ঢাকা ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আদর্শ সমাজের রূপকার মুহাম্মদ (সা.)

ইসমাঈল সিদ্দিকী
আদর্শ সমাজের রূপকার মুহাম্মদ (সা.)

পৃথিবী ঘনকালো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ যে অধঃপতনের পথে চলেছিল তা আরো প্রকট হয়েছে। এমন কোনো কল্যাণশক্তি ছিল না, যা বিভ্রান্ত মানবতাকে পথ দেখিয়ে চূড়ান্ত পতন থেকে রক্ষা করবে। আর নবীগণ হকের যে দাওয়াত দিয়েছিলেন, বাতিলের শোরগোলে তা চাপা পড়ে গেছে। মানুষের সমাজে হেদায়েতের যে বাতি তারা জ্বেলেছিলেন, তাদের পর বাতিলের ঝড়-ঝাপটায় তাও নিভে গেছে। ঘরে, পরিবারে সমাজ ও জনপদে আলো তো দূরের কথা, ছিল না সামান্য আলোর আভা ও আভাস। ছিল না আলোকিত কোনো মানুষের বসবাস। মানবতার এ অন্তিমকালে সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার দয়া হলো। আখেরি নবীরূপে পৃথিবীতে একজন আলোকিত মানুষের আগমন ঘটল।

যে সমাজে মুহাম্মদি নবুওয়তের আবির্ভাব : নবুওয়ত লাভের সময় তিনি এমন এক রুগ্ন সমাজের মুখোমুখি হয়েছিলেন, যাতে এমন সব মানুষের বসবাস ছিল, যাদের চিন্তাচেতনা ছিল বক্র এবং রুচি ও স্বভাব ছিল বিকৃত। অসুন্দর ছিল তাদের চোখে সুন্দর আর যা কিছু শোভন-সুন্দর তা ছিল অসুন্দর। কল্যাণকামী বন্ধুকে তারা শত্রু ভেবে দূরে সরিয়ে দিত এবং প্রাণঘাতী শত্রুকে বন্ধু ভেবে কাছে টেনে নিত। সেখানে মদ ও মাদকাসক্তি ছিল। নগ্নতা ও বেহায়াপনা ছিল। এতিমের কান্না ও দুর্বলের ফরিয়াদ ছিল। সুদের নামে শোষণ ও লুণ্ঠন চলত। আর জীবন্ত কন্যাসন্তানকে অকল্যাণ ও অশুভ ভেবে পুতে ফেলা হত।

উম্মতের ফিকির : ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের এই ব্যাধিগুলো দূর করে সমাজ ও পরিবেশের, স্বভাব ও চরিত্রের এবং মন ও মানসের আমূল পরিবর্তনের এক সামগ্রিক মেহনতে তিনি নেমে পড়লেন। ক্ষণস্থায়ী জীবনের আরো ক্ষণস্থায়ী ভোগ আনন্দের পরিবর্তে মানুষকে তিনি সুসংবাদ দিয়েছিলেন এক অনন্ত জীবনের, অফুরন্ত নেয়ামতের। যা মানুষ না চোখে দেখেছে, না কানে শুনেছে আর না কল্পনা করেছে। পার্থিব জীবনের মোহে পড়ে যারা ভুলে গেছে আখেরাতের জীবনকে তাদের তিনি সতর্ক করেছেন জাহান্নামের কঠোর শাস্তির বিষয়ে, যা শুরু হবে তো শেষ হবে না চলতেই থাকবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে যারা অস্বীকার করেছে আমার আয়াতগুলো, তাদের আমি আগুনে ঝলসাবো। যখনই তাদের চামড়া সিদ্ধ হবে, আমি বদলে দেবো তাদের চামড়া, যেন তারা আজাব চাখতে পারে। (নিসা : ৫৬)।

রাসুল (সা.) বিশ্বনেতা : তাঁর দাওয়াত ও আহ্বান বিশেষ কোনো অঞ্চল, দেশ- জাতি বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং মানবতার মুক্তির এ মিশন, হকের প্রতি তাঁর এ উদাত্ত আহ্বান ও মর্মস্পর্শী আবেদন ছিল সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশে। তবে অধঃপতনের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাওয়ার কারণে দয়া ও রহমতের দাবি এটাই ছিল যে, আরব জাতির মধ্যেই তার আবির্ভাব ঘটবে এবং সেখান থেকেই তাঁর দাওয়াত ও মেহনত শুরু হবে। তাছাড়া ভৌগলিক অবস্থান ও রাজনৈতিক স্বাতন্ত্যের কারণে জাযীরাতুল আরবই ছিল তার নবুওয়ত ও রিসালাতের সবচেয়ে উপযোগী কেন্দ্রভূমি।

সর্বপ্রথম দাওয়াতি বাণী : সভ্যতার ইতিহাসে অন্ধকার যুগে, অন্ধকারতম সমাজে যখন তিনি আসমানি অহির দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন, তখন সর্বপ্রথম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি তাওহীদের ডাক দিলেন এবং মানুষকে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান ও বিশ্বাস স্থাপনের আহ্বান জানালেন। মূর্তি, দেব-দেবী ও বাতিল উপাস্যদের পরিত্যাগ করার এবং তাগুতকে প্রত্যাখ্যান করার আদেশ দিলেন। সাফা পাহাড়ের চূড়ায় নবুওয়তের পূর্ণ জালাল ও প্রতাপ নিয়ে মানুষের সভায় তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘হে লোকসকল, বলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, কেননা তাতেই রয়েছে ফালাহ ও সফলতা। (সুনানে কুবরা : ১০০৭৭)।

জাহেলিয়াত থেকে ইসলামের দিকে : একত্ববাদ এবং এক ইলাহ'র ইবাদতের ঘোষণার পরে জাহিলিয়াতের ‘আবুজাহেলরা’ তাদের যাবতীয় হিংস্রতা ও বর্বরতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নবী কারীম (সা.) ও সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মানুষ ও মানবতার মুক্তির সংগ্রামে অটল ও অবিচল ছিল। ধীরে ধীরে কোরায়শের কিছু নির্ভীক ও সত্যান্বেষী যুবক এগিয়ে এলো এবং সৃষ্টিকর্তাকে রব বলে স্বীকার করে নিল। যাদের সামনে না অন্তরায় হতে পেরেছে যৌবনের ভোগলিপ্সা এবং জাগতিক লোভ- লালসা, আর না তাদের ফিরিয়ে রাখতে পেরেছে জ্বলন্ত অঙ্গার-আগুন, পাশবিক নির্যাতন আর নিপীড়নের বিভীষিকা। তাদের তো চিন্তা ছিল শুধু আখেরাত এবং একমাত্র কাম্য ছিল জান্নাত। কারণ জীবন ও জগতের প্রকৃত সত্য তখন তাদের সামনে আলোক-উদ্ভাসিত হয়ে গেছে, তাই হৃদয় ও আত্মার আকুতি উপেক্ষা করা এবং বুদ্ধি ও বিবেকের দাবি প্রত্যাখ্যান করা তাদের পক্ষে আর সম্ভব ছিল না।

জীবনের বিস্ময়কর পরিবর্তন : নবীজির হাত ধরে ইসলাম গ্রহণের মধ্যদিয়ে তারা জালিয়াতের রুগ্ন ও নিষ্প্রাণ সমাজব্যবস্থা থেকে বের হয়ে ঈমান ও বিশ্বাসের এক নতুন জগতে প্রবেশ করেছিলেন। একসময় এ লোকগুলোই অশ¬ীল-উশৃঙ্খল জীবনযাপন করত, কর্মে, চরিত্রে, আচরণে, লেনদেনে এবং সমাজ শাসনে সবক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে শুধু অনিয়ম আর নৈরাজ্য ছিল। ভেবে দেখুন! জাহিলিয়াতের জীবনে কী ছিল তাদের অবস্থা! শুধু প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ স্পৃহা, তলোয়ার চালনা ও যুদ্ধোন্মাদনা। কারণে অকারণে খুন-খারাবি ও রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া। কিন্তু এই জঙ্গ ও জঙ্গি স্বভাবকে এবং তাদের আরবীয় অহমিকাকে তিনি এমনই অনবদমিত করেছিলেন যে, ক্রোধ ও প্রতিশোধের কথা তারা যেন ভুলেই গেলেন। ঈমান ও বন্দেগির বৃত্তে তারা এমনভাবে প্রবেশ করলেন, যেন কখনো এ বৃত্তের বাইরে ছিলেনই না এবং এর বাইরে যাওয়া তাদের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব না। এই যে মহাবিপ্লব আর পরিবর্তন, যা আল্লাহর নবী তাঁর ‘সাহাবা-জামাতের’ স্বভাব- প্রকৃতিতে সাধন করেছিলেন, সত্যিকারার্থেই তা ছিল মানবজাতির ইতিহাসে অভিনব এক বিপ্লব।

নববি তারবিয়াতে শান্তিপূর্ণ ইসলামি সমাজ : আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আর বিশ্বাসের ভিত্তিমূলের উপর এমন একটি আদর্শ সমাজ গড়ে উঠল যেখানে অন্যায় ও অসুন্দর এবং অসত্য ও অস্বচ্ছ কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। সমাজের সর্বস্তরে কর্তব্যবোধ ও দায়িত্বশীলতা এমন জাগ্রত ছিল যে, নিজের গণ্ডিতে প্রত্যেকে ছিল শাসক ও পরিচালক এবং প্রত্যেকে তার শাসিত ও পরিচালিতদের বিষয়ে ছিল পূর্ণ দায়বদ্ধ। এভাবে সেযুগের ইসলামি সমাজ গড়ে উঠেছিল এক সত্যিকারের সুশীল ও দায়িত্বসচেতন সমাজরূপে। সেখানে কর্তব্যবোধ যেমন ছিল, তেমনি ছিল জবাবদিহির অনুভূতি।

দেশের সম্পদ, যা একসময় ছিল শুধু রাজা ও রাজপুরুষদের দখলে, যে সম্পদের আবর্তন ছিল শুধু অভিজাত ও ধনীদের বৃত্তে, তা এখন সঞ্চিত আছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আল্লাহর আমানতরূপে। যা ব্যয় হত শুধু আল্লাহর নির্দেশিত পথে ও বণ্টিত হত শুধু হকদারের মাঝে। মানবতার যে বিপুল অব্যবহৃত কাঁচাসম্পদ বিনষ্ট হচ্ছিল এবং কারোরই জানা ছিল না, এগুলোর গুণ কী এবং সঠিক ব্যবহার ক্ষেত্র কোনটি। তিনি সেই কাঁচা মানবসম্পদে নতুন প্রাণ সঞ্চার করলেন, সুপ্ত সকল প্রতিভা জাগ্রত করলেন এবং চাপাপড়া যোগ্যতার বিকাশ ঘটালেন। প্রতিটি প্রতিভা ও যোগ্যতাকে তিনি যথাস্থানে নিয়োজিত করলেন। তখন মনে হলো জীবনের শূন্য ক্ষেত্রগুলো এতদিন এই সব প্রতিভা ও যোগ্যতারই অপেক্ষায় ছিল।

বস্তুত এত অল্প সময়ে এমন অসাধ্য সাধ্য হতে পেরেছে শুধু এজন্য যে, আল্লাহর নবী মানবস্বভাবের বদ্ধ তালা খোলার জন্য সঠিক চাবিটি ব্যবহার করেছেন। ফলে প্রথম প্রচেষ্টাতেই তা খুলে গেছে এবং মানবস্বভাবের লুকায়িত সকল সম্পদ, শক্তি, গুণ ও বৈশিষ্ট্য দুনিয়ার সামনে চলে এসেছে। আল্লাহ প্রদত্ত শক্তির মাধ্যমেই অবাধ্য বিশ্বকে তিনি নতুন দিকে এবং সহজ সরল পথে নিয়ে এসেছিলেন। তা হলো ইসলামি সভ্যতার সেই সোনালি যুগ, যা মানবতার ললাটে শুভ্র তিলকরূপে এখনো জ্বলজ্বল করছে।

লেখক : শিক্ষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত