কারো প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি, স্নেহমমতা কিংবা কারো কোনো গুণের প্রতি মুগ্ধতা থেকে হৃদয়ের গভীরে এক ধরনের ভালো লাগা সৃষ্টি হয়। হৃদয়ের এ আবেগ ও প্রাণোচ্ছ্বাসকে ভালোবাসা বলে ব্যক্ত করা হয়। পৃথিবীতে মানুষ নানা কারণে একে অপরকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। সে ভালোবাসায় হয়তো কারো মানসিক প্রশান্তি থাকে। থাকে আর্থিক প্রসন্নতা কিংবা থাকে শুধু যৌবন তাড়িত মুগ্ধময় আবেগের বশে কারো সান্নিধ্য লাভের কামনা বা সাধনা। এমন ভালোবাসা প্রেয়সীর রূপলাবণ্য বা গুণের উপস্থিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আবেগের ঘোর বা রেশ কেটে গেলে শূন্যে মিলিয়ে যায় প্রেমের স্তুতি ও বন্দনা। এছাড়া এ রূপক ভালোবাসা দুনিয়ার সীমা ছাড়িয়ে অনন্তকালে প্রবেশ করে না। মৃত্যুর পর অনন্তকালের সঙ্গী হয় যে ভালোবাসা সেটাই প্রকৃত ভালোবাসা। যে ভালোবাসা মানুষকে প্রকৃতপক্ষেই মনুষ্যত্ব বিকাশে সহায়ক হয়, যে ভালোবাসায় মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতে প্রস্ফুটিত ফুলের মতো কাঙ্ক্ষিত ও খুশবুময় হয়, সেটা অপার্থিব ভালোবাসা; নবীরাসুলের প্রতি ভালোবাসা। দুনিয়ার সবকিছুর ঊর্ধ্বে হতে হয় এ ভালোবাসা। কেননা, নবীর প্রতি এভাবে ভালোবাসা নিবেদন করা মোমেনের ঈমান। দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা লাভ করার পূর্বশর্ত। হাদিস থেকে এমনটাই জানা যায়। নবী (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মোমেন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতামাতা, সন্তান-সন্ততি ও সমস্ত মানব হতে অধিক প্রিয় না হব। (বোখারি:১৫, মুসলিম:৪৪)।
রাসুলের অনুসরণে ঈমানের পূর্ণতা : পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে মুহাম্মদ (সা.) কে অনুসরণ করার নির্দেশ রয়েছে। তাই মানবজাতির জন্য আবশ্যক হলো, ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) এর যথাযথ অনুসরণ ও আনুগত্য করা। রাসুল (সা.) কে অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশ মান্য কর এবং শোনার পর তা থেকে বিমুখ হয়ো না।’ (সুরা আনফাল: ২০)। আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশ মান্য করা ঈমানের পরিচায়ক। রাসুলের অনুসরণ করার মাধ্যমেই ঈমান পূর্ণতা পায়। প্রকৃত মোমেন ব্যক্তি কখনো আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশ লঙ্ঘন করতে পারে না। কেননা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য ও যথার্থ অনুসরণ ছাড়া মোমেন হওয়া যায় না। আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য ও যথার্থ অনুসরণ মোমেন হওয়ার পূর্বশর্ত। এ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা স্পষ্ট করে বলেন, ‘ আল্লাহ এবং তার রাসুলের হুকুম মান্য কর, যদি ঈমানদার হয়ে থাক।’ (সুরা আনফাল:১)।
নবীপ্রেমে সফলতা : আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য ছাড়া এ প্রেম ও ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। কেননা, এ প্রেমের মাঝেই যে রয়েছে সফলতা। আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রেমময় আনুগত্যে মহাসাফল্য রয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যে কেউ আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে।’ (সুরা আহজাব : ৭১)। পার্থিব জীবন একদিন শেষ হয়ে যাবে। পরকালীন জীবন ক্ষয়, লয়হীন ও অবিনশ্বর। তা কখনো শেষ হবে না। অতএব, যেসব লোক পরকালীন সুখ শান্তির অধিকারী হবে, তারাই প্রকৃত সফল। যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করে তারা চির সুখের জান্নাতের অধিকারী হয়ে সফল হবে। এটাই কাঙ্ক্ষিত সফলতা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে কেউ আল্লাহ ও রাসুলের আদেশমতো চলে, তিনি তাকে জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন, যেগুলোর তলদেশ দিয়ে ঝরনা প্রবাহিত হবে। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। এ হল বিরাট সাফল্য।’ (সুরা নিসা: ১৩)।
নবীপ্রেমে আল্লাহর সাড়া : নবীকে ভালোবাসা ছাড়া আল্লাহকে ভালোবাসার দাবি অবান্তর। আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ ও ভালোবাসা পেতে হলে কোরআন ও হাদিসমতে যথাযথ নিয়মে নবী মুহাম্মদ (সা.) কে ভালোবাসতে হবে। কেউ যখন মহান আল্লাহ ও তার রাসুলকে অনুসরণ করে, তখন আল্লাহতায়ালাও ওই ব্যক্তিকে ভালোবাসেন ও মর্যাদা দান করেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) এর আনুগত্য করার মাধ্যমে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহতায়ালার মহব্বত ও ভালোবাসা লাভ করা যায়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদের ভালবাসেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন অতি ক্ষমাশীল, দয়ালু। বলে দাও, আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য কর। বস্তুত যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদের ভালোবাসেন না।’(সুরা আলে ইমরান : ৩১-৩২)। এ আয়াত থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে রাসুলের আনুগত্য জরুরি। রাসুলের (সা.) আনুগত্য ছাড়া আল্লাহর ভালোবাসা লাভ করা সম্ভব নয়। বান্দা আল্লাহর সাড়া পেতে হলে আগে নিয়মমাফিক নবী (সা.) কে ভালোবাসতে হবে।
রাসুলকে গালি বা ব্যঙ্গ করা কুফরি : নবী মুহাম্মদ (সা.) এর শানে বেয়াদবি করা দুর্ভাগার লক্ষণ। ইসলামি শরয়ি বিধান মতে কেউ নবী (সা.) এর শানে বেয়াদবি করলে তাকে মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী বলে। মুহাম্মদ (সা.) কে বা অন্য কোনো নবীকে কেউ গালি দিলে অথবা মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি বিদ্বেষবশত তার দোষত্রুটি বর্ণনা করলে, তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ-উপহাস করলে উক্ত ব্যক্তির ঈমান চলে যাবে। সে মুরতাদ বলে আখ্যায়িত হবে। ইসলামি শাসন ও বিচার ব্যবস্থায় বিচারক তাকে তাওবা করতে বাধ্য করবে। সে তাওবা না করলে তাকে হত্যা করা ওয়াজিব। (ফতওয়া শামি: ৬/৩৭২, ফাতাওয়া কিতাবুন নাওয়াযেল: ১/৪১৯-৪২০)।
লেখক : মুহাদ্দিস ও মিডিয়াকর্মী