মদিনা শরিফের জুমার খুতবা
তিনি সবখানে বিরাজমান
শায়খ ড. আবদুল বারি আস সুবাইতি
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
তাকওয়া কেয়ামতের দিন উপকারী হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো কাজে আসবে না, সেদিন উপকৃত হবে শুধু সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর কাছে পরিশুদ্ধ হৃদয়ে আসবে।’ (সুরা শুআরা : ৮৮-৮৯)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখেন।’ (সুরা মোমিন : ৪৪)। এ আয়াত গভীর অর্থ ও প্রভাব বহন করে; যা মন-মনন ও জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলে। এটি পাঠকের মনে এ বিশ্বাস জন্মায়, আল্লাহ সবকিছুর পরিচালক। তিনি বান্দার বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। এ উপলব্ধি বান্দার হৃদয়ে প্রশান্তি আনে। আল্লাহতায়ালা সূক্ষ্মভাবে সৃষ্ট এ বিশাল বিশ্বকে তাঁর বান্দাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন। তিনি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময় ও আসমান-জমিনের অধিপতি। তিনি রাতকে বিশ্রামের জন্য ও দিনকে কাজের জন্য নির্ধারণ করেছেন। সূর্য ও চাঁদকে হিসেবের জন্য সৃষ্টি করেছেন। গাছপালা ও জীবজন্তুকে মানুষের সেবার জন্য সৃষ্টি করেছেন। তাদের পায়ের নিচে পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন। এর মধ্যে নদ-নদী প্রবাহিত করেছেন। ফলমূল জন্মিয়েছেন। যাতে তারা সেগুলোর মধ্য থেকে উত্তমগুলো আহার করতে পারে। এগুলোর সবই বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর কৃপা দৃষ্টির ফল। এরপরও কি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না?
মোমিন-মুসলমানের বিশ্বাস : আল্লাহ বান্দার বিষয়ে পূর্ণ দৃষ্টি রাখেন। এ বিশ্বাস তার অন্তরে সন্তুষ্টি ও আত্মসমর্পণ তৈরি করে। কারণ, তার রিজিক নিশ্চিত। আল্লাহর কাছে তার কোনো অবস্থাই গোপন নয়। আল্লাহ তাঁর জ্ঞান ও করুণার মাধ্যমে বান্দার অবস্থা, অভাব, চাহিদা ও ভবিষ্যতের উদ্বেগের সবকিছু জানেন। যখন মানুষ উপলব্ধি করে, আল্লাহ তাকে দেখেন, তার কথা শোনেন, তখন তার অন্তরে প্রশান্তি আসে ও উদ্বেগ দূর হয়। ফলে তার সংকল্প আরও দৃঢ় হয় এবং আল্লাহর ওপর আস্থা বাড়ে। মহান আল্লাহ মুসা ও হারুন (আ.)-কে বলেছিলেন, ‘তোমরা ভয় করো না। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি; আমি শুনি ও দেখি।’ (সুরা তহা : ৪৬)। এ বিশ্বাস নিয়ে মুসা (আ.) সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। যখন ফেরাউনের সৈন্যরা পেছন থেকে আসছিল, তখনও আল্লাহর প্রতি তার অটল বিশ্বাস ছিল। এ সময় তিনি বলেছিলেন, ‘কখনোই নয়! আমার সঙ্গে আছেন আমার প্রতিপালক; সত্বর তিনি আমাকে পথনির্দেশ করবেন।’ (সুরা শুআরা : ৬২)। একইভাবে হিজরতের সময় যখন মুশরিকরা আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে হত্যা করতে চেয়েছিল, তখন তিনি সাওর পাহাড়ের গুহায় শান্তভাবে ছিলেন। তিনি ও তার সঙ্গী আবু বকর (রা.)-কে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘বিষণ্ণ হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা তাওবা : ৪০)।
বান্দার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখেন : কোরআনের একটি আয়াত রয়েছে, যা পাঠ করলে আশ্চর্যজনক বিপ্লব ঘটে। তা মুসলমানের অন্তরে আল্লাহর প্রতি লজ্জাশীলতা সৃষ্টি করে। ফলে সে এমন কোনো স্থানে যেতে লজ্জিত হয়, যেখানে আল্লাহ তাকে নিষেধ করেছেন। সে ভয় পায়, যেন তার আঙ্গুলগুলো তাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হারাম স্থানে নিয়ে না যায়। সে আতঙ্কে থাকে, তার পা যেন তাকে এমন স্থানে টেনে নিয়ে না যায়, যা তার সৃষ্টিকর্তাকে অসন্তুষ্ট করবে। তার কানও নিষিদ্ধ, অশ্লীল, গিবত শুনতে লজ্জিত হয়। সে জানে, আল্লাহ তার সমস্ত কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত। আল্লাহর প্রতি এ সচেতনতা তাকে পাপ থেকে বাঁচানোর ঢাল হিসেবে কাজ করে। এ আয়াত একজন মুসলমানের মনে সংযমের গুণকে শক্তিশালী করে; যা তাকে অবৈধ কামনা ও লালসা চরিতার্থ করা থেকে দূরে থাকতে অনুপ্রাণিত করে। যখন তার কানে ফিতনার শব্দ পৌঁছায়, তখন সে স্মরণ করে, আল্লাহ তাকে দেখছেন। এ সময় সে বলে ওঠে, ‘আল্লাহর আশ্রয় চাই।’ (সুরা ইউসুফ : ২৩)। তাই এ হৃদয় ও তার শক্তি, দৃঢ়তা, অবিচলতা ও পরীক্ষার মধ্যে ধৈর্যের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার কিছু নেই। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) এ ধরনের হৃদয় সম্পর্কে বলেছেন, ‘একটি হৃদয় যা আল্লাহর মহত্ত্ব, ভালোবাসা, সচেতনতা ও তার প্রতি লজ্জায় পূর্ণ, এমন হৃদয়ে বসবাস করতে কোন শয়তান সাহস করবে?’ একজন মজলুম যখন এমন আয়াত পাঠ করে, তখন তার হৃদয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের শান্তি প্রবাহিত হয়। কারণ, সে জানে, আল্লাহর দৃষ্টি কখনও অসচেতন থাকে না। আল্লাহর বিচার সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি নির্ধারিত সময়ে অত্যাচারী থেকে প্রতিশোধ নেবেন। ফলে সে নিশ্চিত থাকে, তার অধিকার সুরক্ষিত। যদিও অত্যাচার বেড়ে যায় ও দীর্ঘস্থায়ী হয়; কিন্তু তার পরিণতির জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। আর অত্যাচারীর শেষ পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। ধৈর্যের জন্য এমন পুরস্কার রয়েছে, যা শুধু আল্লাহই নির্ধারণ করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘অত্যাচারীরা শিগগিরই জানবে, কোন স্থলে তারা ফিরবে।’ (সুরা শুআরা : ২২৭)।
আল্লাহতায়ালা সবকিছু দেখেন : যখন একজন মুসলমান অনুভব করে, আল্লাহ তাকে দেখছেন, তখন তার সৃষ্টিকর্তা হয়ে ওঠেন সবচেয়ে দ্রুততম আশ্রয়। যার দিকে সে ছুটে যায়; সবচেয়ে কাছের সত্তা, যার কাছে সে তার মনের কথা প্রকাশ করে ও সবচেয়ে বিশ্বস্ত অভিভাবক, যার কাছে সে তার অভিযোগ জানায়। প্রার্থনা হলো জীবনের সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার প্রথম দরজা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার বান্দারা যখন আমার সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো কাছেই। প্রার্থনাকারী যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে, তখন আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দিই।’ (সুরা বাকারা : ১৮৬)। এ কথা একটি মজবুত ভিত্তি গঠন করে, যা সমাজের উন্নয়ন, জাতির অগ্রগতি ও দেশ গঠনকে সমর্থন করে। যখন একজন কর্মচারী বা দায়িত্বশীল অনুভব করে, আল্লাহ তাকে দেখছেন ও তার কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছেন, তখন তার মধ্যে কাজের প্রতি নিষ্ঠা, দক্ষতা ও ঐকান্তিকতার শক্তিশালী প্রেরণা জাগে। তখন তার কাজ শুধু পার্থিব দায়িত্ব থাকে না, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত হয়ে ওঠে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নতি লাভ করে, ব্যক্তিদের জীবন সমৃদ্ধ হয়, দুর্নীতি কমে ও সমাজ উন্নতির দিকে ধাবিত হয়। যখন হৃদয়ের গভীরে এ কথার মর্মার্থ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সচেতনতা গড়ে ওঠে।
৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ৪ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন - আবদুল কাইয়ুম শেখ