ঢাকা ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মসজিদে নববির খুতবা

পরকালে সাফল্য মিলবে যেভাবে

শায়খ ড. আবদুল মুহসিন বিন মুহাম্মদ আল কাসিম
পরকালে সাফল্য মিলবে যেভাবে

আল্লাহ সব বান্দার মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। বয়সসীমা নির্ধারিত রেখেছেন। এ নির্ধারিত সময়ই সবার জন্য ভালো কাজের চেষ্টা এবং আমলের সময়। এরপর সে রবের সঙ্গে মিলিত হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ! তোমাকে তোমার পালনকর্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে কষ্ট স্বীকার করতে হবে। অতঃপর তাঁর সাক্ষাৎ ঘটবে।’ (সুরা ইনশিকাক : ৬)। দুনিয়ার জীবন আখেরাতের তুলনায় অনেক সংক্ষিপ্ত। দুনিয়ার জীবন যত বড়ই হোক, একদিন তাকে মৃত্যুবরণ করতেই হবে। নিঃশ্বাস একবার চলে গেলে তা আর ফিরে আসবে না। বয়স যত বেশি হবে, মৃত্যু তত কাছাকাছি চলে আসবে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে গাফেল। এ কারণে বিভিন্ন ফেতনা-ফ্যাসাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘প্রাচুর্যের লালসা তোমাদের গাফেল রাখে। এভাবে তোমরা কবরে পৌঁছাও।’ (সুরা তাকাসুর : ১-২)। দিনরাতের পরিবর্তন, চাদণ্ডসূর্যের প্রদক্ষিণ, বছর অতিবাহিত হওয়া ইত্যাদিতে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে। বিশেষত এ দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে দুনিয়ার জীবন এবং এর বিভিন্ন বস্তুর ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। এগুলোর মাধ্যমে মানুষকে এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন যে, জীবন অতি দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। এ জন্য আল্লাহতায়ালা রাতদিন, চন্দ্র-সূর্য, প্রভাত এবং ফজরের কসম করেছেন। যাতে বান্দা এগুলোর প্রকৃতি দেখে ক্ষণস্থায়ী জীবন প্রসঙ্গে শিক্ষা নিতে পারে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘চাঁদের জন্য আমি বিভিন্ন মঞ্জিল নির্ধারিত করেছি। অবশেষে তা পুরোনো খেজুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। সূর্য নাগাল পেতে পারে না চাঁদের। রাত অগ্রগামী হয় না দিনের। প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে পথ চলে।’ (সুরা ইয়াসিন : ৪০-৪১)। বুদ্ধিমানরা এগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ দিনরাতের পরিবর্তন ঘটান। এতে অন্তর্দৃষ্টি-সম্পন্নদের জন্য চিন্তার উপকরণ রয়েছে।’ (সুরা নুর : ৪৪)।

বছর পার হওয়া মানে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া : বছর গত হয়, আর আমাদের জীবন ছোট হতে থাকে। প্রত্যেক দিন শেষ হয় এবং আমাদের শিক্ষা দেয় যে, যেমনিভাবে দিন শেষ হয়ে গেছে, তেমনি একটা সময় আমাদের জীবনও ফুরিয়ে যাবে। প্রত্যেক জীবের জন্য বয়স নির্ধারিত। তাদের অবশ্যই শেষে পৌঁছাতে হবে। নতুন বছরের সূর্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এখনও সুযোগ আছে। আল্লাহর রহমত এবং ক্ষমার দুয়ার এখনও খোলা। সে-ই সফল, যে তার জীবনের সময় এবং ভালো কাজের এমনভাবে হিসাব করে, যেভাবে মানুষ ব্যবসার লাভণ্ডলোকসানের হিসাব কষে থাকে। প্রত্যেক মানুষের জন্য তার জীবনের বয়সই সব। এ সময়ের সব থেকে বড় নেয়ামত হচ্ছে, সুস্থতা ও নিরাপত্তা। অথচ অধিকাংশ মানুষই এ নেয়ামত কাজে লাগাতে পারে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘অধিকাংশ মানুষ আল্লাহতায়ালার দুটি নেয়ামত সম্পর্কে গাফেল। তার একটি হলো, সুস্থতা; আর অপরটি অবসর।’ (বোখারি)। মানুষ তার জীবনে দীর্ঘ বয়স আশা করে। দুনিয়ার ধন-সম্পদের ব্যাপারে লোভ-লালসা করে। এগুলো তাদের অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর ব্যাপারে গাফেল করে দেয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আদম সন্তান বৃদ্ধ হয়ে যায়; কিন্তু তার দুটি বিষয়ের আক্ষেপ থেকে যায়। তা হলো, সম্পদ এবং বয়স বেশি পাওয়ার লোভ।’ (বোখারি)।

ক্ষণস্থায়ী জীবনে আমাদের কী করা উচিত : দুনিয়ার সব ক্ষেত্রে উত্তম কাজ করা উচিত। যাতে সময়টা এমন কাজে ব্যয় হয়, যার মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান অর্জন করা যায়। বুদ্ধিমানরা কখনও জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুতে খুশি হতে পারে না। তারা সর্বদা এমন কাজে ব্যস্ত থাকে, যা তাদের নেকি বৃদ্ধি করে এবং গোনাহ মাফের কারণ। যে আল্লাহর আনুগত্য এবং নেক কাজের ওপর অটল থাকতে না পারে, তার গোনাহের ধারে-কাছে যাওয়া উচিত নয়। তবে মনে রাখা উচিত, যে ভালো কাজের পর ভালো কাজ করতে না পারে, সে ধীরে ধীরে ক্ষতির দিকে চলে যাবে। আর যে নেকির কাজ করে সামনে অগ্রসর হতে না পারে, সে গোনাহের পর গোনাহ করতে থাকে। জীবনে শক্তি-সামর্থ্যরে শেষে দুর্বলতা চলে আসা একটি অবশ্যম্ভাবী বিষয়। সুস্থতার পর অসুস্থতা একটি স্বাভাবিক বিষয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ দুর্বল অবস্থায় তোমাদের সৃষ্টি করেন। অতঃপর দুর্বলতার পর শক্তি দান করেন। শক্তির পর দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছে, সৃষ্টি করেন। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ (সুরা রুম : ৫৪)।

পার্থিব জীবনের তুলনা : দুনিয়ার জীবন এমন শস্যক্ষেতের মতো, যা বৃষ্টির পর বেড়ে ওঠে। এরপর সুন্দর সজীব হয়ে ওঠা দেখে ক্ষেতের মালিক খুশি হয়ে যায়। এর অল্প কিছুদিন পরেই শুকিয়ে যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা জেনে রাখো, পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, সাজসজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা এবং ধন ও জনের প্রাচুর্য ছাড়া আর কিছু নয়। যেমন- এক বৃষ্টির অবস্থা, যার সবুজ ফসল কৃষকদের চমৎকৃত করে। এরপর তা শুকিয়ে যায়। ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও। তারপর তা খড়-কুটা হয়ে যায়। আর পরকালে আছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ বৈ কিছু নয়।’ (সুরা হাদিদ : ২০)।

মুখে শুভ্রতার ছাপ মৃত্যুর সতর্কবার্তা : যার বয়স এ পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তার চেহারায় শুভ্রতা প্রকাশ পায়, তাহলে বুঝতে হবে, এটা তার জন্য মৃত্যুর সতর্কবার্তা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেখানে তারা আর্তচিৎকার করে বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! বের করুন আমাদের। আমরা সৎকাজ করব। আগে যা করতাম, তা করব না। (আল্লাহ বলবেন) আমি কী তোমাদের এতটা বয়স দিইনি, যাতে যা চিন্তা করার বিষয়, চিন্তা করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিল। অতএব, শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করো। জালেমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।’ (সুরা ফাতির : ৩৭)। উম্মতে মুহাম্মদের বয়স হবে ষাট থেকে সত্তরের মধে। যার বয়স ষাট হবে, তার এ জীবনের সুযোগ নিয়ে আর প্রশ্ন তোলা যাবে না। আল্লাহ?তায়ালা এমন ব্যক্তির ওজর গ্রহণ করেন না, যার বয়স ষাট হয়ে গেছে। এ জন্য রাসুল (স.) শক্তি-সামর্থ্যকে অসুস্থতার আগে এবং ধন-সম্পদকে অভাবের আগে গনিমত মনে করতে বলেছেন। সময়-সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য উৎসাহিত করেছেন।

পাঁচটি বস্তু বড় নেয়ামত : রাসুল (সা.) এক ব্যক্তিকে নসিহত করতে গিয়ে বলেন, ‘পাঁচ জিনিসকে পাঁচ জিনিস আসার আগে নেয়ামত মনে করো। তা হলো- বৃদ্ধ বয়সের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দারিদ্রতার আগে সচ্ছলতাকে, ব্যস্ততার আগে অবসরকে এবং মৃত্যুর আগে জীবনকে।’ (সুনানে নাসাঈ)। এ বিষয়গুলোকে গনিমত মনে করার উদ্দেশ্য হলো, এমন সময় বেশি বেশি নেক আমল করবে, সময়টা কাজে লাগাবে, খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকবে এবং ভালো কাজের দিকে অগ্রসর হবে। একজন নেক বান্দার অবস্থা এমন হওয়া উচিত যে, তার আজকের দিন গতকাল থেকে উত্তম হবে। আবার আজ থেকে আগামীকাল আরও উত্তম হবে। আর যদি সবদিন একই রকম হয়, তাহলে বুঝতে হবে, সে ধোঁকার মধ্যে আছে। সময়ের সবচেয়ে উত্তম ব্যবহার হলো, ইলম অর্জন করা, কোরআন তেলাওয়াত করা, সকাল-বিকালের জিকির, হালাল রুজির জন্য চেষ্টা, সৃষ্টির সঙ্গে উত্তম ব্যবহার এবং তার প্রয়োজন পূরণে ব্যস্ত থাকা। দুনিয়াতে সময়ের পরিবর্তন হয়। এক ব্যক্তি তার জীবনে স্বচ্ছলতা, অভাব, শক্তি-সামর্থ্য, দুর্বলতা ইত্যাদির মধ্য দিয়েই তার জীবন অতিবাহিত করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।’ (সুরা বাকারা : ১৫৫)। এর মাধ্যমে আল্লাহর উদ্দেশ্য হলো, বান্দা যেন সর্বাবস্থায় তার ইবাদতে মশগুল থাকে। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ছাড়া ধৈর্য পূর্ণ হয় না। আর আল্লাহ?র নেয়ামতের গুরুত্ব কিংবা কার্যকারিতা সে-ই জানে, যে নেয়ামত চলে যাওয়ার পরে কষ্টের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করেছে।

আল্লাহ তওবাকারীকে পছন্দ করেন : সর্বাবস্থায় বান্দার কিছু ভালো কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা উচিত। সর্বদা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা কল্যাণের অন্যতম কারণ। বান্দার আল্লাহর একত্ববাদের ওপর বিশ্বাস, ঈমান সুরক্ষার জন্য তাকদিরে বিশ্বাস করা এবং শরিয়তের ওপর আমল উভয়টিই আবশ্যক। মানুষ যখন বিভিন্ন বিপদাপদের ভেতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে, তখন শয়তান বিভিন্নভাবে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে। মানুষকে দিয়ে খারাপ কাজ করানোর ফিকিরে থাকে। সর্বাবস্থায় তওবা করা ছাড়া বান্দার জন্য অন্য কোনো কিছুই কার্যকর নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো। যাতে সফলকাম হও।’ (সুরা নুর : ৩১)। আল্লাহর কাছে কৃত অন্যায়ের জন্য তওবা করা বড় ইবাদত। আল্লাহ তওবা অনেক পছন্দ করেন। বান্দা অলসতা এবং গোনাহের কাছাকাছি হয়। ভুল করাটা মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি। এ জন্য আমাদের উচিত, কৃত অন্যায় এবং ভুল থেকে আল্লাহর কাছে তওবা করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত। আর উত্তম সেই ব্যক্তি, যে তওবা করে। যে কোনো খারাপ বা অন্যায় কাজ করে ফেলে, তার বেশি বেশি তওবা করা এবং বেশি বেশি নেক আমলের মাধ্যমে কৃত অন্যায়কে মিটিয়ে ফেলা উচিত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘দিনের দুই প্রান্তেই নামাজ ঠিক রাখবে এবং রাতের প্রান্তভাগে পুণ্য কাজ অবশ্যই পাপ দূর করে দেয়। যারা উপদেশ গ্রহণ করে, তাদের জন্য এটি এক মহাস্মারক।’ (সুরা হুদ : ১১৪)।

তওবার পরে নেক আমলের গুরুত্ব : রাসুল (সা.) মুয়াজ (রা.)-কে অসিয়ত করে বলেন, ‘খাঁটি তওবার পরে বেশি বেশি নেকির কাজ করো। নেকির কাজ গোনাহকে মিটিয়ে দেয়।’ অন্যায় করার পরে তওবা নসিব হওয়া আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাধ্যম। কেননা, যে ব্যক্তি খাঁটি তওবা করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন। তাকে মাফ করে দেন। আর যে গোনাহের পর তওবা করে, আল্লাহতায়ালা তার মৃত্যুর আগেও তওবা নসিব করেন। কিন্তু যে ব্যক্তি তওবা না করে, বরং আল্লাহর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার হয়তো তওবা ছাড়াই মৃত্যু চলে আসবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশতঃ মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে। এরাই হলো সেসব লোক, যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, রহস্যবিদ।’ (সুরা নিসা : ১৭)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা বান্দার তওবা ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তার মৃত্যুর গড়গড়া চলে আসে।’ পরকালের প্রস্তুতি গ্রহণ করা চাই। আল্লাহর শাস্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য সর্বদা চেষ্টা করা উচিত।

মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- আল মামুন নূর

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত