আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, প্রাণপ্রিয় রাসুল হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.), যার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়, প্রতিটি কাজ এবং প্রতিটি কথা মানবজাতির জন্য এক অপার দয়া ও করুণার প্রতীক। তার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি শিক্ষা এবং তার প্রতি আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ মানবতার চেতনায় আমাদের যুক্ত করে তোলে, আলোকিত করে আমাদের অন্তর। এই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার এক মহান প্রতিফলন দরুদপাঠ। রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদপাঠ করার মাধ্যমে আমরা তার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং আনুগত্যের গভীরতার পরিচয় দিই। এই দরুদ যেন এক সুরভিত ফুল, যার সৌরভ শুধু আমাদের হৃদয় নয়, গোটা বিশ্বকে মুগ্ধ ও মাতোয়ারা করে দিতে পারে। দরুদপাঠ এক পবিত্র আত্মিক অনুশীলন। এটি শুধু কিছু শব্দের উচ্চারণ নয়; এটি এক গভীর আবেগ ও ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি।
যখন আমরা রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদপাঠ করি, আমাদের হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে ওঠে, এক আধ্যাত্মিক প্রশান্তি যা মনের জটিলতাকে মুছে ফেলে এবং অন্তরে এক শুদ্ধতার অনুভূতি এনে দেয়। এই দরুদফুলের সুবাস গোটা মানবের কলুষতাকে দূর করে অন্তরে আনে শান্তি, ধৈর্য ও সাম্যের প্রেরণা। কল্পনা করুন, এই দুরুদফুলের অপার সৌরভ যদি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, তবে প্রতিটি মানুষের হৃদয় হয়ে উঠবে শান্তি ও কল্যাণের এক প্রকৃত প্রতিচ্ছবি। আমাদের প্রাণের রাসুল (সা.) ছিলেন এমন এক মহামানব, যার জীবন ছিল আল্লাহর ভালোবাসা ও আনুগত্যে পূর্ণ। তার আদর্শ এবং শিক্ষা প্রতিটি মোমেনের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। তার প্রতি আমাদের পঠিত প্রতিটি দরুদ যেন একটি করে আধ্যাত্মিক আলোর কণা, যা আমাদের অন্ধকারময় মনকে আলোকিত করে তোলে।
এই আলো আমাদের মনকে কোমল ও সহনশীল করে তোলে এবং আমাদের মধ্যে এমন এক শুদ্ধতার জন্ম দেয়, যা আমাদের জীবনকে আরো সৎ, আরো পরিশুদ্ধ করে তোলে। দরুদপাঠের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রতি দরুদপাঠ করে আমরা যে আধ্যাত্মিক সুরভিত বাগানে প্রবেশ করি, তা আমাদের মন ও প্রাণে এক অপূর্ব প্রশান্তি এনে দেয়। এই দরুদফুলের সৌরভ শুধু আমাদের একক আনন্দের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য, যেন এক অমলিন শান্তির বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদপাঠ মানে তার প্রতি আমাদের গভীর ভালোবাসার প্রকাশ। এটি আমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে এবং আমাদের মনকে কল্যাণ ও মানবতার প্রতি আরো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করে তোলে। দরুদপাঠের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে তার রহমত কামনা করি এবং রাসুল (সা.)-এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। এই দরুদ আমাদের জানায় যে, আমরা তার দেখানো পথে চলতে প্রতিশ্রুতি ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদপাঠের এই ধারাবাহিকতা আমাদের মনকে দয়া, ভালোবাসা এবং সহমর্মিতার গুণে পরিপূর্ণ করে তোলে। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শানে দরুদপাঠের বিষয়ে পবিত্র আল-কোরআন ও হাদিসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে। ইসলাম ধর্মে রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ এবং ইবাদতের অংশ হিসেবে গণ্য। কোরআন ও হাদিসে এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা সরাসরি আমাদের নবীজির প্রতি দরুদপাঠের নির্দেশ দিয়েছেন। সুরা আল-আহযাবের ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ নবীজির প্রতি অনুগ্রহ (সালাত) প্রেরণ করেন। হে মোমেনগণ! তোমরাও তার প্রতি যথাযথভাবে দরুদ ও সালাম পাঠ করো।’ (সুরা আল-আহযাব : ৫৬)। এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা স্বয়ং রাসুল (সা.)-এর প্রতি সালাম প্রেরণ করছেন এবং তার ফেরেশতাগণও ইস্তেগফার প্রার্থনা করছেন। এটি আমাদের জন্যও একটি নির্দেশ যে, আমরা নবীজির প্রতি দরুদপাঠ করব। এই আয়াতটি থেকে বোঝা যায়, দরুদপাঠ শুধু একটি সাধারণ ইবাদত নয়, বরং এটি আল্লাহতায়ালার প্রিয় একটি কাজ। এছাড়া হাদিসেও দরুদপাঠের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয়েছে। দরুদপাঠে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ অর্জিত হয়। বান্দার গুনাহ মাফ হয়। মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। দুশ্চিন্তা দূর হয়। হাশরের মাঠে নবী (সা.) এর সুপারিশ লাভ হয়। একবার দরুদ পাঠ করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে দশটি রহমত অর্জিত হয়। এছাড়া আরো অনেক উপকারিতা রয়েছে দরুদপাঠের। যেমন হাদিসে এসেছে- রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদপাঠ করে, আল্লাহতায়ালা তার জন্য দশটি রহমত প্রেরণ করেন, দশটি গুনাহ ক্ষমা করেন এবং তার দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।’ (মুসলিম)। এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, নবীজির প্রতি দরুদপাঠের মাধ্যমে আমাদের গুনাহ মাফ হয় এবং আল্লাহতায়ালা আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। এটি দরুদপাঠের অন্যতম ফজিলত। অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রার্থনাকে রাসুল (সা.) এর প্রতি দরুদ দ্বারা শুরু ও শেষ করো, এতে তোমাদের দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।’ (তিরমিজি) এই হাদিসের মাধ্যমে রাসুল (সা.) আমাদের দোয়া কবুলের উপায় হিসেবে দরুদপাঠের নির্দেশনা দিয়েছেন।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল(সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন আমার কাছে তারাই বেশি ঘনিষ্ঠ হবে, যারা আমার প্রতি অধিক পরিমাণে দরুদপাঠ করে।’ (তিরমিজি)। এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, যারা বেশি বেশি দরুদপাঠ করে, কেয়ামতের দিন তারা নবীজির সুপারিশ লাভ করবেন এবং তার সান্নিধ্যে থাকার মর্যাদা অর্জন করবেন। হাদিসে আরো এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি দরুদপাঠে কৃপণতা করে, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।’ (মুসলিম)। এই হাদিসে নবীজি (সা.) দরুদপাঠ না করার ক্ষেত্রে কঠোর সতর্ক করেছেন এবং বলেছেন, দরুদপাঠ না করা মোমেনের জন্য অনর্থক। দরুদপাঠ করা জীবনের বরকত বৃদ্ধি করে এবং মোমেনের অন্তরে আল্লাহ ও নবীজির প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি করে। দরুদের সৌরভ যদি সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আমাদের সমাজ আরো শান্তি ও কল্যাণের পথে নিশ্চিত এগিয়ে যাবে। মানবজীবনে অনেক অশান্তি, হিংসা এবং বিদ্বেষ রয়েছে। দরুদপাঠের মাধ্যমে মানুষে মানুষে বিদ্যমান সমস্ত দ্বন্দ্ব ও বিভেদকে দূর করতে সহায়ক হবে। রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদপাঠের মাধ্যমে আমাদের সমাজে এমন এক ঐক্যের সৃষ্টি হতে পারে, যা আমাদের পৃথিবীকে আরও শান্তিময় এবং সুখকর করে তুলবে। দরুদের এই সুফল আমাদের মনে মানবিকতার বীজ রোপণ করবে, যা অন্ধকারময় পৃথিবীতে আলোর দিশা দেখাবে। রাসুল (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন কেমন করে একজন মানুষ হওয়া উচিত, কেমন করে একজন প্রকৃত মোমেন হওয়া উচিত। তার আদর্শ আমাদের শিক্ষা দেয় কেমন করে দয়া, সহমর্মিতা এবং সমতা দিয়ে আমাদের জীবন পরিচালিত করা যায়। দরুদপাঠের মাধ্যমে আমরা তার সেই শিক্ষা ও আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করি এবং তা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগের চেষ্টা করি। দরুদপাঠের মাধ্যমে আমাদের অন্তর যত শুদ্ধ হবে, ততই আমরা তার প্রদর্শিত পথে চলতে সক্ষম হবো এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার আদর্শ অনুসরণ করতে পারব। আসুন, আমরা আমাদের জীবনকে আরো অর্থবহ করে তুলতে দরুদপাঠের এই অভ্যাসকে জীবনের প্রতিটি দিনে অন্তর্ভুক্ত করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কুমিল্লা