জীবন ক্ষণিকের। মূল্যহীন চাকচিক্য সব কিছু। পরিবর্তন-বিবর্তন সম্পর্কে চিন্তা করা দরকার। জীবনের বাস্তবতা ও রহস্য পরিষ্কার হবে একদিন। পার্থিব জীবনের ওপর নির্ভরশীল ও মোহগ্রস্ত ব্যক্তি নিশ্চিত ধোঁকায় পড়ে আছে। তার ধ্বংস অনিবার্য। মানবজীবনের মতো পৃথিবীর সময়কালও সংক্ষিপ্ত। জীবন শুরু হয় একটা মুহূর্ত থেকে। এরপর দিন। দিনের পর মাস। মাসের পর বছর। এরপর কয়েক বছর পেরিয়ে জীবনের শেষক্ষণ আসে। কারও ধারণাই থাকে না, মৃত্যুর পর কী হবে! পরবর্তীদের জীবনেও কী বেঁচে থাকা যাবে? প্রতিটি সৃষ্টির জীবন মুহূর্তমাত্র। পৃথিবী একটি সাময়িক ভোগের স্থল। ভোগ মানে সীমিত সময়ে তার স্বাদ আস্বাদনের পর নিঃশেষ হওয়া। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পার্থিব জীবন কেবল উপভোগ্য বস্তু। আর পরকাল স্থায়ী বসবাসের।’ (সুরা মোমিন : ৩৯)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘ভেবে দেখুন, যদি আমি তাদেরকে বছরের পর বছর ভোগবিলাস করতে দিই, অতঃপর যে বিষয়ে তাদেরকে ওয়াদা দেওয়া হয়েছে, তা তাদের কাছে এসে পড়ে, তখন তাদের ভোগবিলাস কী কোনো কাজে আসবে?’ (সুরা শুয়ারা : ২০৫-২০৭)।
আল্লাহতায়ালা কবর থেকে হিসাব-নিকাশের জন্য যখন পুনরুত্থান করবেন, তখন কবরে অবস্থানকালীন দীর্ঘ সময় মানুষের কাছে মনে হবে, অল্প মুহূর্ত কবরে ছিলাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যেদিন তাদেরকে সমবেত করা হবে, তাদের মনে হবে, যেন তারা (দুনিয়ায় বা কবরে) দিনের এক মুহূর্তের বেশি অবস্থান করেনি। এ অল্প সময়ের ব্যবধানে তারা একে অপরকে চিনতে পারবে।’ (সুরা ইউনুস : ৪৫)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘যেদিন কেয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন অপরাধীরা কসম খেয়ে বলবে, এক মুহূর্তেরও বেশি (কবরে) অবস্থান করিনি। এমনিভাবে তারা সত্যবিমুখ হতো।’ (সুরা রুম : ৫৫)।
যেখানে গোটা পৃথিবীর সময়কাল কেয়ামতের তুলনায় কেবল একটি মুহূর্ত, সেখানে আমাদের জীবনের সময়কাল কতটুকু হবে? দুনিয়ার এ সময়কাল পরকালের স্থায়ী অনন্ত সময়ের সমুদ্র থেকে একটি বিন্দুর মতো। সুতরাং সেই ব্যক্তিই প্রশংসার যোগ্য, যে এ সংক্ষিপ্ত জীবনে বেশি বেশি পুণ্যের কাজ করে, আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ কাজগুলি ছেড়ে দেয়; নিজেকে সব ধরনের গোমরাহি ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্ত করে কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে সফল হয়। ওইসব লোকের জন্য ধ্বংস, যারা এ সংক্ষিপ্ত জীবনের মোহে পড়ে অন্যায়-অশ্লীল কাজ করে, কামনা-বাসনার অনুসরণ করে, আল্লাহর বিধিবিধান থেকে নিজেকে ফিরিয়ে রাখে ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে নিজেকে জাহান্নামি হিসেবে তৈরি করে। এদের জন্য জাহান্নামে ঝাক্কুম খাদ্য হবে। পানীয় হিসেবে দেওয়া হবে পুঁজ।
যারা শারীরিক সুস্থতা ও শক্তির কারণে আল্লাহর অবাধ্যতা করে, অবসর সময় নষ্ট করে, ধন-সম্পদের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে নিজেকে ধ্বংস করে, কামনা-বাসনার অনুসরণ করে পথভ্রষ্ট হয়, যৌবনের শক্তির কারণে আসল পরিচয় ভুলে যায় ও আল্লাহর নেয়ামত ভোগ করে, তারাই নাফরমান। তারা কী জানে না, আসমান ও জমিনে আল্লাহকে অক্ষম করতে পারে, এমন কোনো শক্তি নেই! আল্লাহতায়ালা অবাধ্যদের কঠিন শাস্তি দেবেন। তারা কী মৃত্যু এবং এর পরবর্তী হিসাব দিবসের ব্যাপারে নিশ্চিত নয়! যারা মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের সুযোগ ও দুনিয়ার বিভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার কারণে আল্লাহর অবাধ্যতা করে, তাদের যখন মৃত্যু হবে, তখন কী নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য আবার এ পৃথিবীতে আসতে পারবে?
যারা এখনও আল্লাহর অবাধ্যতা করছে, বিচার দিবস আর শেষ পরিণতি সম্পর্কে বেখবর, তাদের কী কৃত অন্যায়ের প্রতি অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার সময় হয়নি? তাদের এ নিছক অবহেলা থেকে জেগে ওঠা এবং আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করার সময় কী এখনও হয়নি? তোমরা কী ওইসব শক্তিধর গোত্র ও জাতি থেকে শিক্ষা নেবে না, যাদের প্রভাব বিস্তারকারী বাসস্থান এখন জনমানবশূন্য! যারা একটা সময় বিভিন্ন ধরনের বাগান করেছে, বৃক্ষরোপণ করেছে, অট্টালিকা তৈরি করে শহর আবাদ করেছে। তারা এখন সবাই অতীত।
নিজেদের সকল আরামণ্ডআয়েশ ছেড়ে কবরে নিজেদের কৃত আমলের ফল ভোগ করছে। যারা নেক ও পুণ্যের কাজ করেছে, তারা সফলকাম। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর অবাধ্যতা করেছে, তারা ব্যর্থ ও লজ্জিত হবে। মৃত্যুকে কেউ এড়াতে পারবে না। কোরআন ছাড়া আমাদের বিকল্প কোনো সঠিক পথ প্রদর্শনকারী নেই। প্রতিটা দিনের আগমন ও চলে যাওয়ায় আমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। অতীতের দিন কখনও ফিরে আসবে না। ভবিষ্যতের মুহূর্তও একসময় অতিবাহিত হবে। এভাবেই আমাদের জীবন ও সকল আশা-আকাঙ্ক্ষার অবসান ঘটবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষ তা-ই পায়, যার জন্য সে চেষ্টা করে। অচিরেই তার কর্ম দেখা হবে। অতঃপর তাকে পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে। সব কিছুর সমাপ্তি তোমার পালনকর্তার কাছে।’ (সুরা নাজম : ৩৯-৪২)।
চিরস্থায়ী জীবনের জন্য পুণ্যের কাজ করা চাই; যেখানের নেয়ামত কখনও নিঃশেষ হবে না। এমনকি কমবেও না, বরং বৃদ্ধি পাবে। সেখানে যুবক কখনও বৃদ্ধ হবে না। মৃত্যু বা অসুস্থতার কোনো ভীতি থাকবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা এতে সানন্দে প্রবেশ করো। এটাই অনন্তকাল বসবাসের জন্য প্রবেশ করার দিন। তারা সেখানে যা চাইবে, পাবে। আমার কাছে রয়েছে আরও অধিক।’ (সুরা কাফ : ৩৪-৩৫)। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে তার অনুগত হওয়া চাই। জান্নাতে প্রবেশের জন্য কল্যাণময় ও পুণ্যের কাজ করা উচিত।
অন্যায়-অশ্লীল গোনাহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। কেননা গোনাহ মানুষকে ধ্বংস করে জাহান্নামি বানিয়ে দেয়। মানুষ এবং জান্নাত-জাহান্নামের মধ্যে কেবল মৃত্যুই প্রতিবন্ধক। রাসুল (স.) বলেন, ‘সাতটি বিষয়ের আগে ভালো কাজ করার ব্যাপারে অগ্রগামী হও। তা হলো- দারিদ্রতা, অসুস্থতা, বার্ধক্য, আকস্মিক মৃত্যু, দাজ্জালের আবির্ভাব, যখন মানুষ সবচেয়ে খারাপ বিষয়ের সম্মুখীন হবে এবং ভয়াবহ কেয়ামতের দিবস।’ (তিরমিজি : ২৩০৬)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘তোমরা বেশি বেশি মৃত্যুকে স্মরণ করো।’ (তিরমিজি : ২৩০৭)।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করতেই হবে। যারা ঈমান এনেছে, তাদেরকে সুসংবাদ জানিয়ে দাও।’ (সুরা বাকারা : ২২৩)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো এবং জাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্য আগে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা দেখেন।’ (সুরা বাকারা : ১১০)।
মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর : আল মামুন নূর