ঢাকা শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫, ২৯ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মহানবীর দেখা জান্নাত-জাহান্নাম

শরিফ আহমদ
মহানবীর দেখা জান্নাত-জাহান্নাম

রাসুলুল্লাহ (সা.) জান্নাত ও জাহান্নামের বহু দৃশ্য দেখেছেন। বিশুদ্ধ হাদিসে প্রমাণিত, তিনি মেরাজের রাতে এবং স্বপ্নযোগে বিভিন্ন দৃশ্য দেখেছেন। তিনি গোনাহগারদের যেমন জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হতে দেখেছেন, তেমনি অন্য শাস্তিতেও নিপতিত দেখেছেন। তারা ছিল বিভিন্ন ধরনের অন্যায়, অপরাধ ও মন্দ স্বভাবের অধিকারী। একটি হাদিসে সাতটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো মানুষকে দুনিয়ার জীবনে সংশোধন করার এবং আখেরাতের শাস্তি ও পুরস্কার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পথ দেখায়। সামুরা ইবনে জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায়ই তার সাহাবিদের বলতেন, তোমাদের কেউ কোনো স্বপ্ন দেখেছ? বর্ণনাকারী বলেন, যাদের বেলায় আল্লাহর ইচ্ছা, তারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে স্বপ্ন বর্ণনা করত। তিনি একদিন সকালে আমাদের বললেন, গত রাতে আমার কাছে দুজন আগন্তুক এলো। তারা আমাকে ঘুম থেকে জাগাল। বলল, চলুন। আমি তাদের সঙ্গে চলতে লাগলাম। আমরা কাত হয়ে শায়িত এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছালাম। দেখলাম, অপর এক ব্যক্তি তার কাছে পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার মাথায় পাথর নিক্ষেপ করছে। ফলে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। আর পাথর নিচে গিয়ে পড়ছে। এরপর আবার সে পাথরটি অনুসরণ করে তা পুনরায় নিয়ে আসছে। ফিরে আসতে না আসতেই লোকটির মাথা আগের মতো আবার ভালো হয়ে যায়। ফিরে এসে সে আবার অনুরূপ আচরণ করে, যা প্রথমবার করেছিল। তিনি বলেন, আমি তাদের (সঙ্গীদ্বয়কে) বললাম, সুবহানাল্লাহ! এরা কারা? তারা আমাকে বলল, চলুন, চলুন।

আমরা চললাম। এরপর আমরা চিৎ হয়ে শায়িত এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছালাম। এখানেও দেখলাম, তার কাছে এক ব্যক্তি লোহার আকড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার চেহারার একদিকে এসে এটা দ্বারা মুখমণ্ডলের একদিক মাথার পেছনের দিক পর্যন্ত এবং অনুরূপভাবে নাসারন্ধ্র, চোখ ও মাথার পেছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলছে। এরপর ওই লোকটি শায়িত ব্যক্তির অপরদিকে যায় এবং প্রথম দিকের সঙ্গে যেরূপ আচরণ করেছে, অনুরূপ আচরণই অপরদিকের সঙ্গেও করে। ওই দিক থেকে অবসর হতে না হতেই প্রথম দিকটি আগের মতো ভালো হয়ে যায়। তারপর আবার প্রথমবারের মতো আচরণ করে। আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ! এরা কারা? তারা আমাকে বলল, চলুন, চলুন। আমরা চললাম এবং চুনাসদৃশ একটি গর্তের কাছে পৌঁছালাম।

বর্ণনাকারী বলেন, আমার মনে হয়, যেন তিনি বলেছিলেন, আর সেখানে শোরগোলের শব্দ হচ্ছিল। তিনি বলেন, আমরা তাতে উঁকি মারলাম। দেখলাম, তাতে বেশ কিছু উলঙ্গ নারী ও পুরুষ রয়েছে। আর নিচ থেকে নির্গত আগুনের লেলিহান শিখা তাদের স্পর্শ করছে। যখনই লেলিহান শিখা তাদের স্পর্শ করে, তখনই তারা উচ্চস্বরে চিৎকার করে ওঠে। তিনি বলেন, আমি তাদের বললাম, এরা কারা? তারা আমাকে বলল, চলুন, চলুন। তিনি বলেন, আমরা চললাম এবং একটি নদীর (তীরে) গিয়ে পৌঁছালাম। বর্ণনাকারী বলেন, আমার যতদূর মনে পড়ে তিনি বলেছিলেন, নদীটি ছিল রক্তের মতো লাল। দেখলাম, এ নদীতে এক ব্যক্তি সাঁতার কাটছে। নদীর পানিতে অপর এক ব্যক্তি রয়েছে এবং সে তার কাছে অনেকগুলো পাথর একত্রিত করে রেখেছে। ওই সাঁতার কাটা ব্যক্তি বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পর সে ব্যক্তির কাছে এসে পৌঁছে, যে নিজের কাছে পাথর একত্রিত করে রেখেছে। সেখানে এসে সে তার মুখ খুলে দেয়। আর ওই ব্যক্তি তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দেয়। এরপর সে চলে যায়, সাঁতার কাটতে থাকে। আবার তার কাছে ফিরে আসে। যখনই সে তার কাছে ফিরে আসে, তখনই সে তার মুখ খুলে দেয়। আর ওই ব্যক্তি তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দেয়। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তারা বলল, চলুন, চলুন।

তিনি বলেন, আমরা চললাম এবং এমন একজন কুশ্রী ব্যক্তির কাছে এসে পৌঁছালাম, যা তোমার দৃষ্টিতে সর্বাধিক কুশ্রী বলে মনে হয়। আর দেখলাম, তার কাছে রয়েছে আগুন, যা সে জ্বালাচ্ছে ও তার চারদিকে দৌড়াচ্ছে। তিনি বলেন, আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, ওই লোকটি কে? তারা বলল, চলুন, চলুন। আমরা চললাম এবং একটা সজীব শ্যামল বাগানে হাজির হলাম। যেখানে বসন্তের হরেক রকম ফুলের কলি রয়েছে। আর বাগানের মাঝে আসমানের থেকে অধিক উঁচু দীর্ঘকায় একজন পুরুষ রয়েছেন। যার মাথা যেন আমি দেখতেই পাচ্ছি না। এমনিভাবে তার চারপাশে এত বিপুল সংখ্যক বালক-বালিকা দেখলাম যে, এত বেশি আর কখনও দেখিনি। তাদের বললাম, উনি কে? এরা কারা? তারা আমাকে বলল, চলুন, চলুন। আমরা চললাম এবং একটা বিরাট বাগানে গিয়ে পৌঁছালাম। এমন বড় এবং সুন্দর বাগান আমি আর কখনও দেখিনি। তিনি বলেন, তারা আমাকে বলল, এর ওপরে চড়ুন। আমরা ওপরে চড়লাম। শেষ পর্যন্ত সোনা-রূপার ইটের তৈরি একটি শহরে গিয়ে হাজির হলাম। আমরা শহরের দরজায় পৌঁছালাম। দরজা খুলতে বললাম। আমাদের জন্য দরজা খুলে দেয়া হলো। আমরা তাতে প্রবেশ করলাম। আমাদের সঙ্গে এমন কিছু লোক সাক্ষাৎ করল, যাদের শরীরের অর্ধেক খুবই সুন্দর, যা তোমার দৃষ্টিতে সর্বাধিক সুন্দর মনে হয়। বাকি অর্ধেক এমনই কুশ্রী, যা তোমার দৃষ্টিতে সর্বাধিক কুশ্রী মনে হয়। তিনি বলেন, সঙ্গীদ্বয় ওদের বলল, যাও ওই নদীতে গিয়ে নেমে পড়। আর সেটা ছিল সুপ্রশস্ত প্রবহমান নদী, যার পানি ছিল দুধের মতো সাদা। ওরা তাতে গিয়ে নেমে পড়ল। এরপর এরা আমাদের কাছে ফিরে এলো। দেখা গেল, তাদের এ কুশ্রিতা দূর হয়ে গেছে। তারা খুবই সুন্দর আকৃতির হয়ে গেল।

তিনি বলেন, তারা আমাকে বলল, এটা জান্নাতে আদন এবং এটা আপনার বাসস্থান। তিনি বলেন, আমি বেশ ওপরের দিকে তাকালাম। দেখলাম, ধবধবে সাদা মেঘের মতো একটি প্রাসাদ রয়েছে। তারা আমাকে বলল, এটা আপনার বাসগৃহ। তাদের বললাম, আল্লাহ তোমাদের মাঝে বরকত দিন! আমাকে ছেড়ে দাও। আমি এতে প্রবেশ করি। তারা বলল, আপনি অবশ্যই এতে প্রবেশ করবেন। তবে এখন নয়।

নবীজি (সা.) বলেন, আমি বললাম, আমি এ রাতে অনেক বিস্ময়কর ব্যাপার দেখতে পেলাম। এগুলোর তাৎপর্য কী? তারা আমাকে বলল, আমরা আপনাকে বলে দিচ্ছি। ওই যে প্রথম ব্যক্তি, যার কাছে আপনি পৌঁছেছিলেন, যার মাথা পাথর দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হচ্ছিল, সে হলো ওই ব্যক্তি, যে কোরআন গ্রহণ করে তা ছেড়ে দিয়েছে। আর ফরজ নামাজ ছেড়ে ঘুমিয়ে থাকে। আর ওই ব্যক্তি, যার কাছে গিয়ে দেখেছেন, তার মুখের এক ভাগ মাথার পেছন দিক পর্যন্ত, এমনিভাবে নাসারন্ধ্রে ও চোখ মাথার পেছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলা হচ্ছিল।

সে হলো ওই ব্যক্তি, যে সকালে আপন ঘর থেকে বেরিয়ে এমন কোনো মিথ্যা বলে, যা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ সকল উলঙ্গ নারী-পুরুষ, যারা চুলাসদৃশ গর্তের অভ্যন্তরে রয়েছে, তারা হলো ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর দল। আর ওই ব্যক্তি, যার কাছে পৌঁছে দেখেছিলেন, সে নদীতে সাঁতার কাটছে ও তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে; সে হলো সুদখোর। আর ওই কুশ্রী ব্যক্তি, যে আগুনের কাছে ছিল এবং আগুন জ্বালাচ্ছিল, আর সে এর চারপাশে দৌড়াচ্ছিল, সে হলো জাহান্নামের দারোগা, মালেক ফেরেশতা। আর ওই দীর্ঘকায় ব্যক্তি, যিনি বাগানে ছিলেন, তিনি হলেন ইবরাহিম (আ.)। আর তার আশপাশের বালক-বালিকারা হলো ওইসব শিশু, যারা স্বভাবধর্মের ওপর মৃত্যুবরণ করেছে। (বোখারি : ৬৫৭১)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত