ওমরের (রা.) শাসনব্যবস্থা

মাহমুদ হাসান ফাহিম

প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ওমর ফারুক (রা.)। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। অর্ধ পৃথিবীর শাসক। নবী (সা.)-এর প্রিয় সাহাবি। তিনি ন্যায়নীতিতে ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী। অন্যায়ের প্রতিবাদে ছিলেন অপ্রতিরোধ্য বীরসেনানী। তার নাম শুনলে সে যুগের বড় বড় বীর বাহাদুরের গলা শুকিয়ে যেত ভয়ে। কারণ তিনি ছিলেন যুগখ্যাত অকুতোভয় সিপাহসালার। মরণজয়ী মুজাহিদ। ওমর ফারুক (রা.) ছিলেন ইসলামি রাষ্ট্রের অন্যতম রূপকার। খলিফা হিসেবে আমিরুল মোমেনিন ছিল তার উপাধি।

বংশ পরিচিতি : ওমর ফারুক (রা.) হস্তীবাহিনীর ঘটনার ১৩ বছর পর ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে কুরাইশ গোত্রের শাখা বনু আদির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা খাত্তাব ইবনে নুফায়েল এবং মাতা হানতামা বিনতে হিশাম। কা’ব ইবনে লুয়াই এর মাধ্যমে রাসুল (সা.) এর সঙ্গে তাঁর বংশধারা মিলে যায়। (তারিখুল ইসলাম, যাহাবি : ৩/২৫৩, সীরাতু আমিরিল মোমেনিন ওমর ইবনুল খাত্তাব : পৃ.১২-১৩, তারিখে উম্মাতে মুসলিমা : ৩/৯২)।

শৈশশ ও যৌবনের প্রথম প্রহর : শৈশবে তার পিতা তাকে উট চড়ানোর কাজে লাগিয়ে দেন। তখন মক্কার খুব কম লোকই লেখাপড়া জানত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি লেখাপড়া শিখেছেন। যৌবনের শুরুতে তিনি ব্যবসা করতেন। সেই সুবাধে আরবের বাইরেও তিনি সফর করেন। এজন্য পৃথিবীর ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অবস্থা এবং তাদের জীবন কালচার ও আচার-ব্যবহার সম্পর্কে তার ভালো জানাশোনা ছিল। কুরাইশের লোকেরা তার সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতা সম্পর্কে ভালোই অবগত ছিল। তাই অল্প বয়সেই তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। (তারিখে উম্মাতে মুসলিমা : ৩/৯৩)।

ইসলাম গ্রহণ : যৌবনের শুরুতে তিনি ইসলামের কট্টরবিরোধী ছিলেন। ঐতিহাসিকদের ভাষ্য মতে ২৮ বছর বয়সে নবুওয়াতের ষষ্ঠ বছর ইসলাম গ্রহণ করেন। সে সময় নারীপুরুষ মিলে মাত্র ৪০ জন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিল। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ২/৩৭০ সীরাতু আমিরিল মোমেনিন ওমর ইবনুল খাত্তাব : ২০)।

খেলাফতকাল : ওমর (রা.) ১৩ হিজরি থেকে ২৪ হিজরি মোতাবেক ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফার দায়িত্ব পালন করেন। খেলাফত লাভের পর তিনি একটি ভাষণ দেন। সে ভাষণে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি দুর্বল, আমাকে শক্তি দাও। হে আল্লাহ! আমি রূঢ় মেজাজি, আমাকে কোমলপ্রাণ বানাও। হে আল্লাহ! আমি কৃপণ, আমাকে দানশীল বানাও।’ (মানাকিবু আমিরুল মোমেনিন : ১৭০-১৭১, সীরাতু আমিরুল মোমেনিন ওমর ইবনুল খাত্তাব : ৭০)।

ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা : ইসলামি খেলাফতের ধারাবাহিকতা প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) থেকে শুরু হয়। কিন্তু অধিক সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খলভাবে হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর সময় ইসলামি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তিনি শুধু একজন বিজেতাই ছিলেন না, তদানীন্তন দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি রোমান ও পারসিক সাম্রাজ্যবাদকে পরাভূত করে তাদের সাম্রাজ্যকে ইসলামি রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত করেন এবং একটি কল্যাণমূলক প্রশাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সব অঞ্চলের ভারসাম্যমূলক উন্নয়ন ও অগ্রগতির নীতিমালাই ছিল প্রধান রাষ্ট্রীয় নীতি। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রকৃত অর্থ হলো, সরকারি সেবার পরিধি বাড়ানো যা হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর শাসনামলে পূর্ণরূপ বাস্তবায়িত হয়েছিল।

বিজিত দেশগুলো : হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর খেলাফত আমলে যে সমস্ত দেশ, প্রদেশ ও অঞ্চল বিজিত হয়, সেগুলোর মধ্যে পারস্য, ইরাক, খুরাসান, বেলুচিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিসর, আর্মেনিয়া প্রভৃতি রয়েছে। তার ১০ বছরের খেলাফত আমলে যে বিজয় অর্জিত হয়, তা ছিল অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য। শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে হিজরি ২২ সনে তিনি ইসলামি রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করেন।

প্রদেশিক বিভক্তি : আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করেন। ইতিহাসবিদদের বর্ণনা মতে তার খেলাফত বিস্তৃত ছিল মক্কা মুকাররমাহ, মদিনা মুনাওয়ারাহ, সিরিয়া, জাজিরা, বসরা, কুফা, মিসর, ফিলিস্তিন, খুরাসান, আযারবায়জান ও পারস্য জুড়ে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনো প্রদেশের আয়তন ছিল দু'টি প্রদেশের সমান। কোন কোন প্রদেশের আবার দু'দুটি কেন্দ্র ছিল এবং প্রত্যেকটি কেন্দ্রে পৃথক পৃথক কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল। প্রত্যেক প্রদেশের, একজন অলি বা কর্মকর্তা, একজন কাতিব (সচিব) বা মীর মুনশী, একজন সেনানায়ক, একজন সাহিবুল খারাজ বা কালেক্টর, একজন পুলিশ অফিসার, একজন ট্রেজারী অফিসার এবং একজন বিচারক অবশ্যই থাকত। এভাবে তার খেলাফত হয়ে উঠেছিল সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল। (তারিখুল ইসলাম আকবর শাহ নজিবাবাদি : ১/৩৫৩)।

প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্য ও কাঠামো : ওমর ফারুক (রা.)-এর শাসনব্যবস্থার মূলনীতি ছিল চারটি: কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস। তার শাসনব্যস্থায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ছিল না। ধনী গরিবের মাঝে পার্থক্য ছিল না। তাকওয়ারভিত্তিতে শ্রেষ্ঠ মানুষ নির্ণিত হত। ধনী-গরিব সবাই ন্যায্য ও প্রাপ্য অধিকার পেত। কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে চলত বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগ ছিল স্বাধীন। কাজি তথা বিচারকের ইনসাফপূর্ণ ফয়সালাই হত চূড়ান্ত বিচার। বিচারকার্যে খলিফা তথা ইসলামি সাম্রাজ্যের সম্রাট ওমর ফারুক (রা.)-এর ছিল না কোনো হস্তক্ষেপ। তবে তিনি অতি জটিল ও কঠিন সমস্যার সমাধান করতেন নিজ হাতে আন্তরিকতা ও ইনসাফের সাথে। তার শাসনামলে জননিরাপত্তা ছিল আশাতীত। তার প্রশাসনিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ইসলামি জাতীয়তাবাদ, কর্মকর্তাদের আচরণবিধি প্রণয়ন, নগরবাসীর মতামত গ্রহণের মাধ্যমে শাসন পরিচালনা, শাসনের ব্যাপারে সকলেই সমান, নীতিনির্ধারক হিসেবে মজলিসে শূরার অগ্রগণ্যতাসহ আরো কিছু যুগান্তকারী ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারক সিদ্ধান্ত।

শাসনতান্ত্রিক সংস্কার : হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মধ্যে উলে¬খযোগ্য দিকগুলো হলো, কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা, প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা, পুলিশ বিভাগ প্রতিষ্ঠা, জেলখানা নির্মাণ, গুপ্তচর বিভাগ প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

রাষ্ট্রীয় আয় ও ব্যয় : হজরত ওমর (রা.) রাষ্ট্রীয় আয়ের কয়েকটি উৎস নির্ধারণ করেন। যেমন, রাজস্ব ব্যবস্থা, বায়তুল মাল, মুদ্রা সংস্কার, ভূমিকর নির্ধারণ, দিওয়ানুল খারাজ, কর্মচারীদের বেতন নির্ধারণ ও আদম শুমারি ইত্যাদি।

অনন্য বৈশিষ্ট্য : ওমর ফারুক (রা.) ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। শাসক ও সমরনায়ক হিসেবে সফল ব্যক্তিত্ব। দুঃখী মানুষের কান্না তাকে কাতর করে তুলত। শাসন ক্ষমতা পেয়ে জনতার অধিকার আদায় করতে না পারার কারণে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ভয় তার হৃদয়ে থাকত সদা জাগরূক। তাই তিনি রাতবিরাতে খুঁজে ফিরতেন অভাবী প্রজাদের। কবির ভাষায় ঐতিহাসিক এমনই এক চিত্র ফুটে ওঠেছে-

ছদ্ববেশী ওই যে পথিক/ আঁধার রাতে ঘুরছে ওধিক / অসহায়ের নিচ্ছে খবর পা'য় হেঁটে। / অভাব তাদের করতে পূরণ / খাদেম যে তার সফর আপন / খাদ্য বোঝা পিঠে লয়ে যায় ছুটে। / উটের রজ্জু নিজের করে/ গোলাম যে তার পিঠের পরে/ আপন বেগে ছুটছে সেজন ভিন দেশে। / আমির ফকির নেই ভেদাভেদ / সত্য ন্যায়ের এই যে শাহেদ/ যাচ্ছে আমির ভিন দেশে আজ ফকির বেশে। / সেইতো আমির ওমর ফারুক /খোদার অশেষ রহম ঝড়ুক তার পরে।/ বিশ্ব জগৎ তাকে খ্ুঁজে / সকাল বিকাল প্রতি রোজে দূঃখ করে। / অর্ধ জাহান করল শাসন / মাটির তখত তাহার আসন / কী ছিল তার মনের বাসন তাই বলি।/ খোদার বিধান বাস্তবায়ন / সৃষ্টি সেবার স্বমূল্যায়ন / তাঁর পায়ে পা রেখে এবার পথ চলি।

জনহিতকর কার্যাবলি : হিজরি সাল প্রবর্তন, শহর নির্মাণ, ইবাদতখানা নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি। বিশ্ববিজেতা খলিফা ও আদর্শ শাসক, বিশ্বের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় অমর ব্যক্তিত্ব খলিফা ওমর ফারুক (রা.)। তার শাসনামল ইসলামের কৃতিত্বপূর্ণ সামরিক ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। তিনি শুধু মহান বিজেতাই নন, যুগশ্রেষ্ঠ শাসক এবং নিরঙ্কুশ সফল খলিফাও। যিনি মাটিতে বিছানো মাদুরের তখতে বসে করেছেন বিশ্ব শাসন। তার ছিল না শাসকসুলভ আলাদা কোনো পোশাক কিংবা সিংহাসন। ছিল না রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয়ে বিলাসী জীবন। বিশাল ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন অতি সাধারণ একজন মানুষের মতোই জীবন পরিচালনায় অভ্যস্ত, দুনিয়াবিমুখ এক নীরব সাধক। এ মহান খলিফা ২৪ হিজরি ১ মুহররম মোতাবেক ৩ নভেম্বর ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে আততায়ীর ছুরিকাঘাতে শাহাদাত বরণ করেন।

(সূত্র : ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা, সীরাতে মুস্তফা, তারিখুল ইসলাম, আকবর শাহ নজিবাবাদি)।