মানবেতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও বর্বর সময় ছিল জাহেলি যুগ। মানবতা বিবর্জিত পৃথিবী যখন অবিশ্রান্ত চিৎকারে মানব মুক্তির পরম আর্তি জানাচ্ছিল, মানুষ ছিল শান্তিহারা ও অধিকার বঞ্চিত, নির্মমভাবে অত্যাচারিত ও লাঞ্ছিত, তখন মানবতার চির মুক্তির দূত হয়ে পৃথিবীতে এলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.)। যিনি ছিলেন এতিমের কান্না মোচনকারী, অবলা নারীকে সুমহান মর্যাদা দানকারী, উৎপীড়িত ও দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মানবজাতিকে চির মুক্তি দানকারী।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় হিলফুল ফুজুল : ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন মানবদরদী। আবদুল মুত্তালিবের মতো অবিসংবাদিত নেতার দৌহিত্র হওয়ার সুবাদে সমাজ-সভ্যতা ও সমাজে পালিত রীতি-নীতি গভীরভাবে পরখ করার সুযোগ পান। ১৫ বছর বয়সে ফিজার যুদ্ধের চরম বীভৎস রূপ নিজ চোখে দেখে কোমল হৃদয়ে যে মানবতাবোধ জেগেছিল, তার ফলস্বরূপ নবুওয়ত লাভের পূর্বেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সুদূর প্রসারী লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক সেবা সংস্থা। সমাজে সূচিত হলো শান্তির সুশীতল ধারা। মক্কার কোরাইশরা তাঁর অতুলনীয় ন্যায়-নিষ্ঠা ও অন্যের অধিকার রক্ষায় সতত বিমুগ্ধ হয়ে তাঁকে ভূষিত করল ‘আল আমিন’ উপাধিতে। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/১৩৩-১৩৫)।
প্রাণের অধিকার প্রতিষ্ঠা : মানুষের প্রাণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.) বিদায় হজের দিন সোয়া লক্ষ্য সাহাবির সামনে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘আজকের এ দিনে, এ স্থানে, এ মাসে যেমনিভাবে একে অপরের জানমালের ওপর অবৈধ হস্তক্ষেপ করা হারাম, ঠিক তেমনিভাবে আজ থেকে কেয়ামত পর্যন্ত একে অপরের জানমালের ওপর অবৈধ হস্তক্ষেপ করা হারাম।’ (মুুসলিম : ১২১৮)।
অমুসলিমদের জীবনে সুরক্ষা : রাসুল (সা.)-এর যুগে মুসলমান খ্রিষ্টান, ইহুদি, মুশরিক নির্বিঘ্নে পূর্ণ অধিকারে একসঙ্গে এক সমাজে বসবাস করার সুযোগ পেয়েছিল। অসম শক্তিধর গোষ্ঠীতে পরিণত হওয়ার পরও মুসলমান অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকে হত্যা করেনি। কারণ রাসুল (সা.) মুসলমানদের শিখিয়েছিলেন প্রকৃত মানবাধিকার। পৃথিবীর সকল মানুষ মানব জাতি হিসেবে এক ও অভিন্ন জাতি। এ কারণেই মহানবী (সা.) সত্য ও মানবতার বিশাল কল্যাণের স্বার্থে যদিও জিহাদের নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু সে নির্দেশও ছিল মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মূর্ত দলিল। অমুসলিমদের জানমালের ব্যাপারে তিনি যে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যিই অবিস্মরণীয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি (হত্যার যথাযোগ্য কারণ ছাড়া) কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ (বোখারি : ৩১৬৬)।
অমুসলিম নারী-শিশু ও বৃদ্ধের অধিকার : জিহাদে পাঠানোর সময় রাসুল (সা.) তাঁর সঙ্গীদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিতেন, ‘তোমরা যুদ্ধের ময়দানে বৃদ্ধ, শিশু ও নারীদের হত্যা করো না।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৬১৪)। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) শিশু ও নারীদের হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। (বোখারি : ৩০১৫, মুসলিম : ১৭৪৪)।
গরিবের অধিকার : আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) গরিব, অসহায় ও বঞ্চিতদের জন্যও রেখেছেন তাদের প্রাপ্য অধিকার। এরশাদ হচ্ছে, ‘ধনীদের সম্পদে রয়েছে বঞ্চিত ও প্রার্থী মানুষের অধিকার।’ (সুরা জারিয়াত : ১৯)। এ অধিকারের কল্যাণেই গরিবরা দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসেছিল। তারা এ কথা শুনে অবাক ও বিস্ময়াভিভূত হয়েছিল, আবদুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ (সা.)-এর আনীত ধর্মে ‘অধিকার’ আছে। এ ‘অধিকার’ শব্দটাই যেন তাদের কাছে ‘সোনার হরিণ’ মনে হতো। কারণ শতাব্দীর পর শতাব্দী পর্যন্ত তাদের ‘অধিকার’-এর ছায়াও মাড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছিল না।
নারীর অধিকার : ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদ পূর্ণাঙ্গভাবে নারীর অধিকার রক্ষা করতে পারেনি। নারীর অধিকার রক্ষার্থে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কন্যাদের উত্তমভাবে লালন-পালন করবে, সে আর আমি জান্নাতে পাশাপাশি থাকব।’ (মুসলিম : ২৬৩১, তিরমিজি : ১৯১৪)। তিনি নারী জাতিকে কত উঁচু মর্যাদায় সমাসীন করেছেন, তা বোঝার জন্য তাঁর এ বাণীই যথেষ্ট, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত।’ (সুনানে নাসাঈ : ৩১০৪)। অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহতাআলা তোমাদের ওপর মায়ের অবাধ্য হওয়াকে সম্পূর্ণ হারাম করে দিয়েছেন।’ (বোখারি : ৫৯৭৫, মুসলিম : ৫৯৩)। এক সাহাবির প্রশ্নের উত্তরে মহানবী (সা.) পরপর ৩ বার মায়ের মর্যাদার কথা বলে চতুর্থবার পিতার মর্যাদার কথা বলেছেন। (বোখারি : ১৯৭১, মুসলিম : ২৫৪৮)।
শ্রমিকের অধিকার : শ্রমিক বা অধীনস্থদের অধিকারের ব্যাপারেও মহানবী (সা.) অত্যন্ত সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। এরশাদ করেন, ‘তোমাদের অধীনস্থরাও তোমাদের ভাই। সুতরাং তোমরা যা খাবে, তা তাদেরও খাওয়াবে। যা পরিধান করবে, তা তাদেরকেও পরিধান করাবে। তাদের ওপর এমন ভারী কাজ চাপিয়ে দেবে না, যা তাদের জন্য কষ্টকর হয়।’ (বোখারি : ২৫৪৫, মুসলিম : ১৬৬২)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তাদের পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪৪৩)। শুধু তাই নয়, প্রিয়নবী (সা.) সাহাবিদের বলেছিলেন, ‘তোমরা তোমাদের সেবকদের দৈনিক ৭০ বার ক্ষমা করো।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫১৬৪)।
হিজড়াদের অধিকার : বর্তমান সমাজে নারীদের চেয়েও যারা বেশি অবহেলিত, তারা হলো হিজড়াগোষ্ঠী। সেই হিজড়াদের ব্যাপারেও মহানবী (সা.) প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করে বলেছেন, ‘তোমরা তাদের বাড়িঘর থেকে বের করে দিও না। বরং তাদের ব্যাপারে পুরুষ হওয়া অথবা নারী হওয়া নিশ্চিত করো। সে অনুযায়ী তাদের উত্তরাধিকার বুঝিয়ে দাও।’ (সুনানে বায়হাকি : ১২২৯৪)।