ন্যায়পরায়ণতা একটি মানবিক গুণ। ব্যক্তিক ও বিচারিক বৈশিষ্ট্য। যা খোদাভীরুতা, সত্যবাদিতা, ইনসাফ ও বিশ্বস্ততাসহ অনেক নৈতিক গুণের সমন্বিত রূপের প্রতিফলন। যা সমাজে কাম্য ও আবশ্যক। আল্লাহতায়ালা কোরআনে ন্যায়ের আদেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা ন্যায়বিচার করো। তা তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী।’ (সুরা মায়িদা : ৮)। নবী (সা.) ছিলেন ন্যায়পরায়ণতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইতিহাসে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তিনি হলেন অনন্য, অদ্বিতীয়। যেন ন্যায়পরায়ণতাই তাঁর অন্যতম সৌন্দর্য। হাদিসে বর্ণিত আছে, এক মুনাফিকের আপত্তির উত্তরে রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘দূর হও হতভাগা!’ আমি ন্যায্য বণ্টন না করলে আর কে করবে? ইনসাফ না করলে আমি ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হব। (বোখারি : ৩৬১০)।
রাসুল (সা.)-এর ন্যায়বিচার : রাসুল (সা.) ছিলেন ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আপসহীন। ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা, আত্মীয়-অনাত্মীয় সবার জন্য তাঁর বিচার ছিল সমান। তিনি ছিলেন কোরআনের বাস্তব প্রতিফলিত রূপ। কোরআন যেন তাঁর কথাই বলছে। ‘হে মোমেনরা, তোমরা ন্যায়ের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর জন্য সাক্ষীরূপে। যদিও তা তোমাদের নিজদের কিংবা পিতামাতার অথবা নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে হয়। যদি সে বিত্তশালী হয় কিংবা দরিদ্র, তবে আল্লাহ উভয়ের ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ কর না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা এড়িয়ে যাও তবে আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে সম্যক অবগত। (নিসা: ১৩৫)। বিচারের ক্ষেত্রে তিনি কখনো মুসলিম অমুসলিম পার্থক্য করতেন না। দেখতেন না কোনো ভেদাভেদ। সর্বদা রবের আদেশ- ‘আর আপনি তাদের মাঝে ন্যায়বিচার করুন’ (মায়েদা : ৪২)- পালনে ছিলেন দৃঢ়প্রত্যয়ী। বিচারের ক্ষেত্রে সর্বদা তিনি প্রমাণের উপর নির্ভর করতেন। নিচে বর্ণিত দুটো ঘটনায় আমরা তাঁর মহৎ গুণের বাস্তবিক চিত্র দেখতে পাই।
এক. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো মুসলিমের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা শপথ করে, তাহলে সে আল্লাহর সমীপে এমন অবস্থায় হাজির হবে যে, আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত থাকবেন। আশআস (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম। এটা আমার সম্পর্কেই ছিল। আমার ও এক ইহুদির যৌথ মালিকানায় একখণ্ড জমি ছিল। সে আমার মালিকানার অংশ অস্বীকার করে বসল। আমি তাকে নবীর (সা.) কাছে নিয়ে গেলাম। রাসুল (সা.) আমাকে বললেন, তোমার কোনো সাক্ষী আছে? আমি বললাম, না। তখন তিনি ইহুদিকে বললেন, তুমি কসম কর। আমি তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, সে তো কসম করবে এবং আমার সম্পত্তি নিয়ে নেবে। তখন আল্লাহতায়ালা আয়াত নাজিল করেন, যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছমূল্যে বিক্রি করে, তাদের আখেরাতে কোনো প্রাপ্য অংশ নেই। আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদের পরিশুদ্ধও করবেন না। (আলে ইমরান : ৭৭, বোখারি : ২২৫৬)। উক্ত ঘটনায় বিচারপ্রার্থীর একপক্ষ ছিলেন রাসুল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবী। অন্যপক্ষ ছিল একজন ইহুদি। রাসুল (সা.) অবশ্যই জানতেন তাঁর প্রিয় সাহাবী কখনো মিথ্যা বলবে না। তবুও তিনি নির্ধারিত আইনের উপর অটল ছিলেন। এর বাইরে কোনো পক্ষপাতিত্ব করেন নেই। বাহ্য প্রমাণাদির মাধ্যমে যা ন্যায় তাই ফয়সালা দিয়েছেন।
দুই. আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, মাখযুমি গোত্রের একজন মহিলা চুরি করলে তার (প্রতি হদ প্রয়োগের ব্যাপারে) কুরাইশরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। তারা বলল, কে এ ব্যাপারে রাসুল (সা.)-এর কাছে কথা বলতে পারে। তখন তারা বলল, এ ব্যাপারে উসামা (রা.) ছাড়া আর কারো হিম্মত নেই। তিনি রাসুল (সা.)-এর প্রিয় ব্যক্তি। রাসুল (সা.)-এর সাথে তিনি এ ব্যাপারে কথোপকথন করলে রাসুল (সা.) বললেন, তুমি কি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হদের (দণ্ডবিধান) ব্যাপারে সুপারিশ করতে চাও? অতঃপর রাসুল (সা.) দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, ‘হে লোকসকল! তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিরা ধ্বংস হয়েছে এ কারণে যে, তাদের মধ্যে যখন কোন সম্ভ্রান্ত লোক চুরি করত, তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর যদি কোনো দুর্বল লোক চুরি করত, তবে তারা তার উপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! যদি ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদও চুরি করত, তবে নিশ্চয়ই আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (মুসলিম : ৪২৬৩)।
চুরি-করা মহিলাটি সম্ভ্রান্ত বংশের হওয়ায় তারা তার সম্মান রক্ষার্থে শাস্তি লাঘবের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু রাসুল (সা.) এর আদালতে ছিল সবাই সমান। তিনি ন্যায়বিচারে যেমন ছিলেন অটল-অবিচল তেমনি তিনি ছিলেন দয়ালু, রহমদিল। এক্ষেত্রে সাহাবি মায়েয আসলামি (রা.)-এর ঘটনা হাদিসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। যেখানে মায়েয আসলামিকে স্বেচ্ছায় একাধিকবার স্বীকারোক্তির মাধ্যমে জিনার অপরাধে রজম দেয়া হয় অর্থাৎ পাথর ছুঁড়ে তার হত্যা নিশ্চিত করা হয় জিনার শাস্তিস্বরূপ। সাহাবায়ে কেরাম যখন তার কৃত অপরাধের কারণে তাকে ঘৃণাভরে স্মরণ করছিল, তখন রাসুল (সা.) তা থেকে নিষেধ করে বলেছেন, তোমরা মায়েয আসলামিকে গালি দিও না। কেননা, সে এমন তওবা করেছে যদি তা মদিনাবাসীর মাঝে বণ্টন করা হয়, তাহলে সবার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। অপর বর্ণনায় আছে, রজমের কারণে মায়েয আসলামির কষ্টের বিবরণ শুনে রাসুল (সা.) নিদারুণ দুঃখিত হয়ে বললেন, ‘তোমরা তাকে ছেড়ে দিলে না কেন? হয়তো সে তওবা করে নিত এবং আল্লাহও তার তওবা কবুল করে নিতেন।’ (মিশকাতুল মাসাবীহ : ৩৬২৭)।
রাসুল (সা.)-এর ন্যায়পরায়ণতা শুধু তার নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর ন্যায়বিচার শুধু আপনাতেই রক্ষিত ছিল না। সমাজের মধ্যে তিনি তা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে। তিনি সাহাবায়ে কেরাম ও উম্মতে মুসলিমাকে ন্যায় শিক্ষা দিয়েছেন বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ও উপদেশের মাধ্যমে। আবার কখনো কখনো ধমকের স্বরে প্রথিত করেছেন তাদের হৃদয়ে ন্যায়ের সোনালি বীজ। যার ফল ও ফুল হয়ে পৃথিবীময় সুবাস ছড়িয়েছেন সাহাবায়ে কেরাম। যারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এমন এক সাম্রাজ্য যেখানে স্বয়ং খলিফার বিরুদ্ধে একজন সাধারণ ইহুদির পক্ষে রায় দেয় তারই নিযুক্ত কাজি। আর খলিফাও মাথা পেতে নেন মহামান্য কাজির সিদ্ধান্ত। যাদের ন্যায়পরায়ণতায় মুগ্ধ হয়ে অমুসলিম বিবাদীও ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়। তারা গড়ে তুলেছেন এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে একজন যুবরাজ থেকেও একজন সাধারণ মানুষ কিসাস নিতে পারে। যেখানে স্বয়ং শাসকের ছেলের উপর হদপ্রয়োগ করে শাসক নিজেই।
বিচারকের পরকাল : সমাজে কিছু প্রতিষ্ঠা করতে হলে দাওয়াতের বিকল্প নেই। এজন্য রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে সবসময় বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দিতেন। তাদের ন্যায়ের নির্দেশ দিতেন। অন্যায়ের ভয়াবহতা বর্ণনা করতেন।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় ন্যায় বিচারকারীরা কেয়ামতের দিন দয়াময় আল্লাহর ডান পাশে নুরের সুউচ্চ মিনারায় অবস্থান করবে।’ (মুসলিম : ১৮২৭)। অন্যত্র বিচারকদের সাবধান করে বলেন, ‘বিচারক তিন ধরনের। এক দল জান্নাতে যাবে। আর বাকি দুই দল যাবে জাহান্নামে। যে ব্যক্তি সত্য জেনে সেই অনুযায়ী বিচার করবে সে জান্নাতি। আর যে সত্য জেনেও সেই অনুযায়ী বিচার না করে জুলুম করল সে জাহান্নামি। অনুরূপভাবে যে সত্য না জেনে অজ্ঞাতসারে বিচার করবে, সেও জাহান্নামে যাবে।’ (আবু দাউদ : ৩৫৭৩)।
লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া, ঢাকা।