চারদিকে চলছে অন্যায়, পাপাচার ও দুষ্কৃতির মহাসয়লাব। সবখানে জ্বলছে নৃশংসতা ও বর্বরতার ভয়াবহ অগ্নিগিরি। মানবজাতি অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার ঘৃণ্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। হত্যাযজ্ঞ, অনৈতিকতা, অরাজকতা, গোত্রসংঘাত, লুটতরাজ তাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। পার্থিব ভোগ-বিলাস ও ভোগ-উপভোগই যেন জীবনের মূল লক্ষ্য। অর্থ-ঐশ্বর্য ও বিত্ত-বৈভবের নাগাল পাওয়াই যেন জীবনের মূলমন্ত্র। মানবসম্প্রদায় ছিল দিকভ্রান্ত পথিকের ন্যায় দিশেহারা, লক্ষ্যভ্রষ্ট কাফেলার ন্যায় পথহারা। তুচ্ছ বিষয়ে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ চলত যুগ যুগ ধরে। কন্যাসন্তানকে করা হতো জীবন্ত কবরস্থ। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও উলঙ্গপনাই ছিল যাদের দিনরাতের ব্যস্ততা। মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট হারিয়ে তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছিল পশুত্বের নিকৃষ্ট আস্তাকুড়ে। তাদের পাশবিক কর্মকাণ্ড তখন যেন অভিশপ্ত ইবলিসকেও হার মানিয়েছিল। এসব দৃশ্য কল্পনায় এখনও হৃদয় কেঁপে ওঠে, মন কেঁদে ওঠে, তনুমন স্পন্দিত হয় তীব্রভাবে। এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন তপ্তশোকার্ত বিশ্বের আমূল পরিবর্তন সাধনের লক্ষ্যে নববি ধারার পরিসমাপ্তিতে মা আমেনার কোল আলোকিত করে আগমন করলেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)। যিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবপ্রসূন, রহমাতুল্লিল আলামিন, সরদারে দো-জাহান, হাবিবে কিবরিয়া, মাহবুবে এলাহি, আকায়ে নামদার, তাজদারে মদিনা, জিগর গুশায়ে আমেনা। সর্বোৎকৃষ্ট মহামানব বিশ্বনবী (সা.)-এর আগমনে পৃথিবী ধন্য হলো। সৃষ্টিকুল প্রফুল্লিত হলো। দিশেহারা জাতি পেল সঠিক দিশা। অসভ্য বর্বর সম্প্রদায় পেল চরিত্র সভ্যতার সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ। এ ধরণীতে নবীজি (সা.)-এর আবির্ভাব আমাদের প্রতি আল্লাহর মহাঅনুগ্রহ। পবিত্র কোরআনে এ অনুগ্রহের বর্ণনা এসেছে এভাবে, ‘আল্লাহ মোমিনদের প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন; তিনি তাদেরই নিজেদের মধ্য হতে তাদের কাছে রাসুল প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদের সামনে আল্লাহর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করেন, তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদের কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেন। যদিও তারা এর আগে সুস্পষ্ট গোমরাহিতে লিপ্ত ছিল।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৬৪)।
উম্মতের জন্য নবীজির কান্না : মানবতার চিরকল্যাণকামী প্রিয়তম নবী (সা.) উম্মতের ফিকিরে সদা ব্যতিব্যস্ত ও চিন্তামগ্ন থাকতেন। আমাদের নাজাতের জন্য আল্লাহর কাছে কান্নায় ভেঙে পড়তেন। আবদুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; একবার রাসুল (সা.) ইবরাহিম (আ.)-এর উক্তি সম্বলিত এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন, ‘হে আমার রব! এসব প্রতিমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে, সে আমার দলভুক্ত হবে।’ আর সেই আয়াতও পড়লেন, যেখানে আছে- ‘ঈসা বললেন, হে আমার রব! যদি আপনি তাদের শাস্তি দেন, তবে তারা তো আপনারই বান্দা। আর যদি তাদের ক্ষমা করেন, তবে নিশ্চয়ই আপনার ক্ষমতাও পরিপূর্ণ এবং হিকমতও পূর্ণ।’ অতঃপর নবীজি (সা.) দু’হাত তুলে কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘হে আল্লাহ, আমার উম্মত! আমার উম্মত!’ তখন আল্লাহতায়ালা বললেন, ‘হে জিবরাইল! মুহাম্মদকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, তিনি কেন কাঁদছেন? যদিও তোমার রবই ভালো জানেন।’ অতঃপর জিবরাইল (আ.) নবীজি (সা.)-এর কাছে এসে তা জিজ্ঞেস করলেন। রাসুল (সা.) সব খুলে বললেন। যদিও আল্লাহতায়ালা সব জানেন। অতঃপর আল্লাহতায়ালা বললেন, ‘হে জিবরাইল! মুহাম্মদকে গিয়ে বলো, আমি অচিরেই আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করব; ব্যথিত করব না।’ (মুসলিম : ২০২)।
উম্মতের প্রতি নবীজির দরদ : বিভ্রান্ত উম্মতের হেদায়েত লাভে নবীজি (সা.)-এর দরদণ্ডব্যথা ও আত্মত্যাগের মাত্রা কী পরিমাণ ছিল, তা কোরআনে কারিমের একটি আয়াত থেকে অনুমেয়; আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী!) যেন আপনি ওদের পেছনে পরিতাপ করতে করতে নিজের প্রাণনাশ করে ফেলবেন, যদি ওরা এ বাণীর প্রতি ঈমান না আনে।’ (সুরা কাহফ : ৬)। মুসলিম উম্মাহ কি তাকে না ভালোবেসে পারে, যিনি উম্মাহর কল্যাণে ছুটে যান সুদূর তায়েফে? ইসলামের শ্বাশ্বত পয়গাম নিয়ে, দিকভ্রান্ত উম্মতকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে, জান্নাতের পথ দেখাতে, দরদী বন্ধু হয়ে? কিন্তু হতভাগা তায়েফবাসীরা এমন নিঃস্বার্থ শুভাকাঙ্ক্ষীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল। বিষমাখা কথার ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার কোমল হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করল। পাথর-বৃষ্টি বর্ষণ করে দেহ মোবারক রক্তে রঞ্জিত করল নির্মম ও নির্দয়ভাবে। কিন্তু দয়ার সাগর নবীজি (সা.) সব সহ্য করলেন সন্তর্পণে। পরবর্তী প্রজন্মের হেদায়াতের আশা বুকে বাঁধলেন। ইস্পাত কঠিন দৃঢ় সংকল্প হৃদয়ে গাঁথলেন। পরবর্তী প্রজন্মের হেদায়াত লাভের আশায় তাদের জন্য একটু বদ দোয়াও করলেন না। অথচ তাদের এ চরম ধৃষ্টতায় কেঁপে উঠল আল্লাহর আরশ। প্রকম্পিত হলো সৃষ্টিজগত। তার সামান্য ইঙ্গিত পেলে পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা তাদের ন্যক্কারজনকভাবে পিষে ফেলত। দুই পাহাড়ের মাঝে চাপা দিয়ে গোটা জনপদটিকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করত। তায়েফবাসী যখন চরম ধৃষ্টতা দেখিয়ে নবীজি (সা.)-এর ওপর চড়াও হলো, পাথরের আঘাতে তাকে রক্তাক্ত করল, তখন আল্লাহতায়ালা জিবরাইল (আ.)-কে পাঠালেন। তিনি এসে বললেন, ‘আপনার সম্প্রদায় আপনাকে যা বলেছে এবং আপনার সঙ্গে যে আচরণ করেছে, আল্লাহ তা দেখেছেন। আপনার আদেশ পালনে পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন। তখন পাহাড়ের ফেরেশতা আমাকে সম্বোধন করে সালাম দিল এবং বলল, আমি পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা। হে মুহাম্মদ! আপনার কওমের বক্তব্য আল্লাহ শুনেছেন। আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার আদেশ পালন করতে। আপনি আমাকে কী আদেশ করবেন করুন। আপনি যদি আদেশ করেন, তাহলে আমি দুই পাহাড়ের মাঝে এদেরকে পিষে ফেলব।’ কিন্তু দয়ার সাগর নবীজি (সা.) জবাব দিলেন, ‘(আমি এটা চাই না;) বরং আমি আশা রাখি, আল্লাহতায়ালা এদের বংশধরদের মাঝে এমন মানুষ বের করবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না।’ (মুসলিম : ১৭৯৫)।
নবীজির আকাঙ্ক্ষা আমাদের দেখা : মোমিন কি রাসুলপ্রেমিক না হয়ে পারে! যিনি আমাদের জন্মের ১৪০০ বছর আগে আমাদের ভালোবেসেছেন। আমাদের দেখার আকাঙ্ক্ষা করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একদিন রাসুল (সা.) মদিনায় জান্নাতুল বাকি নামক গোরস্থানে) উপস্থিত হলেন। মৃতদের উদ্দেশে বললেন, ‘আস সালামু আলাইকুম হে মোমিনদের নগরের অধিবাসীরা! আমরাও ইনশাআল্লাহ তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব।’ এরপর বললেন, ‘আমার আকাঙ্ক্ষা, আমরা যেন আমাদের ভাইদের দেখতে পাই।’ সাহাবিরা বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! (কোন ভাইয়েরা?) আমরা কি আপনার ভাই নই?’ উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমরা আমার সহচর। আমার ভাই তারাই, যারা এখনও (দুনিয়ায়) আসেনি।’ সাহাবিরা বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! কীরূপে আপনি আপনার উম্মতের এমন লোকদের চিনবেন, যারা এখনও (দুনিয়ায়) আসেনি?’ উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘বলো দেখি, যদি কোনো ব্যক্তির নিছক কালো রঙের এক অশ্বপালের মধ্যে একদল ধবধবে সাদা কপাল ও সাদা হাত-পা বিশিষ্ট ঘোড়া থাকে, সে কি তার ঘোড়াগুলি চিনতে পারে না?’ তারা বললেন, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ইয়া রাসুলাল্লাহ!’ তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমার উম্মতের অনেকে অজুর কারণে (কেয়ামতের দিন) সেরূপ ধবধবে সাদা কপাল ও সাদা হাত-পা অবস্থায় উপস্থিত হবে এবং আমি হাউজে কাউসারের কাছে তাদের অগ্রদূত হিসেবে উপস্থিত থাকব। জেনে রেখ, কিছু সংখ্যক লোককে সেদিন আমার হাউজ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে, যেমনিভাবে বেওয়ারিশ উটকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। আমি তাদের ডাকব, ‘এসো এসো।’ বলা হবে, ‘এরা আপনার পরে (আপনার দ্বীনকে) পরিবর্তন করে দিয়েছিল।’ তখন আমি বলব, ‘দূর হও, দূর হও।’ (মুসলিম : ৪৭২)।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম