ইসলামের মর্যাদা উচ্চকিত করার পেছনে পুরুষদের ত্যাগ, কুরবানি যেমন ছিল তেমনই ছিল নারীদের অবদানও। ইসলাম প্রচারের সূচনাতে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) যে অবর্ণনীয় অমানবিক কষ্ট, নির্যাতন শিকার করেছেন তা কারও অজানা নয়। পুরুষদের যেমন আত্মত্যাগ ছিল তেমনি ছিল নারীদেরও। তাদের সেই ত্যাগ কুরবানিও ছোট করে দেখার নয়। ইসলামের জন্য সর্বপ্রথম যে নারী সাহাবি নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি হজরত সুমাইয়া বিনতে খাব্বাত (রা.)। তিনিই ইসলামের প্রথম শহীদ। (আল-আ’লাম : ৩/১৪০, আল বিদায়া : ৩/৫৯)।
বংশ পরিচয় : সুমাইয়া বিনতে খাব্বাতের বংশ পরিচয় তেমন একটা জানা যায় না। ইবনে সাদ বলেছেন, তার পিতার নাম ‘খাব্বাত’ (তাবাকাত : ৮/২৬৭) কিন্তু বালাজুরি বলেছেন খাইয়াত। (আনসাবুল আশরাফ : ১/১৫৭)।
তিনি মক্কার আবু হুজাইফা ইবনে আল-মুগীরা আল মাখযুমির দাসী ছিলেন। (তাবাকাত :৮/২৬৮)। সুমাইয়া ছিলেন একজন হাবশী বা আবিসিনিয়ান (বর্তমান ইথিওপিয়া) কৃষ্ণাঙ্গ দাসী। তার স্বামী ছিলেন ইয়াসির ইবনে আমির (রা.)। তিনি ইয়ামেনের মাজহাজ গোত্রের আনসি শাখার সন্তান ছিলেন। তার দুই ভাই হারিস ইবনে আমির ও মালিক ইবনে আমিরকে সঙ্গে নিয়ে তাদের নিখোঁজ চতুর্থ ভাইয়ের সন্ধানে এসে ইয়াসির মক্কায় থেকে যান এবং আবু জাহেলের চাচা আবু হুযায়ফা ইবনে আল মুগীরা আল মাখযুমির সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হন। আবু হুজাইফা তার দাসী সুমাইয়া বিনতে খাব্বাতকে ইয়াসিরের সাথে বিয়ে দেন এবং এই ঘরেই আম্মার ইবনে ইয়াসিরের জন্ম হয়।
মক্কায় যখন ইসলামের সূচনা হয় তখন সুমাইয়া (রা.) বার্ধক্যে উপনীত। তিনি, স্বামী ইয়াসির ও ছেলে আম্মার ইবনে ইয়াসিরসহ তখন গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেন। এবং কিছুদিন পরেই ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন, ফলে তার পরিবার কুরাইশদের অত্যাচারের রোষানলে পড়েন।
মুশরিকদের অত্যাচার : মক্কায় হজরত সুমাইয়ার পরিবারের ওপর কুরাইশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না (যেহেতু তারা বহিরাগত ও দাস ছিলেন)। তাই তারা অনেক নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। আবু জাহেল ও তার সঙ্গী কুরাইশরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অত্যাচার চালাত। তবে মুহাম্মাদ (সা.) তার চাচা আবু তালিব ও হজরত আবু বকরের দ্বারা তাদের নিরাপত্তার চেষ্টা করেছিলেন। (হায়াতুস সাহাবা : ১/২৮৮)।
কুরাইশরা তাদের পরিবারের সকলকে লোহার বর্ম পরিয়ে প্রচণ্ড রোদে দাঁড় করিয়ে রাখত। (আল-বিদায়া : ৩/২৮, কানযুল উম্মাল : ৭/১৪, আল-ইসাবা : ৪/৩৩৫)। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, একদিন মুহাম্মাদ (সা.) যাত্রা পথে আম্মার ইবনে ইয়াসিরের পরিবারকে শাস্তি দিতে দেখেন। এবং তাঁদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। (হায়াতুস সাহাবা : ১/২৯১)।
আবদুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.) বলেন, মুহাম্মাদ (সা.) তাদের অত্যাচারিত অসহায় অবস্থায় দেখে বলেন, ‘হে ইয়াসিরের পরিবারবর্গ, ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো! তোমাদের জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/৩২০, আল ইসাবা : ৩/৬৪৭, আনসাবুল আশরাফ : ১/১৬০)।
ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, এই অত্যাচারের সময়েই সুমাইয়া, সুমাইয়ার স্বামী ইয়াসির ইবনে আমির ও ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে ইয়াসির শাহাদত বরণ করেন।
শাহাদতের কাহিনি : প্রতিদিনের মতো সারা দিন অত্যাচারিত হয়ে সুমাইয়া বিনতে খাব্বাত বাড়ি ফিরলেন। সন্ধ্যায় আবু জাহেল অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকল। কিন্তু সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই যেন। একপর্যায়ে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে বৃদ্ধা এই নারীর দিকে বর্শা ছুড়ে মারে আবু জাহেল। সেটি তার পেটের নিম্নভাগে আঘাত হেনে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে সুমাইয়া (রা.) শাহাদত বরণ করেন। লাভ করেন ইসলামের প্রথম শহীদ হওয়ার গৌরবোজ্জ্বল মর্যাদা। (তাবাকাত : ৮/২৬৫, আল-বিদায়া : ৩/৫৯, সুয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা : ৫০৬)।
ঘটনা থেকে শিক্ষা : সুমাইয়া (রা.)-এর এই ঘটনা থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছু আছে। শত কষ্ট আর নির্যাতনের পরও একচুলও নড়েননি তাওহিদের পথ থেকে। ঈমান বড় অমূল্য জিনিস। আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাদের ঈমানের যত্ন নিয়েছেন। শত অত্যাচার সহ্য করেছেন। সর্বোচ্চ মাত্রায় নির্যাতন চলেছে তাদের ওপর তবুও তারা অনড়, অবিচল ছিলেন ঈমান ও ইসলামের ওপর। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারিমে বলেন, ‘মুমিনদের মধ্যে অনেকে আল¬াহর সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। আর তারা তাদের অঙ্গীকার আদৌ পরিবর্তন করেনি’ (সুরা আহযাব : ৩৩/২৩)।
খাঁটি মুমিন হওয়া ছাড়া কখনোই পরকালে সফল হওয়া যাবে না। আল¬াহতায়ালা বলেছেন, ‘যারা ঈমান আনয়ন করেছে সেসব বিষয়ের ওপর, যা কিছু তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেসব বিষয়ের ওপর, যা তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর পরকালকে যারা নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করে, তারাই নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথপ্রাপ্ত, আর তারাই যথার্থ সফলকাম।’ (সুরা বাকারা : ৪-৫)।
সুমাইয়া (রা.)-এর এই ঘটনা আমাদের আরও শিক্ষা দেয়, নবীপ্রেমের কাছে, নবীজির ওপর অটল বিশ্বাসের কাছে জীবন কিছুই না। খুবই তুচ্ছ বিষয়। আল¬াহ ও রাসুলের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস আর ভালোবাসা না থাকলে কি এভাবে কেউ নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পারে!
সুমাইয়ার শাহাদাতের এ ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য দেদীপ্যমান উদাহরণ। এমন আরও অসংখ্য নজির আছে যুগে যুগে। তাওহিদ ও নবীপ্রেম ছাড়া ঈমানেরও কোনো দাম নেই। রাসুল (সা.) বলেছেন: ‘তোমাদের কেউ (পরিপূর্ণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হই।’ (বোখারি: ১৫)।
সুমাইয়া (রা.) এর শাহাদতের ঘটনায় তাওহিদে বিশ্বাস ও নবীপ্রেমের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে। আল্লাহর প্রতি তার কেমন অটল বিশ্বাস আর ভালোবাসা ছিল! কেমন প্রেম ছিল নবী (সা.) এর প্রতি! শত অমানবিক নির্যাতন সয়েছেন তবুও ঈমানহারা হননি! একজন নারীর এ দৃঢ় ঈমান অন্য নারীদের জন্য অনুসরণীয়। মুসলিম নারীত্বের জন্য গৌরব ও মর্যাদার।