মদিনায় হিজরতের আগে ইসলামের অগ্রযাত্রা এগিয়ে যাচ্ছিল বাধা-বিপত্তি আর সফলতার মাঝে। কাফের-মুশরিকদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও অকথ্য নির্যাতনের আগুনে শাণিত হচ্ছিল মোমিনের ঈমান। মুসলমানদের দ্বীনি উদ্দীপনা হয়ে উঠছিল আরো প্রবল। এ কঠিন সময়ে কোনো এক রাতে নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে সঙ্গে নিয়ে ইশার নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে খানায়ে কাবা-সংলগ্ন ‘হাতিমে’ শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সে রাতেই নবীজি (সা.) সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলেন; তবে পুরোপুরি নিদ্রায় যাননি। এমন সময় তাকে ডাকা হলো। জমজম কূপের পাশে নিয়ে যাওয়া হলো। তার পবিত্র বুক চুল পর্যন্ত ফাঁড়া হলো। হৃৎপিণ্ড বের করে তা জমজমের পানি দিয়ে ধুয়ে পরিশুদ্ধ করা হলো। ঈমান ও প্রজ্ঞায় পূর্ণ সোনার পেয়ালা আনা হলো। যা দিয়ে তার হৃদয়ে ভরিয়ে দেয়া হলো। তারপর হৃৎপিণ্ড যথাস্থানে স্থাপন করে ওপরে সেলাই করা হলো। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, আমি নবীজি (সা.)-এর পবিত্র বুকে এ ঘটনার চিহ্ন দেখেছি।
বোরাক নামক এক বিস্ময়কর সওয়ারি আনা হলো। যা ছিল গাধার চেয়ে বড়, খচ্চরের চেয়ে কিছুটা ছোট। শরীর ছিল দীর্ঘ ও সৌন্দর্যের অনুপম শোভায় উদ্ভাসিত। তার রং ছিল ধবধবে শুভ্র। এমন দ্রুতগামী ছিল যে, তার পায়ের খুর দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে পড়ত। পিঠে সুশোভিত জিন বাঁধা ছিল। মুখে ছিল দৃষ্টিনন্দন লাগাম। নবীজি (সা.) রেকাবে পা রাখার প্রস্তুতি নিতেই বোরাক আচমকা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করল। এমন সময় জিবরাইল (আ.) তাকে শাসন করলেন, ‘হে বোরাক! তুমি কি মুহাম্মদ (সা.)-এর সামনে ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছ? জান না, আল্লাহর সৃষ্টিজগতের মধ্যে তার চেয়ে অধিক মহান ও প্রিয় কেউ কখনও তোমার পিঠে সওয়ার হয়নি!’ জিবরাইল (আ.)-এর কথায় বোরাক গভীর লজ্জায় ঘামে ভিজে গেল। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর নবীজি (সা.) বোরাকে আরোহণ করলেন। বোরাকের অসামান্য ক্ষিপ্রগতিতে মুহূর্তের মধ্যেই তিনি পৌঁছে গেলেন বাইতুল মাকদিসে। সেখানে জিবরাইল (আ.) একটি পাথর ছিদ্র করে বোরাককে বেঁধে রাখলেন। এর মধ্যে জামাতের জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। নবীজি (সা.) দু’রাকাত নামাজ আদায় করলেন। সকল নবী ও রাসুল তার পেছনে ইকতিদা করলেন। নামাজ শেষে তিনি বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, জিবরাইল (আ.)-এর হাতে দুটি সুদৃশ্য পাত্র। একটি ছিল শরাবের, অপরটি দুধের। জিবরাইল (আ.) পাত্রদুটি নবীজি (সা.)-এর সামনে পেশ করলেন। তিনি দুধের পাত্রটি বেছে নিলেন। এ দৃশ্য দেখে জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘আপনি ও আপনার উম্মত স্বভাবজাত বিষয়টিই গ্রহণ করলেন। যদি আপনি শরাব গ্রহণ করতেন, তবে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত।’
এরপর শুরু হলো ঊর্ধ্বজগতের বিস্ময়কর সফর। নবীজি (সা.) বোরাকের পিঠে আরোহণ করেই যাত্রা অব্যাহত রাখলেন। একে একে প্রতিটি আকাশের দ্বার তার জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছিল। প্রথমে তারা পৌঁছালেন পৃথিবীর দৃশ্যমান আসমানে। সেখানে জিবরাইল (আ.) দ্বার খুলে দেয়ার অনুমতি চাইলেন। অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন করা হলো, ‘আপনি কে?’ জিবরাইল (আ.) নিজের পরিচয় দিলেন। আবার প্রশ্ন করা হলো, ‘আপনার সঙ্গে কে আছেন?’ জবাবে বললেন, ‘মুহাম্মদ (সা.)’। তাদের প্রশ্ন ছিল, ‘আপনার কি তার সঙ্গে আসার অনুমতি রয়েছে?’ জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘হ্যাঁ।’ এরপর প্রথম আসমানের দ্বার খুলে দেয়া হলো। তারা ওপরে উঠলেন। নবীজি (সা.) বর্ণনা করেন, আমি সেখানে এক ব্যক্তিকে দেখলাম। তার ডানদিকে অসংখ্য রুহের ঝাঁক। বামদিকেও তেমনি ঝাঁক দেখা যাচ্ছিল। তিনি যখন ডানদিকে তাকান, তখন হাসেন। আর যখন বামদিকে তাকান, তখন অশ্রুসজল হন। তিনি আমাকে দেখে অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন, ‘মারহাবা হে মহান সন্তান! মারহাবা হে মহান নবী!’ আমি জিবরাইল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তিনি কে?’ জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘ইনি হলেন আদম (আ.)। তাঁর ডান ও বামদিকে যাদের দেখলেন, তারা হলেন তার সন্তানেরা। ডানদিকের রুহগুলো জান্নাতবাসী, বামদিকের রুহগুলো দোজখবাসী। তিনি ডানদিকে তাকিয়ে আনন্দিত হন, বামদিকে তাকিয়ে কষ্টে কাঁদেন।’
এরপর জিবরাইল (আ.) নবীজি (সা.)-কে নিয়ে দ্বিতীয় আকাশের দিকে এগিয়ে চললেন। সেখানে পৌঁছালে আগের মতোই দ্বার উন্মুক্ত করার অনুরোধ করা হলো। ভেতর থেকে প্রশ্ন এলো, ‘কে?’ জিবরাইল নিজের পরিচয় দিলেন। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনার সঙ্গে কে আছেন?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.)।’ তারপর প্রশ্ন করা হলো, ‘তাকে কি আহ্বান করা হয়েছে?’ জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘হ্যাঁ, তাকে আনার জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।’ দ্বার উন্মুক্ত হলে সেখানে নবীজি (সা.) দুই মহান নবী- ঈসা (আ.) ও ইয়াহইয়া ইবনে জাকারিয়া (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা দুজনেই তাকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, ‘মারহাবা হে মহান নবী!’
এরপর তারা তৃতীয় আকাশের দিকে রওনা হলেন। সেখানেও আগের মতো প্রশ্নোত্তর পর্বের পর আকাশের দ্বার উন্মুক্ত করা হলো। সেখানে নবীজি (সা.) ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে মোলাকাত করলেন। আল্লাহতায়ালা তাকে অসামান্য সৌন্দর্য দান করেছিলেন। এমনকি তার রূপে ছিল সৃষ্টিজগতের সৌন্দর্যের অর্ধেক। ইউসুফ (আ.) নবীজি (সা.)-কে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘মারহাবা হে শ্রেষ্ঠ নবী!’ একই পদ্ধতিতে নবীজি (সা.) চতুর্থ আকাশে পা রাখলেন। সেখানে তার সাক্ষাৎ হলো ইদরিস (আ.)-এর সঙ্গে। তিনি সম্মানের সঙ্গে নবীজি (সা.)-কে অভ্যর্থনা জানালেন। সেখান থেকে তারা আরও ওপরের দিকে এগিয়ে যান। নবীজি (সা.) বর্ণনা করেন, আমরা যখন সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন মুসা (আ.)-কে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখতে পেলাম। কান্নার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘এ যুবক আমার পরে প্রেরিত হয়েছেন। তবু তার উম্মত জান্নাতে আমার উম্মতের তুলনায় অধিক সংখ্যায় প্রবেশ করবে। এ ভাবনাই আমাকে ব্যথিত করেছে।’
এরপর নবীজি (সা.) সপ্তম আকাশে পৌঁছালেন। সেখানে তিনি ইবরাহিম (আ.)-কে দেখতে পেলেন। তিনি বাইতুল মামুর নামক পবিত্র স্থানের পাশে ঠেস দিয়ে বসেছিলেন। এ বাইতুল মামুর এমন এক স্থল, যেখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা ইবাদতের জন্য প্রবেশ করে। একবার প্রবেশকারী ফেরেশতাদের আবার আসার পালা কখনও আসে না। ইবরাহিম (আ.) নবীজি (সা.)-কে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ‘মুহাম্মদ! আপনার উম্মতকে আমার সালাম পৌঁছে দেবেন। তাদের জানিয়ে দিন, জান্নাতের মাটি অত্যন্ত পবিত্র। এর পানি সুগন্ধময় ও সুমিষ্ট। জান্নাত পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, সমতল, তা এক অপূর্ব স্থান।’ এরপর নবীজি (সা.)-কে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হলো। এটি এমন এক মহাস্থান, যেখানে পৃথিবী থেকে আরোহিত সব বস্তু ও রুহ এসে থেমে যায়। একইভাবে ঊর্ধ্বজগতের যা কিছু নিচে প্রেরিত হয়, তারও যাত্রার শেষ এখানেই। নবীজি (সা.) বলেন, সিদরাতুল মুনতাহার পাতা ছিল হাতির কানের মতো। এর ফল ছিল বিশাল মটকা আকৃতির। যখন আল্লাহতায়ালার নির্দেশ সেই গাছকে আবৃত করল, তখন তা এমন এক মহিমা ও সৌন্দর্যে সজ্জিত হলো, যার বর্ণনা মানুষের পক্ষে দেয়া অসম্ভব। এর সৌন্দর্য এতই অপার্থিব, যে কোনো দৃষ্টি তা ধারণ করতে অক্ষম। নবীজি (সা.) আরো বলেন, আমি সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে এমন এক উচ্চতর স্থানে পৌঁছালাম, যেখানে আল্লাহর আদেশ লিপিবদ্ধ করার কাজে নিযুক্ত ফেরেশতাদের কলমের আওয়াজ শুনতে পেলাম। এ দৃশ্য ছিল এমনই মহিমান্বিত, যা পৃথিবীর কোনো অন্তর বা চোখের কল্পনাতেও স্থান পায় না।