দ্বিখণ্ডিত চাঁদ নবীজির সত্যতার প্রমাণ
শাহাদাত হোসাইন
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সত্যতার প্রমাণসহ নবীরাসুলকে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর বাণী প্রচারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বিরুদ্ধপক্ষ কিংবা স্বপক্ষের লোকের চাহিদা অনুসারে নবীরা এসব প্রমাণের প্রয়োগ করেছেন। আবু হোরায়রা (রা.)-এর বর্ণনায় এসেছে নবীজি বলেছেন, এমন কোনো নবী নেই যাকে আয়াত-নিদর্শন, মুজেজা দেয়া হয়নি (মুসলিম : ১৫২)। নবীজিকে আল্লাহ এমন অসংখ্য নিদর্শন আর প্রমাণ দিয়েছিলেন, যা তার নবী হওয়ার প্রমাণ বহন করে। আঙুলের ইশারায় চাঁদ দ্বি-খণ্ডিত হওয়া তার নবী হওয়ার অন্যতম প্রমাণ। চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ব্যাপারে কোরআনে এসেছে, কেয়ামত কাছাকাছি হয়েছে, আর চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে। আর তারা কোনো নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, এটা তো চিরাচরিত জাদু (সুরা কামার :১)। তাফসিরকারকরা এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন, নবীজির যুগেই চন্দ্র বিদীর্ণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, নবীজির যুগে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। একখণ্ড সামনের পাহাড়ে আর অন্যখণ্ড পেছনের পাহাড়ে ছিল (তাফসেির তাবারি ২২ : ১০৫)।
দুই টুকরো চাঁদ : চাঁদ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা কখন ঘটেছিল সে ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, নবীজির হিজরতের আগে চাঁদ বিদীর্ণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল (তাফসিরে তাবারি ২২ : ১০৯)। তাফসিরে রুহুল মাআনিতে এসেছে, নবীজির হিজরতের পাঁচ বছর আগে চাঁদ বিদীর্ণের ঘটনা ঘটেছিল (১৪ : ৭৪)। এই দুই বর্ণনায় এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, নবীজি মক্কা থেকে হিজরত করার পাঁচ বছর আগে নবুয়ত প্রাপ্তির ষষ্ঠ বছর এই ঘটনা সংঘটিত হয়।
সাহাবিদের বর্ণনায় চন্দ্র-বিদীর্ণের ঘটনা : আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, নবীজির যুগে চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। তখন কুরাইশের লোকেরা বলেছিল, এটা ইবনে আবি কাবসার জাদু। সে তোমাদের জাদু করেছে। এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তোমরা দূর-দূরান্ত হতে আগত মুসাফিরদের জিজ্ঞাসা কর। তাহলে বুঝতে পারবে এটা সত্য না মিথ্যা। কুরাইশের লোকরা মুসাফিরদের সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তারা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ আমরা দেখেছি চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত হতে (তাফসিরে তাবারি ২২ : ১০৬)। আবু আব্দুর রহমান আস-সুলামির বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেছেন, আমরা মাদায়েনে অবতরণ করলাম। আমরা তখন মাদায়েন হতে এক ফারসাখ দূরত্বে অবস্থান করছিলাম। জুমার নামাজের সময় হলো, আমি এবং আমার বাবা জুমার নামাজে মসজিদে এলাম। হজরত হুজায়ফা (রা.) আমাদের জুমার খুতবা প্রদান করেন। খুতবায় তিনি বলেন, শুনে রেখ আল্লাহ বলেছেন, কেয়ামত কাছাকাছি হয়েছে, আর চাঁদবিদীর্ণ হয়েছে। নিশ্চিত জানো কেয়ামত অতি নিকটে। সাবধান! চন্দ্র কিন্ত বিদীর্ণ হয়েছে এবং দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। শুনে রেখ! আজকের দিনটি তোমার কর্মক্ষেত্র আর আগামীকাল তোমার আমলের। (তাফসিরে ইবনে কাসির ৭ : ৪৭১)।
অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মক্কার কাফের নেতা ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা, আবু জাহাল ইবনে হিশাম, আস ইবনে ওয়েল, আস ইবনে হিশাম, আসওয়াদ ইবনে আবদে ইয়াগুস, আসওয়াদ ইবনুল মুত্তালেব, রাবিয়াহ ইবনুল আসওয়াদ, নজর ইবনুল হারেস নবীজির নিকট এসে বললেন, আপনি যদি সত্যিই নবী হন তাহলে আমাদের জন্য চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত করুন। যার একখণ্ড আবু কুবাইস পর্বতে থাকবে আরেক খণ্ড কায়নুকা পর্বতে থাকবে। নবীজি তাদের বললেন, যদি আমি তা করে দেখাই তাহলে কি তোমরা ঈমান আনবে? তারা বললেন, হ্যাঁ। সেটি ছিল ১৪ তারিখ পূর্ণ পূর্ণিমার রাত। তখন নবীজি আল্লাহর কাছে এই মর্মে দোয়া করেন যে, তারা যা চাচ্ছে তা যেন হয়। তখন চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। একখণ্ড জাবালে আবু কুবাইসে আরেক খণ্ড কায়নুকায়। নবীজি তখন চিৎকার করে করে বলছিল, হে আবু সালমা ইবনে আব্দুল আসাদ, হে আরকাম ইবনুল আরকাম তোমরা সাক্ষ্য থেক (তাফসেির রুহুল মাআনি ১৪:৭৪)। অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মক্কাবাসী সকলে নবীজির কাছে সমবেত হয়ে বললেন, আপনি আমাদের এমন কোন নিদর্শন দেখাতে পারবেন কি, যার দ্বারা আমরা বুঝতে পারব যে, আপনি আসলেই আল্লাহর নবী? তখন জিবরাইল নবীজির কাছে এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ আপনি মক্কাবাসীদের বলুন, এই রাতে নিদর্শন দেখানো হবে সুতরাং তারা সকলে যেন সমবেত হয়। জিবরাইলের এ কথা নবীজি তাদের জানিয়ে দেন। চৌদ্দ তারিখ পূর্ণিমার রাতে তারা সবাই বের হয়। সবার সম্মুখে চাঁদকে বিদীর্ণ করা হয়। যার একাংশ সাফায় আরেকাংশ মারওয়ায় চলে যায়। চাঁদকে দু’টুকরো হতে দেখে সবাই হতবিহ্বল হয়ে নিজেদের চোখ কচলাতে থাকে এবং চোখ মুছে আবার তাকায়। এবারও চাঁদকে দ্বিখণ্ডিতই দেখেন। তারা আবার চোখ মুছে পুনরায় তাকায় কিন্তু না আসলেই চাঁদ দু’টুকরোই দেখাচ্ছে। তখন তারা বলল, নাহ, আমাদের জাদু করা হয়েছে। চাঁদ দু’টুকরো হতে পারে না (তাফসিরে রুহুল মাআনি ১৪ : ৭৫)। আসলে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে আসমানেই ছিল। একাংশ অন্যাংশ থেকে আলাদা হয়ে কিছু সময়ের জন্য দূরে অবস্থান করেছিল। কতেক গল্পকার বলেন যে, চাঁদ দু’টুকরো হয়ে এক টুকরো নবীজির পকেটে ঢুকে যায় এবং তা আস্তিন দিয়ে বড় হয়ে আসে। এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কল্প-কাহিনি। এর কোনো ভিত্তি নেই। আবার কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, আসর থেকে রাত অবধি চাঁদ দ্বিখণ্ডিত অবস্থায় থাকে। এই কথাটিরও কোনো সত্যতা নেই (তাফসিরে রুহুল মাআনি ১৪ : ৭৫)। সারকথা হলো, নবীজির আঙুলের ইশারায় চাঁদ দু’খণ্ড হওয়া এটা ছিল মুহাম্মদ (সা.)-এর মুজেজা। তার নবুওয়তের জ্বলন্ত এক প্রমাণ।
লেখক : খতিব, বাইতুল আজিম জামে মসজিদ, রংপুর