ষণ। না দেখে কতটা উপলব্ধি করা সম্ভব! সাক্ষাত পর্ব শেষ হয়নি এখনও। জা’ফরকে পেয়ে খুশির আতিশয্যে নবীজি কী বলেছিলেন? বলেছিলেন, ‘আমি জানি না, খায়বার বিজয়ে আমি বেশি খুশি না জা’ফরের আগমণে।’
আহ! পনের বছর পর নবীজির সাক্ষাত। নবীজির কোমল ঠোঁট জোড়া যে কপাল স্পর্শ করে, খায়বার বিজয়ের সাথে যার আগমনের তুলনা, সে জা’ফর কত দামী। যার আগমনে নবীজি খুশি। খুশি সাহাবারাও। গরিব মুসলমানরা সে কী খুশি!
জা’ফর এসেছেন। এসেছেন মিসকীনদের পিতা। তিনি ছিলেন দরিদ্রের প্রতি ভীষণ দয়ালু। দুর্বলদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাকে ডাকা হতো আবুল মাসাকীন। মিসকীনদের পিতা।
জা’ফর মদীনায় এসেছেন প্রায় এক বছর হলো। আছেন নবিজির সান্নিধ্যে। এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি দেখেন আর ভাবেন, কত সুন্দর মদীনা শহর। সবাই প্রাণভরে আল্লাহর গোলামী করে। মনভরে নবীজিকে দেখে। সব মুসলমান ভাই ভাই। ভাইয়ের সাহায্যে ভাই এগিয়ে আসে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে অন্যের উপকার করার চেষ্টা করে। নেই দেবদেবী। নেই মূর্তির উপাসনা। শিরক মুক্ত পরিবেশ। এ বছর যিলকদ মাসে নবীজির সাথে ওমরা পালন করেছেন।
অষ্টম হিজরী। সিরিয়ার রোমান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ। বিশাল বাহিনীর মোকাবিলা করতে হবে মুসলমানদের। সংখ্যা তারা খুবই কম। মাত্র তিন হাজার। নবীজি বাহিনী প্রস্তুত করলেন। সেনাপতি নিযুক্ত করলেন তিনজন। এই প্রথম কোনো যুদ্ধে তিনজন সেনাপতি। প্রথম যায়েদ বিন হারিসা। যদি যায়েদ শহীদ হয় তাহলে জা’ফর। জা’ফর শহীদ হলে আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। সেও যদি শহীদ হয় তাহলে নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচন করে নিবে।
বর্ণনায় পাওয়া যায়, জা’ফরকে দ্বিতীয় সেনাপতি নিযুক্ত করায় তিনি আপত্তি করেন। তার দাবি, প্রথমে তাকে দেয়া হোক। আহ! শহীদ হওয়ার কতটা আগ্রহ। যদি প্রথম সেনাপতির শাহাদাত বরণ করার পর বিজয় অর্জিত হয়ে যায়। তিনি শাহাদাত বরণ করতে না পারেন। বঞ্চিত হবেন। পরক্ষণেই অন্তরে আশার আলো ছুঁয়ে গেছে। নবীজি একে একে তিনজনকে কেন নিযুক্ত করলেন? আর কেনই-বা বললেন, অমুক শহীদ হলে অমুক। এসব ভেবে আস্বস্ত হলেন তিনি।
মুসলিম বাহিনী সিরিয়া সীমান্তে। ‘মূতা’ নামক এলাকায়। সামনে এক লাখ রোমান সৈন্য তাদের মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত। তাদের সাহায্যের জন্য রয়েছে আরো লাখ খানেক। অন্যদিকে মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা মাত্র তিন হাজার। হ্যাঁ, ঘাবড়ানো কিছু নেই। তারা সংখ্যায় যুদ্ধ করেন না। ঈমানী শক্তি তাদের পুঁজি। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যায়েদ বিন হারিসা বীরের ন্যায় যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন।
দ্বিতীয় সেনাপতি জা’ফর। ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন। তরবারির আঘাতে ঘোড়ার পা কেটে দেন। শত্রুরা আমাদের ঘোড়া ব্যবহার করবে, তা কী করে হয়! ইসলামের পতাকা এখন জা’ফরের হাতে। সমুন্নত পতাকা হাতে ঢুকে পড়েন শত্রু বাহিনীর ভেতর। বহু দূর পর্যন্ত চলে যান। সামনে এগুচ্ছেন আর শত্রু নিধন করছেন। হঠাত তাঁর ডান হাতে অক্রমণ। তরবারির আঘাতে দ্বিখণ্ডিত হয়ে ছিটকে পড়ে হাতটি। বাম হাত তো আছে। পতাকা উঁচিয়ে ধরেছেন বাম হাতে। যুদ্ধ চলছে আপন গতিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে আরেকটি আঘাত লাগে বাম হাতে। দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দ্বিতীয় হাতটিও। হাল ছাড়েননি। মাটিতে মিশতে দেননি ইসলামের পতাকা। তারা সাহবা। তারা রাদিয়াল্লাহু আনহুম। একজনের প্রাণ বাকি থাকা অবস্থায়ও এই পতাকা মাটিতে মিশবে না। বাহু দিয়ে বুকের সাথে জাপ্টে ধরেছেন। সমুন্নত রেখেছেন ইসলামের পতাকা। অনেক্ষণ রেখেছেন। তারপর তরবারির তৃতীয় এক আঘাতে তার দেহ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
যুদ্ধ শেষ। জা’ফরের লাশ বের করা হলো। শুধু সামনের দিকেই পঞ্চাশটি ক্ষতচিহ্ন। সারা দেহে নব্বইটিরও বেশি। পেছনে একটিও নেই।
নবীজি মদীনায়। শুনলেন তিন সেনাপতি শাহীদ। দারুণ ব্যথিত হলেন তিনি। বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি চাচাত ভাই জা’ফরের বাড়ির পথ ধরলেন। আসমা স্বামীকে অভ্যর্থনা জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রুটির জন্য খামিরা বানিয়েছেন। ছেলেমেয়েদের গোসল করিয়ে তেল মাখিয়েছেন। তাদের নতুন পোশাক পরিয়েছেন।
নবীজিকে আসতে দেখে আসমা পাতলা ও পরিষ্কার একখানা কাপড় দিয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে নিলেন। নবীজিকে তার বাড়ির দিকে আসতে দেখে মনে তার নানারকম ভীতি ও শঙ্কা। নবীজি ঘরে এলেন। কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে বললেন, ‘জা’ফরের ছেলেমেয়েদের আমার কাছে নিয়ে এসো।’ তাদেরকে ডাকা হলো। খুশিতে বাগবাগ তারা। নবীজি তাদের মেহমান। কে আগে কাছে পৌঁছাবে। প্রতিযোগিতার দৌড়। নবীজি জড়িয়ে ধরলেন। চুমু খেলেন। তাঁর দু’চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আসমার মনে দাগ কাটলো, বললো- : ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার মা-বাবা আপনার প্রতি কোরবান হোক। আপনি কাঁদছেন কেন?’ জা’ফর ও তার সঙ্গী দু’জনের সংবাদ পেয়েছেন কি? : হ্যাঁ, তারা শাহাদাত বরণ করেছেন। নবীজির উত্তর। মুহূর্তেই ছোট্ট ছেলেমেয়েদের মুখের হাসিবিলীন হয়ে গেল। মা কান্না করছেন, তারা পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল।
প্রতিবেশী মহিলারাও আসলেন। নবীজি চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন।
বাড়ি পৌঁছলেন নবীজি। স্ত্রীদের ডেকে বললেন, ‘তোমরা জা’ফরের পরিবারের প্রতি নজর রেখো। তারা তো আজ চেতনাহীন।’
জা’ফরের শাহাদাত বরণ করেছেন। দীর্ঘদিন হয়ে গেল। নবীজি এখনও শোকাভিভূত ও বিমূর্ষ। একদিন জিবরীল (আ.) আসলেন। তাকে সুসংবাদ শুনালেন- আল্লাহতায়ালা জা’ফরকে তার কর্তিত দু’টি হাতের পরিবর্তে তাকে নতুন দু’টি ডানা উপহার দিয়েছেন। জান্নাতে ফেরেশতাদের সাথে উড়ে বেড়ান তিনি। ‘যুল-জানাহাইন তাইয়ার’। দু’ ডানাওয়ালা পাখি। তিনি ফেরদৌসের পাখি।
(সূত্র : সিরাতে ইবনে হিশাম, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, সিরাত বিশ্বকোষ, উসদুল গাবাহ, তারিখে ইসলামসহ বিভিন্ন সিরাত ও হাদিস গ্রন্থ।)।
লেখক : মাদ্রাসা শিক্ষক, টঙ্গী গাজীপুর