ঢাকা ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মুসলিম বিশ্ব পরিচিতি : তুরস্ক

জুনাইদ ইসলাম মাহদি
মুসলিম বিশ্ব পরিচিতি : তুরস্ক

তুরস্কের সরকারি নাম প্রজাতন্ত্রী তুরস্ক। এটি পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। তুরস্কের প্রায় পুরোটাই এশীয় অংশে, পর্বতময় আনাতোলিয়া বা এশিয়া মাইনর উপদ্বীপে পড়েছে। তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা আনাতোলিয়াতেই অবস্থিত। তুরস্কের বাকি অংশের নাম পূর্ব বা তুর্কীয় থ্রাস এবং এটি ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় অবস্থিত। এই অঞ্চলটি উর্বর উঁচু-নিচু টিলাপাহাড় নিয়ে গঠিত। এখানে তুরস্কের বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুল অবস্থিত। সামরিক কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি জলপথ এশীয় ও ইউরোপীয় তুরস্ককে পৃথক করেছে মার্মারা সাগর এবং বসফরাস প্রণালী ও দার্দানেলেস প্রণালী। এই তিনটি জলপথ একত্রে কৃষ্ণ সাগর থেকে এজিয়ান সাগরে যাবার একমাত্র পথ তৈরি করেছে।

গোটা মানবসভ্যতার ইতিহাসজুড়েই তুরস্ক এশিয়া ও ইউরোপের মানুষদের চলাচলের সেতু হিসেবে কাজ করেছে। নানা বিচিত্র প্রভাব থেকে তুরস্কের একটি নিজস্ব পরিচয়ের সৃষ্টি হয়েছে এবং এই সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে এখানকার স্থাপত্য, চারুকলা, সংগীত ও সাহিত্যে। গ্রামীণ অঞ্চলে এখনও অনেক অতীত ঐতিহ্য ও রীতিনীতি ধরে রাখা হয়েছে। তবে তুরস্ক বর্তমানে একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানকার অধিকাংশ লোকের ধর্ম ইসলাম এবং মুখের ভাষা তুর্কি ভাষা।

অর্থনৈতিক রূপান্তরের সাথে সাথে নগরায়নের হারও অনেক বেড়েছে। বর্তমানে তুরস্কের ৭৫ শতাংশ জনগণ শহরে বাস করে। ১৯৫০ সালেও মাত্র ২১ শতাংশ শহরে বাস করত। জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ তুরস্কের এশীয় অংশে বাস করে। বাকি ১০ শতাংশ ইউরোপীয় অংশে বাস করে।

বর্তমানকালে তুরস্ক একটি সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ যার কোনো রাষ্ট্রধর্ম নেই এবং সংবিধানে এর প্রতিটি নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তায় গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তুরস্কের ৯৬.৫ শতাংশ লোক ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ০.৩ শতাংশ খ্রিষ্টান ও ৩.২ শতাংশ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রে রূপ দেয়ার লক্ষ্যে তুরস্কে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে পৃথক করা হয়। তবে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে দীর্ঘদিন পর সে ব্যবস্থায় আবার পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।

অতীত ইতিহাস : আজকের মধ্যপ্রাচ্য ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন ছিল। সপ্তম শতাব্দী অর্থাৎ ওমর (রা)-এর শাসনামল হতে রোমানদের শক্তি খর্ব হতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ১০৪৮ সালের যুদ্ধে সেলজুক তুর্কি মুসলিমরা এশিয়া মাইনরে (তুরস্ক ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল) বাইজেন্টাইনদের (রোম সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল) পরাজিত করে। ১০৭১ সালের ২৬ আগস্ট সংঘটিত মানযিকার্টের যুদ্ধে জয় লাভের মাধ্যমে তুরস্কে (তৎকালীন সময় থেকে খেলাফতের পতনের আগ পর্যন্ত বর্তমান তুরস্কের ইস্তামবুল বাদে এশীয় অংশটুকু আনাতোলিয়া নামে পরিচিত ছিল) সেলজুক শাসন পাকাপোক্ত হয়।

তবে কয়েক শতাব্দী পরেই সেলজুকরা দুর্বল হতে শুরু করে। আনাতোলিয়ার ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর সাথে বিচ্ছিন্নতা ও মোঙ্গলদের সাথে শক্তির ভারসাম্যে ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকে সেলজুকরা। অপরদিকে, উসমান গাজীর নেতৃত্বে তার বাহিনী তুরস্কের সর্ব পশ্চিমের নগর বুরসাতে বাইজেন্টাইনদের বিভিন্ন দুর্গ দখল করে দ্রুত শক্তি অর্জন করতে থাকে। ধীরে ধীরে তারা এ অঞ্চল থেকে সেলজুকদের হটিয়ে দিয়ে প্রভাব বাড়াতে থাকে। ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল (ইস্তানবুল) জয় করার মধ্য দিয়ে উসমানীয় খেলাফত পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে।

ভৌগোলিক অবস্থান : ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব ও এশিয়ার পশ্চিমণ্ডদক্ষিণাংশে তুরস্ক অবস্থিত। যার পশ্চিমাংশের বসফরাস প্রণালী থেকে পুরো ইস্তানবুল অংশটি পড়েছে ইউরোপের অংশে। দেশটির উত্তর দিকের সীমানা ঘেঁষে জর্জিয়া ও বুলগেরিয়ার মাঝামাঝিতে রয়েছে কৃষ্ণসাগর। এছাড়া পশ্চিমণ্ডদক্ষিণাংশে গ্রীস ও সিরিয়ার মাঝামাঝিতে আছে ইজিয়ান ও ভূ-মধ্যসাগর। পূর্ব-দক্ষিণাংশের সীমানায় অবস্থান করছে ইরাক, ইরান, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া।

খেলাফতের পতন : প্রায় সাড়ে ৪০০ বছর ধরে এশিয়ার বৃহদাংশ, উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপের বলকান ও ককেশাশ অঞ্চলে উসমানীয় খেলাফতের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই উসমানীয় খেলাফতের প্রতাপ কমতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তা বিলীন হতে শুরু করে। মূলত বলকান অঞ্চলে নিজের আধিপত্য ধরে রাখতেই ১৯১৪ সালে খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের কারণে তিনি রাশিয়ার বিপরীতে জার্মানির পক্ষে অবস্থান নেন। শেষ পর্যন্ত সব অঞ্চল হারিয়ে উসমানীয় খেলাফত শুধু তুরস্কে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তারপরও ইউরোপীয় প্রতিবেশীরা পরাজিত তুরস্ককে পুরোপুরি দখল করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। এ লক্ষ্যে ইউরোপীয় সৈন্যদলগুলো তুরস্কের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করছিল।

খলিফা ষষ্ঠ মুহাম্মদ : খলিফা ষষ্ঠ মুহাম্মদ ইউরোপের হাত থেকে তুরস্কের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে ‘গেলিপোল্লি’ যুদ্ধের নায়ক মোস্তফা কামাল পাশাকে ১৯১৯ সালের ৩০ এপ্রিল সেনাবাহিনীর নবম ডিভিশনের ‘জেনারেল ইন্সপেক্টর’ হিসেবে নিয়োগ দেন। তবে খলিফার সাথে দ্বিমত করে ৮ জুলাই তিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন। উসমানীয় সরকার তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিলেও তিনি রক্ষা পেয়ে যান। ওই বছরই উসমানীয় সরকারের সর্বশেষ নির্বাচনে কামালের দল বিজয়ী হয়। পরবর্তীতে বৃটিশরা তুরস্কের ‘মিশাক-ই-মিল্লি’কে (জাতীয় ঐক্যের ঘোষণা) ভেঙে দিলে কামাল পাশা ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি’ (জিএনএ) প্রতিষ্ঠার জন্যে জাতীয় নির্বাচনের ডাক দেন। জিএনএ প্রতিষ্ঠিত হলে উসমানীয় সরকারকে চ্যালেঞ্চ করে দেশে আরেকটি কর্তৃপক্ষের (দ্বৈত) শাসন চালু হয়।

সর্বশেষ খলিফা : বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া সেভরে চুক্তি (১৯২০) প্রত্যাখ্যান করে জিএনএ’র নেতৃত্বে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করা হয়। ১৯২১ সালের ৫ আগস্ট কামাল পাশাকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯২২ সালে গ্রিস-তুরস্ক যুদ্ধে তুরস্ক চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। যুদ্ধে জয়ের ফলে জিএনএ আরো প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। পরিণতিতে উসমানীয় খলিফা জিএনএ’র হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে বাধ্য হন। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর উসমানীয় খেলাফতের অবসান ঘোষণা করা হয়। তবে মুসলিম সেন্টিমেন্টকে অনুকূলে রাখতে দ্বিতীয় আব্দুল মজিদকে প্রতীকী খলিফা হিসেবে বহাল রাখা হয়। অবশেষে ১৭ নভেম্বর ক্ষমতাচ্যুত খলিফা ষষ্ঠ মুহাম্মদ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর জিএনএ কামাল পাশাকে প্রেসিডেন্ট এবং তুরস্ককে ‘প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা করে। এ পর্যায়ে প্রতীকী খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল মজিদকেও নির্বাসনে পাঠিয়ে ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ উসমানীয় খিলাফতকে চূড়ান্তভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

শেষকথা : আতাতুর্কের একটি বিতর্কিত মূলনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। কামালের কট্টর অনুসারীরা মনে করেন ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে ধর্মের স্থান নেই এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্মীয় ইস্যু এড়িয়ে চলা উচিত। ১৯৫০-এর দশক থেকে রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা তুরস্কের একটি বিতর্কিত ইস্যু। তুরস্কের সামরিক বাহিনী নিজেদের কামালবাদের রক্ষী বলে মনে করে এবং তারা ১৯৬০, ১৯৭১, ১৯৮০ এবং ১৯৯৭ সালে মোট চারবার তুরস্কের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার স্বার্থে হস্তক্ষেপ করেছে। তবে বর্তমানে তুরস্ক ধর্মনিরপেক্ষতার অনেক রীতিনীতি থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং ইসলাম পালনে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত