আল্লাহতায়ালা যখন মানবজাতির পিতা হজরত আদম (আ.) ও তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করলেন, তখন তিনি উভয়ের মাঝে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও উপাস্যকে চেনার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি দান করলেন। তিনি পূর্ণ ভালোবাসা ও মহিমান্বিত শ্রদ্ধার যোগ্য, তাই মানুষের উচিত তার প্রতি বিনয় প্রকাশ করা। আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ.) ও তার বংশধরদের দায়িত্বশীল বানিয়েছেন। তাদের সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষার জন্য, যাতে তারা তার আদেশ-নিষেধ ও ভালো-মন্দের সম্মুখীন হয়ে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। মহান আল্লাহই মানবাত্মাকে সৃষ্টি করে তার মাঝে পূর্ণতার উপাদান দান করেছেন। নড়াচড়া, ইচ্ছা, নিয়ত, সংকল্প, ভালোবাসা, ঘৃণা, পরিবর্তন ও প্রভাব গ্রহণের ক্ষমতা দিয়েছেন। এটা বান্দার প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহ।
আল্লাহতায়ালা সর্বজ্ঞানী ও সর্বস্রষ্টা, তাই তিনি জানেন, তার বান্দাদের মন-মেজাজ। ভালোকে ভালোবাসার ও প্রশংসা করার জন্য তাদের সৃষ্টি। তবে তারা যদি সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাহলে তারা মন্দের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। তাদের মধ্যে রয়েছে আনুগত্যের প্রতি আগ্রহ আবার পাপের দিকে ঝোঁক, ভালো কাজের আকাঙ্ক্ষা ও মন্দ কাজের প্রতি প্রবৃত্তির সহজাত টান।
আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল : আল্লাহ পরম দয়ালু, কৃপাময়, ক্ষমাশীল, তওবা গ্রহণকারী ও সহনশীল। তিনি যখন সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করলেন তখন এক মহাগ্রন্থে লিখলেন, যা তার কাছে আরশের উপরে সংরক্ষিত আছে, ‘নিশ্চয়ই আমার দয়া আমার রোষের উপর বিজয়ী হবে।’ এ কথা আমাদের বিশ্বস্ত নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আমাদের জানিয়েছেন। সমস্ত সৃষ্টির ওপর আল্লাহতায়ালার অসীম কৃপা ও দয়ার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বত্র এ প্রভাব বিরাজিত। তিনি অসীম ক্ষমাশীল। ফলে তিনি যাকে চান, তাকে ক্ষমা করে দেন। এ কারণেই তিনি নিজেকে অত্যন্ত ক্ষমাশীল (গফুর ) বারবার ক্ষমাকারী (গাফফার) ও মার্জনাকারী (গাফির) নামে অভিহিত করেছেন।
বান্দাদের পাপ ঢেকে রাখা, আল্লাহপাকের এক প্রকার ক্ষমা। ফলে বান্দারা দুনিয়া ও আখেরাতে লাঞ্ছিত হয় না। তিনি তাদের পাপ মুছে দেন, তাদের প্রতি শাস্তি আরোপ করেন না, যতক্ষণ না তাদের পাপ কুফর বা বড় শিরকের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কারণ, শিরক এমন এক গোনাহ যা তিনি কখনো ক্ষমা করেন না। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সঙ্গে শরিক করা ক্ষমা করেন না। এটা ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন; আর যে কেউ আল্লাহর সঙ্গে শরিক করে সে এক মহাপাপ করে।’ (সুরা নিসা : ৪৮)। তিনি আরো বলেছেন, ‘যারা কুফরি করেছে ও সীমালঙ্ঘন করেছে আল্লাহ তাদের কখনো ক্ষমা করবেন না এবং তাদের কোন পথও দেখাবেন না।’ (সুরা নিসা : ১৬৮)।
আল্লাহর ইচ্ছার অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয় হলো, তিনি তার সেসব বান্দাদের পাপ ক্ষমা করেন, যারা তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। ইস্তিগফার হলো ক্ষমা লাভের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ও ভিত্তি। এটি আল্লাহর ক্ষমা লাভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এজন্যই আল্লাহ তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে ইস্তিগফারের আদেশ দিয়েছেন, যাতে তার উম্মতও এই আদেশ মেনে চলে। আল্লাহতায়ালা ইস্তিগফারকে তার তৌহিদের জ্ঞান অর্জনের পরপরই অপরিহার্য হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘সুতরাং জেনে রাখ, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই, ক্ষমা প্রার্থনা কর তোমার ও মোমিন নর-নারীদের ত্রুটির জন্য।’ (সুরা মুহাম্মদ : ১৯)।
আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর ক্ষমার জন্য সবচেয়ে আগ্রহী ও তার বান্দাদের মধ্যে সর্বাধিক পরহেজগার। তিনি এই আদেশ পালনে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। তিনি প্রচুর ইস্তিগফার করতেন। এমনকি, একটি বসার মাঝে ১০০ বার পর্যন্ত বলতেন, ‘হে আমার প্রভু! আমাকে ক্ষমা করুন ও আমার প্রতি অনুগ্রহ করুন। নিশ্চয়ই আপনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, তওবা গ্রহণকারী।’ হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)- কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহর শপথ! আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে ৭০ বারেরও বেশি ইস্তিগফার ও তওবা করে থাকি।’ (বোখারি : ৬৩০৭)।
ইস্তিগফারের গুরুত্ব ও মর্যাদার কারণে আল্লাহ তার সম্মানিত ফেরেশতাদের ঈমানদারদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার প্রতি অনুপ্রাণিত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আরশ ধারণ করে আছে ও যারা এর চতুষ্পার্শ্ব ঘিরে আছে, তারা তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সঙ্গে ও তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মোমিনদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী। অতএব যারা তওবা করে ও তোমার পথ অবলম্বন করে তুমি তাদের ক্ষমা কর ও জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা কর।’ (সুরা গাফির : ৭) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ফেরেশতাগণ তোমাদের মধ্যকার সে ব্যক্তির জন্য এই মর্মে দোয়া করতে থাকে, হে আল্লাহ! আপনি তার প্রতি অনুগ্রহ করুন, তার প্রতি রহম করুন; যতক্ষণ না সে তথায় অযু ভঙ্গ করে, যতক্ষণ না সে তথায় কাউকে কষ্ট দেয়। যতক্ষণ সে যেখানে সালাত আদায় রত থেকে সেখানে অবস্থান করবে। (বোখারি : ২১১৯)।
মহানবীর ইস্তিগফার : ইস্তিগফারের গুরুত্বের কারণে আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন, রাতের শেষ প্রহর ও জীবনের শেষ মুহূর্তে ইস্তিগফারের মাধ্যমে আমল সমাপ্ত করা উচিত। তিনি মুত্তাকিদের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘তারা রাতের সামান্য অংশই অতিবাহিত করত নিদ্রায়, রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত।’ (সুরা যারিয়াত : ১৭-১৮)।
মহান আল্লাহ বিশ্বনবী (সা.)-কে জীবনের শেষ সময়ে ইস্তিগফার করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবে, তখন তোমার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর ও তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি তওবা কবুলকারী।’ (সুরা নাসর : ১-৩)। যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করছিলেন, তখন তার পবিত্র মুখ থেকে বের হওয়া শেষ বাক্য ছিল, ‘হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন, আমার প্রতি দয়া করুন ও আমাকে পরম বন্ধুর সান্নিধ্যে পৌঁছে দিন।’ (বোখারি : ৫৬৭৪)
ইস্তিগফারের ফজিলত : ইস্তিগফারের ফজিলত ও তার প্রতি বান্দার মুখাপেক্ষিতার কারণে পরহেজগারদের সর্দার মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তার উম্মতকে শিখিয়েছেন, তারা যেন দিনের শুরু ও শেষ ইস্তিগফারের মাধ্যমে করে। তিনি বলেছেন, সাইয়িদুল ইস্তিগফার হলো এই দোয়া পড়া, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার রব, আপনি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই। আপনিই আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনার বান্দা। আমি যতটুকু পারি, আপনার সঙ্গে করা অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে আপনার আশ্রয় চাই। আমি স্বীকার করছি যে, আপনি আমাকে যে নেয়ামত দিয়েছেন, তা আপনারই দান। আমি আমার পাপও স্বীকার করছি। অতএব, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। কেননা, একমাত্র আপনিই পাপ ক্ষমা করতে পারেন।’ (বোখারি : ৬৩০৬)।
এই বরকতময় নববি দোয়ার মধ্যে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যা ইস্তিগফার কবুল হওয়ার কারণ। যেমন- ১. আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার করা। ২. তাকে রব ও একমাত্র উপাস্য হিসেবে মান্য করা। ৩. তার সামনে বিনম্রভাবে বান্দা নিজেকে তার দাস হিসেবে স্বীকার করা। ৪. আল্লাহর নেয়ামতের স্বীকৃতি দেয়া। ৫. নিজের গোনাহের স্বীকারোক্তি করা। ৬. আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ক্ষমা করতে সক্ষম নয়, এটি মানা। এগুলো সবই আল্লাহর প্রভুত্বের বিশেষ গুণ, যা কেবল তারই জন্য সংরক্ষিত। যখন মহানবী (সা.)-এর পর এই উম্মতের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি হজরত আবু বকর (রা.) বিশ্বনবী (সা.)-এর কাছে জানতে চাইলেন, নামাজে কোন দোয়া পড়া উচিত, তখন নবী করিম (সা.) তাকে এই দোয়া শিখিয়েছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আমি নিজের ওপর প্রচুর জুলুম করেছি। আর আপনি ছাড়া কেউ পাপ ক্ষমা করতে পারে না। তাই আপনি আপনার দয়ায় আমাকে ক্ষমা করুন ও আমার প্রতি অনুগ্রহ করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বাধিক ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (বোখারি : ৮৩৪)।
এই ইস্তিগফারটিও মূলত ‘সাইয়িদুল ইস্তিগফার’ এর অনুরূপ। এতে একটি বিশেষ দিক রয়েছে। আর তা হলো, এতে প্রথমেই বান্দা স্বীকার করছে যে, সে নিজের ওপর-জুলুম করেছে। কেননা, পাপ করা মানেই নিজের ওপর জুলুম করা। মানুষের মন প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহর ভালোবাসা ও তাকে সম্মান করার জন্য সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু যখন বান্দা পাপ করে, তখন সে এই স্বাভাবিক প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ওপর জুলুম করে নিজেকে দুনিয়া ও আখেরাতের শাস্তির মুখে ঠেলে দেয়।
এই দোয়া এমন এক দোয়া যা পাপ স্বীকার করার পাশাপাশি আল্লাহর প্রশংসাও করে ও তার গুণাবলির মাধ্যমে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। এটি প্রকৃত জ্ঞানীদের দোয়া, যার মর্যাদা ও পুরস্কার অনেক বেশি। এটি সেই দোয়া, যা বান্দার আত্মসমালোচনার বহিঃপ্রকাশ, তার পাপের প্রতি অনুশোচনা, তার হৃদয়ের বিনম্রতা ও অহংকারের বিলোপ ঘটাবার স্বীকৃতি। এটি এমন এক দোয়া, যা কবুল হওয়ার আশা করা যায়। এর দ্বারা প্রার্থনা কারী ব্যক্তি আল্লাহর ক্ষমা ও দয়ার স্পর্শ লাভ করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কেউ কোন মন্দ কাজ করে বা নিজের প্রতি জুলুম করার পর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে, আল্লাহকে সে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু পাবে।’ (সুরা নিসা : ১১০)।
ক্ষমা ও সুখের সন্ধান : যদি ইস্তিগফার ও ক্ষমা প্রার্থনা আল্লাহর একত্ববাদের সঙ্গে মিলিত হয়, তাহলে বান্দার সুখ ও সচ্ছলতা আসে এবং তার কষ্ট দূর হয়ে যায়। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কারো কোনো শক্তি নেই। ইস্তিগফারের ফজিলত ও তার প্রতি বান্দার প্রয়োজনীয়তার কারণে আল্লাহ তার বান্দাদের এটি করতে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! ক্ষমা কর ও দয়া কর, তুমিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’ (সুরা মোমিনুন : ১১৮)। কারণ, বান্দা এমন কোনো ভালো আমল করতে পারে না, যাতে সে নিশ্চিতভাবে বলতে পারে, এটি সম্পূর্ণভাবে কবুল হওয়ার উপযোগী হয়েছে; বরং সে সবসময় শঙ্কিত থাকে, হয়তো আমলে কিছু ঘাটতি থেকে গেছে। তাই, তার উচিত ইস্তিগফার করা, যাতে আল্লাহ তার ত্রুটিগুলো পূরণ করেন।
এজন্য সালাত শেষ করার পর তিনবার ইস্তিগফার করা সুন্নত। ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, ‘যারা দৃঢ় সংকল্প ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, তারা ইবাদতের পর বেশি করে ইস্তিগফার করেন। কারণ, তারা বুঝতে পারেন, তাদের ইবাদতে ঘাটতি রয়েছে ও তারা আল্লাহর প্রাপ্য হক যথাযথভাবে আদায় করতে পারেননি, যেমনটি তার মর্যাদার উপযোগী ছিল।’ বান্দা সবসময় কোনো না কোনো গোনাহ করেই ফেলে, তাই সে তার শাস্তির ভয় করে আল্লাহর কাছে ইস্তিগফারের মাধ্যমে ক্ষমা চায়, যাতে আল্লাহ তার পাপ মুছে দেন ও তা ঢেকে রাখেন। ইস্তিগফার মূলত মানুষের হৃদয়ে থাকা পাপের অনুশোচনার বহিঃপ্রকাশ।
রহমত প্রাপ্তির উপায় : যদি আমরা আল্লাহর মাগফিরাত ও রহমত গুণের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব কোরআনের প্রায় ৭০টির বেশি আয়াতে এ দুটি একসঙ্গে এসেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘মাগফিরাত’ শব্দটি আগে এসেছে ও ‘রহমত’ পরে এসেছে। এর কারণ হলো, আল্লাহর রহমত বান্দার জন্য সবচেয়ে বেশি আসতে শুরু করে, যখন সে ইস্তিগফার করে। কারণ, ইস্তিগফার আল্লাহর রহমত লাভের মাধ্যম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি অবশ্যই সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে তাদের ভাই সালিহকে পাঠিয়েছিলাম এই আদেশসহ: ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর’, কিন্তু এরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে বিতর্কে লিপ্ত হলো। সে বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা কেন কল্যাণের পূর্বে অকল্যাণ ত্বরান্বিত করতে চাইছো? কেন তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছো না, যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার?’ (সুরা নামল : ৪৫-৪৬)।
ইস্তিগফার শ্রেষ্ঠ নেক আমলগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এটি অন্যতম বড় ইবাদত যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পায় ও কঠিন শাস্তি থেকে সুরক্ষিত থাকে। প্রতিটি মানুষ গোনাহগার ও আল্লাহর ক্ষমার মুখাপেক্ষী। আল্লাহর ক্ষমা ছাড়া কেউই তার গোনাহের শাস্তি থেকে বাঁচতে পারবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ এমন নন যে, তুমি তাদের মধ্যে থাকবে, অথচ তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন। আর আল্লাহ এমনও নন যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে অথচ তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন।’ (সুরা আনফাল : ৩৩)। হজরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘মহানবী (সা.) ও ইস্তিগফার এই দুটি জিনিস উম্মতের জন্য নিরাপত্তার গ্যারান্টি ছিল। বিশ্বনবী (সা.) দুনিয়া থেকে চলে গেছেন, কিন্তু ইস্তিগফার এখনো বাকি আছে।’
ইস্তিগফার এমন একটি মাধ্যম যা মানুষকে কল্যাণ ও বরকতের দিকে নিয়ে যায় ও দুঃখ-দুর্দশা দূর করে। যেহেতু গোনাহ দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও বিপদের কারণ, তাই ইস্তিগফার এসব থেকে মুক্তির উপায়। ইস্তিগফার মানুষের কষ্টকে স্বস্তিতে, সংকটকে সমাধানে, রোগকে সুস্থতায় ও অভাবকে সচ্ছলতায় পরিবর্তন করে দেয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, তিনি তো মহাক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন, তিনি তোমাদের সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা।’ (সুরা নুহ : ১০-১২)।
ইস্তিগফার শুধু আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে হয় না, বরং কিছু নেক আমলও রয়েছে, যা আল্লাহর ক্ষমা লাভের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার রহমতের উপযুক্ত কারণগুলো ও দৃঢ় ক্ষমার উপায়গুলো চাই।’ তিনি শুধু আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত চাইতেন না, বরং এর জন্য প্রয়োজনীয় আমল ও নেক কাজ করার তৌফিকও চাইতেন। কেননা, আমল ও ভালো কাজই সত্যিকারের তওবা ও ইস্তিগফারের প্রমাণ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আমার আয়াতসমূহে ঈমান আনে তারা যখন তোমার কাছে আসে, তখন তাদের তুমি বল : ‘তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক’, তোমাদের প্রতিপালক দয়া করা তার কর্তব্য বলে স্থির করেছেন। তোমাদের মধ্যে কেউ অজ্ঞতাবশত যদি মন্দ কাজ করে, এরপর তওবা করে আর সংশোধন করে তবে তো আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আনআম : ৫৪)।
ইস্তিগফার শুধু একটি দোয়া নয়, এটি আল্লাহর রহমত লাভের সেতু। এটি পাপ মোচনের মাধ্যম, কল্যাণ লাভের চাবিকাঠি ও কঠিন বিপদ থেকে মুক্তির উপায়। তাই আমাদের উচিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করা, যেন আমরা দুনিয়া ও আখেরাতে সফল হতে পারি।
(১৫-০৮-১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ১৪-০২-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- আবদুল কাইয়ুম শেখ)