সদাচরণ হচ্ছে সেরা সম্পর্কের নাম। দয়া ও ভদ্রতা মানুষের গুণের অলঙ্কার। নম্রতা প্রজ্ঞার প্রধান ও নিরাপত্তার দুর্গ। এটি গুণীদের নিদর্শন, সাফল্যের সোপান। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যাকে নম্রতা ও বিনয়ের গুণে গুণান্বিত করা হয়েছে, কল্যাণ তার জন্য। আর যার মধ্যে নম্রতা নেই, সে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত। (তিরমিজি : ২১৪৫)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ দয়াশীল; তিনি দয়া ও নম্রতাকে পছন্দ করেন। নম্রতা ও বিনয়ের কারণে আল্লাহ দান করেন, কঠোরতা অবলম্বনকারীদের তা দান করেন না।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৮০৭)।
নম্রতা হলো, হৃদয়ের কোমলতা, কথা-কাজে বিনয়ী হওয়া, ভদ্রোচিত কাজ করা, সহজতাকে প্রাধান্য দেয়া, উত্তম পন্থায় সবকিছুর সমাধান খুঁজে বের করা; সব কাজে সহজ ও উত্তমপন্থা অবলম্বন করা। সমাজে এমন অনেক রয়েছে, যারা তাদের কর্মকাণ্ডে সহিংস, হাত অনেক শক্ত। তাদের দুঃখ-দুর্দশা কখনও শেষ হয় না। এরা নির্দয়, অজ্ঞ, অহংকারী, কঠোর। সব কাজে তাড়াহুড়া করে। অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারে না। যে ব্যক্তি তার কাজ-কর্মে নম্রতা অবলম্বন না করে, তার জন্য পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে যায়। যে তার রাগের আনুগত্য করে, সেটাই তার আদত বনে যায়। যে দয়া ও নম্রতা পরিত্যাগ করে, তার বন্ধু-সাহায্যকারীও তাকে পরিত্যাগ করে। কবি বলেন, ‘তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ধৈর্যধারণ করো। কেননা, বুদ্ধিমানদের কাছে দয়া-নম্রতা বেশি মূল্যবান ও কল্যাণকর।’
একবার মুআবিয়া (রা.) আমর ইবনুল আস (রা.)-কে লিখে পাঠালেন, ‘নিঃসন্দেহে বিভিন্ন কাজ-কর্মে কল্যাণের বুঝ আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি অন্যতম নেয়ামত। সেই ব্যক্তিই সঠিক পথপ্রাপ্ত, যে সব ধরনের তাড়াহুড়া থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে। সে ব্যক্তিই নিরাশ হয়, যে সহনশীল নয়। যে চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করে, সে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। পক্ষান্তরে তাড়াহুড়া করলে কাজ ত্রুটিযুক্ত হয়। নম্রতার মাধ্যমে যে উপকৃত হতে পারে না, কঠোরতা তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অভিজ্ঞতা থেকে যে শিক্ষা না নেয়, জীবনে সে কখনও উন্নতি করতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের সহনশীলতা তার অজ্ঞতা ও স্বেচ্ছাচারিতার ওপর প্রাধান্য না পাবে, ততক্ষণ সে বুদ্ধিমান কিংবা বিচারক হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।’
ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) বলেন, ‘শক্তি ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করা, প্রচণ্ড রাগের সময় নিজেকে সংবরণ করতে পারা, আল্লাহর বান্দাদের সঙ্গে নম্রতা ও বিনয় অবলম্বন করা আল্লাহর পছন্দনীয় কাজসমূহের একটি।’ ইবনুল কাইয়ুম (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ্তায়ালা দয়ালু। তিনি দয়াশীলদের পছন্দ করেন। তিনি তাদের ওপর রহম করেন, যারা তার বান্দাদের ওপর রহম করে। আল্লাহতায়ালা বান্দার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখেন। তিনি এমন বান্দাদের পছন্দ করেন, যারা তার অন্য বান্দাদের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে। আল্লাহ?ক্ষমাশীল। তিনি তার সেই বান্দাদের পছন্দ করেন, যারা অন্যের প্রতি ক্ষমাশীল। আল্লাহ । তিনি সহনশীলদের পছন্দ করেন। কঠোরতাকে ঘৃণা করেন। যে মানুষের প্রতি নম্রতা প্রদর্শন করে, আল্লাহ তার প্রতি দয়াপরবশ হন। যে মানুষের প্রতি দয়া করে, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন। যে মানুষের উপকার করে, আল্লহও তার উপকার করেন। যে মানুষের অসম্মান করে, আল্লাহও তার অসম্মান করেন। যে মানুষের অকল্যাণ করার চেষ্টা করে, আল্লাহও তাকে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করেন। যে মানুষের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে, আল্লাহও তাকে তার প্রতিদান দান করেন। মোটকথা, মানুষ যেভাবে অন্যের সঙ্গে আচরণ করবে, আল্লাহও তার ইহ-পরকালে তেমন ব্যবস্থা করবেন।’
আল্লাহতায়ালা যখন কারও কল্যাণের ইচ্ছে করেন, তাকে নম্রতা ও বিনয়ের গুণ দান করেন। পক্ষান্তরে তারাই আল্লাহর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়, যাদের মধ্যে নম্রতা ও বিনয় থাকে না। সেই পরিবার অত্যন্ত সৌভাগ্যবান, যারা নম্র ও বিনয়ী। ভালোবাসা ও কোমলতা তাদের ঘরকে সুশোভিত করে তোলে। তাদের অন্তর প্রশান্ত থাকে। পক্ষান্তরে সে পরিবারের জন্য দুভোগ, যেখানে সর্বদা নিষ্ঠুরতা, ঝগড়া-ফ্যাসাদ লেগেই থাকে। কঠোরতা, মতবিরোধ আর বিভিন্ন ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা তাদের সংসারের শান্তি বিনষ্ট করে দেয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন আল্লাহ ?কোনো ঘরের অধিবাসীদের জন্য কল্যাণের সিদ্ধান্ত করেন, তখন সেই ঘরের সদস্যদের নম্রতা ও বিনয়ের গুণ দান করেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ৩০৩)। যখন কোনো ঘর থেকে নম্রতা ও বিনয় বিদায় নেয়, তখন সেই ঘরে ঝগড়া-ফ্যাসাদ, রাগ-ক্ষোভ, মতবিরোধ, সন্দেহ ও নানা অশান্তি বিরাজ করে। একজন অন্যজনের দোষ অন্বেষণ ও ক্ষতি সাধনে লিপ্ত হয়। শরিয়তে নম্রতা ও বিনয়ের মাপকাঠি হলো, ইলম অন্বেষণকারী শিক্ষার্থী অজ্ঞ ও মুর্খ ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তরে নম্রতা ও ভদ্রতা অবলম্বন করা। যে বিষয়ে শ্রোতাকে সংক্ষেপে বোঝানো সম্ভব নয়, সে বিষয় ত্যাগ করা এবং অজানা বিষয় নিয়ে আলোচনা না করা চাই। যে বিষয় শ্রোতা কিংবা প্রশ্নকারী জ্ঞাত নয়, সে বিষয়ে নম্রতা ও ভদ্রতার সঙ্গে বুঝানো কর্তব্য। কঠোরতা কিংবা অহংকার প্রদর্শন করা যাবে না। আল্লাহ বলেন, ‘সওয়ালকারীকে ধমক দেবে না।’ (সুরা দোহা : ১০)। একটি বর্ণনামতে এ আয়াতে ‘সওয়ালকারী’ দ্বারা উদ্দেশ্য তালিবে ইলম তথা জ্ঞান অন্বেষণকারী। সুতরাং যারা জ্ঞান অন্বেষণ করতে চায় ও সঠিক পথের সন্ধান করে, তাদের ধমক দেয়া যাবে না। আবু দারদা (রা.) সম্পর্কে জানা যায়, যখন তিনি হাদিসে প্রাজ্ঞ সাহাবিদের দেখতেন, তখন তার চাদর বিছিয়ে দিতেন। বলতেন, ‘রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার মানুষদের স্বাগত জানাই।’ আবু হারুন আল আবদি (রা.) আবু দারদা (রা.) সম্পর্কে বলেন, আমরা তার কাছে গেলে তিনি বলতেন, ‘আমি তাদের স্বাগত জানাচ্ছি, যাদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) ওসিয়ত করে গেছেন।’ মুআবিয়া ইবনে হাকাম আস সালিমি (রা.) বলেন, একদিন আমি রাসুল (স.)-এর সঙ্গে সালাত আদায় করছিলাম। সালাতের মধ্যে এক লোক হাঁচি দিল। আমি সালাতরত অবস্থায় ইয়ারহামুকাল্লাহ বললাম। এ ঘটনার পর অন্যান্য মুসল্লিরা আমার দিকে তাকাতে লাগল। আমি সালাতের মধ্যেই বললাম, ‘তোমরা কেনো আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছো?’ তখন তারা তাদের হাত উরুতে লাগিয়ে আমাকে চুপ থাকার জন্য ইশারা করলো। যখন বুঝতে পারলাম, অন্যরা আমাকে চুপ থাকতে বলছে, তখন আমি চুপ হয়ে গেলাম। এরপর যখন রাসুল (স.) সালাত শেষ করলেন, তখন আমি বললাম, ‘আমার পিতামাতা আপনার ওপর উৎসর্গ হোক, আমি এর আগে কখনোই আপনার মতো এমন উত্তম শিক্ষক দেখিনি, যে এত সুন্দরভাবে শিক্ষা দিতে পারেন।’ আল্লাহর শপথ! রাসুল (সা.) আমাকে মারেননি, ধমক দেননি কিংবা অভিশাপ করেননি। তিনি শুধু বলেছেন, ‘সালাতের মধ্যে সব ধরনের কথোপকথন নিষেধ। সালাত শুধু তাসবিহ, তাকবির ও কোরআন তেলাওয়াতের জন্য।’ (মুসলিম : ১২২৭)। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘এ হাদিসে রাসুল (সা.)-এর এমন উত্তম চরিত্রের ব্যাপারে বর্ণনা করা হয়েছে, যার সাক্ষ্য স্বয়ং আল্লাহ দিয়েছেন। অজ্ঞদের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর নম্রতা ও উম্মতের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর বিনয় ও ভালোবাসাও বর্ণনা করা হয়েছে।’ মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর মুফতি আল মামুন নূর