ইতিহাসে মুসলিম নারীদের ভূমিকা বহুমুখী। পরিবার গোছানোর পাশাপাশি শিক্ষা-দীক্ষা, চিকিৎসাসহ জিহাদের ক্ষেত্রে তারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। যুগে যুগে বীরত্বের সোনালি অধ্যায়ে তারা হিম্মত ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। চরম সাহসিকতা এবং জাতির প্রতি সহমর্মিতা বোধের অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। অলসতা ও উদাসীনতার চাদরে আবৃত বর্তমান সময়ের নারীদের তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। ইসলামি আইন অনুযায়ী সাধারণত নারীদের ওপর জিহাদ ফরজ নয়। হাদিসে পাওয়া যায়, আল্লাহর রাসুল (সা.) নারীদের জিহাদে শরিক না হয়ে হজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তবে নারীরা জিহাদে চিকিৎসাসেবায় সহায়তা প্রদান করেছেন এমন বর্ণনা হাদিসে এসেছে। এ থেকে বোঝা যায়, নারীদের ওপর সাধারণত জিহাদ ফরজ নয়। তাদের ওপর জিহাদ ফরজ হওয়াটা প্রেক্ষাপটনির্ভর ও শর্তসাপেক্ষ বিষয়।
জিহাদের জন্য দোয়ার আবেদন : ইসলামের প্রথম যুগে নারী সাহাবীগণ সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন। নারীদের জিহাদের অন্যতম প্রধান উদাহরণ মিলহানের কন্যা। তিনি সামুদ্রিক যুদ্ধে যাওয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর থেকে দোয়া নিয়েছেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মিলহানের কন্যার কাছে গেলেন এবং সেখানে তিনি বিশ্রাম করলেন। তারপর তিনি হেসে উঠলেন। মিলহান (রা.)-এর কন্যা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি কেন হাসছেন? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে কিছু লোক আল্লাহর পথে জিহাদের উদ্দেশ্যে এই সবুজ সমুদ্রে সফর করবে। তাদের দৃষ্টান্ত সিংহাসনে উপবিষ্ট বাদশাহদের মতো। মিলহান (রা.)-এর কন্যা বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহর কাছে আমার জন্য দোয়া করুন, যেন তিনি আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন।
তিনি বললেন, ইয়া আল্লাহ, আপনি মিলহানের কন্যাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আবার তিনি বিশ্রাম নিলেন, এরপর হেসে উঠলেন। মিলহান (রা.)-এর কন্যা তাকে অনুরূপ জিজ্ঞাসা করলেন অথবা বললেন, এ কেন? রাসুলুল্লাহ (সা.)ও আগের মতো জবাব দিলেন। মিলহান (রা.)-এর-কন্যা বললেন, আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, তিনি যেন আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি বললেন, তুমি তাদের প্রথম দলে আছ, পেছনের দলে নয়। (বোখারি : ২৬৮০)।
স্ত্রীকে নিয়ে জিহাদে যাওয়া : আগেকার যুগের রাজা বা সেনাপতিরা বিশেষ বিশেষ নারীদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে যেতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও কোনো যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার একজন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বাইরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা করলে তিনি তার সহধর্মিণীদের মধ্যে লটারীর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতেন এবং এতে যার নাম আসত তাকেই রাসুলুল্লাহ (সা.) সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কোনো এক যুদ্ধে এভাবে তিনি আমাদের মধ্যে লটারীর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তাতে আমার নাম এলো এবং আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বের হলাম। এ ছিল পর্দার আয়াত নাজিল হওয়ার পরের ঘটনা। (বোখারি : ২৬৮১)।
পুরুষদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ : উহুদ যুদ্ধে নারী সাহাবীগণ অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা আহত পুরুষ সাহাবীদের সেবা করা, তাদের পানি সরবরাহ করা এবং চিকিৎসার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, উহুদের যুদ্ধে সাহাবীগণ রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। আমি দেখলাম, আয়েশা বিনতে আবু বকর (রা.) ও উম্মে সুলাইম (রা.) তাদের আঁচল এতটুকু উঠিয়ে নিয়েছেন যে, আমি তাদের উভয় পায়ের অলংকার দেখছিলাম। তারা উভয়েই মশক পিঠে বহন করে সাহাবীগণের মুখে পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন। আবার ফিরে গিয়ে মশক ভর্তি করে নিয়ে এসে সাহাবীগণের মুখে পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন। (বোখারি : ২৬৮২)।
যুদ্ধের ময়দানে নারীদের অবদান : যুদ্ধের ময়দানে নারীরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের জিহাদে অন্যতম কাজ ছিল আহত সৈন্যদের সেবা করা ও চিকিৎসা প্রদান। রুফাইদা বিনতে সাদ আল-আসলামিয়া ছিলেন ইসলামের প্রথম নার্স ও চিকিৎসক। তার অধীনে নারীদের একটি টিম পরিচালিত হতো। চিকিৎসা সেবায় নিবেদিত উম্মে আতিয়া (রা.), আয়েশা সিদ্দিকা (রা.), উম্মে সালিম (রা.), উম্মে উমারা (রা.), ফাতেমা (রা.) ও রুবাইয়ি বিনতে মুআববিজ (রা.)-এর নাম উল্লেখযোগ্য। রুবাইয়্যি বিনতে মুআব্বিজ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা (যুদ্ধের ময়দানে) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে থাকতাম। আমরা লোকদের পানি পান করাতাম, আহতদের পরিচর্যা করতাম এবং নিহতদের মদিনায় পাঠাতাম। ( বোখারি : ২৬৮৪)।
যোদ্ধা নারীদের মূল্যায়ন : ইসলামে যোদ্ধা নারীদের মূল্যায়ন অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের। তারা কেবল নিজেদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার কথা ভাবেননি, বরং ইসলামের রক্ষার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে, এ ধরনের বীরত্ব ও আত্মত্যাগকে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে মূল্যায়ন করা হয়। সালাবা ইবনে আবু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত যে, উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মদিনার কিছু সংখ্যক মহিলার মধ্যে কয়েকখানা (রেশমি) চাদর বণ্টন করেন। তারপর একটি ভালো চাঁদর অবশিষ্ট রয়ে গেল। তার কাছে উপস্থিত একজন তাকে বললেন, হে আমিরুল মোমেনিন! এ চাদরটি আপনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নাতিন উম্মে কুলসুম বিনতে আলী (রা.); যিনি আপনার কাছে আছেন, তাকে দিয়ে দিন। উমর (রা.) বলেন, উম্মে সালীত (রা.) এই চাদরটির অধিক হকদার। উম্মে সালীত (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে বায়আত গ্রহণকারিণী আনসার মহিলাদের একজন। উমর (রা.) বলেন, কেননা, উম্মে সালীত (রা.) উহুদের যুদ্ধে আমাদের কাছে মশক ভর্তি পানি বহন করে নিয়ে আসতেন। (বোখারি : ২৬৮৩)।
লেখক : শিক্ষক ও খতিব