সৃষ্টিগতভাবে প্রতিটি মোমিন হৃদয়ে বপিত থাকে প্রেমময় রবের ভালোবাসার ফুলেল বীজ। সে বীজ ধীরে ধীরে অঙ্কুরোদগম হয় এবং মনকাড়ারূপে বিকশিত হয়। একসময় তা মানববাগানে প্রস্ফুটিত ফুল হয়ে দিকে দিকে ঈমানি সুবাস ছড়ায়। কোরআনি সৌরভ বিলায়। কেউ আল্লাহপ্রেমের সন্ধানী হলে, আসমানি সাহায্য পেতে চাইলে তাকে অবশ্যই মনে-প্রাণে ভালবাসতে হবে আল্লাহর বন্ধু প্রিয়তম নবী (সা.)-কে। মানবতার মুক্তির দিশারী মহান এ পথিকৃৎ প্রেমাষ্পদের সুন্নাহর যথার্থ অনুসরণ করতে হবে। জীবনের অঙ্গনে সাধনা প্রাঙ্গণে তাকেই একমাত্র আদর্শরূপে গ্রহণ করতে হবে। জীবন কাননের পরতে পরতে ধারণ করতে হবে নববি ফুলের মোহনীয় সৌরভ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুল! আপনি লোকদের বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১)।
নবীজি (সা.) সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী : যুগে যুগে ইসলামি স্কলারগণ এ কথা অকপটে স্বীকার করেছেন, বিশ্বনবী (সা.)-এর নবুয়তের সত্যতার জন্য কোনো মোজেজা যদি না-ও দেওয়া হতো, তবুও তার অনিন্দ্য সুন্দর আচরণ ও সুমহান চরিত্রই নবুয়তের সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট ছিল। কেননা, এমন মুক্তাজোড়া চরিত্রের বাহার এবং মধুময় আখলাকের সমাহার অন্য কারও ক্ষেত্রে কল্পনা করা যায় না। নিঃসন্দেহে রাসুল (সা.)-এর আলোকিত জীবনদর্শনই আমাদের জীবনের অমূল্য পাথেয়। চেতনায়-বিশ্বাসে, ভাবে-অনুভবে যদি আমরা তা হৃদয় গহীনে লালন করতে পারি, প্রাত্যহিক জীবনে তার যথার্থ প্রতিফলন ঘটাতে পারি, তাহলে একদিকে যেমন আমাদের সবকিছুতে নেমে আসবে বরকত, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির ফল্গুধারা, তেমনি আমাদের জন্য বুকিং থাকবে চির সুখময় জান্নাতে অফুরন্ত নেয়ামতের বারিধারা। তাই নববি চরিতের সোনালি অধ্যায় আমাদের জানতে হবে। জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে তা প্রয়োগ করতে হবে। তবেই আমাদের জীবন হবে আলোকিত, সফল এবং সার্থক।
নবীজি (সা.)-এর বিমল আদর্শ এবং উন্নত দর্শনই আমাদের সফলতার রাজপথ, যাবতীয় সংকট নিরসন এবং উদ্ভূত সমস্যা থেকে উত্তরণের মাধ্যম। তা একদিকে যেমন পার্থিব জীবন বিনির্মাণের মোক্ষম হাতিয়ার, তেমনি অপার্থিব বিজয় ও গৌরব অর্জনেরও মহান সোপান। সন্দেহ নেই, বিশ্বমানবতার অনুপম রূপকার প্রিয়নবী (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শের অধিকারী। উত্তম চরিত্রমালা ও উন্নত শিষ্টাচারের পূর্ণতা দানের জন্যই তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন পৃথিবীতে। বিশ্বনবী (সা.) নিজেই তার আদর্শিক মিশনের ঘোষণা দিয়েছেন, ‘মহোত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা বিধানের জন্যই আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৮৯৫২)।
নবীজি (সা.)-এর ক্ষমা ও মহানুভবতা : মহানবী (সা.) কখনও ব্যক্তিগত কারণে কারও কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না। ক্ষমা ও মহানুভবতা প্রদর্শন, কল্যাণকামিতা ও দয়ার বহিঃপ্রকাশই ছিল তার চিরাচরিত অভ্যাস। এক ইহুদি নবীজি (সা.)-কে জাদু করে অনেক কষ্ট দেওয়ার পরও তিনি তার থেকে কোনো প্রতিশোধ নেননি; অকল্পনীয় মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, যুরাইক গোত্রের লাবিদ ইবনে আসম নামক এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে জাদু করে। (এর ফলে) রাসুল (সা.)-এর মনে হতো, যেন তিনি একটি কাজ করেছেন, অথচ তা তিনি করেননি। একদিন বা একরাত তিনি আমার কাছে ছিলেন। তিনি বারবার দোয়া করতে থাকেন। তারপর বললেন, আয়েশা! তুমি কি বুঝতে পেরেছ, আমি আল্লাহর কাছে যা জানতে চেয়েছিলাম, তিনি আমাকে তা জানিয়ে দিয়েছেন। (স্বপ্নে দেখি) আমার কাছে দু’জন লোক আসেন। তাদের একজন আমার মাথার কাছে, অপরজন দু’পায়ের কাছে বসেন। একজন তার সঙ্গীকে বলেন ‘এ লোকটির কী ব্যথা?’ তিনি বলেন, ‘তাকে জাদু করা হয়েছে।’ প্রথমজন বলেন, ‘কে জাদু করেছে?’ দ্বিতীয়জন বলেন, ‘লাবিদ বিন আসম।’ প্রথমজন জিজ্ঞেস করেন, ‘কিসের মধ্যে?’ দ্বিতীয়জন উত্তর দেন, ‘চিরুনি, মাথা আঁচড়ানোর সময় ওঠা চুল এবং এক পুং খেজুর গাছের ‘জুব’-এর মধ্যে।’ তখন রাসুল (সা.) কয়েকজন সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান। পরে ফিরে এসে বলেন, ‘আয়েশা! সে কূপের পানি মেহেদির পানির মতো লাল এবং তার পাড়ের খেজুর গাছের মাথাগুলো শয়তানের মাথার মতো।’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি এ কথা প্রকাশ করে দেবেন না?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি মানুষকে এমন বিষয়ে প্ররোচিত করতে পছন্দ করি না, যাতে অকল্যাণ রয়েছে।’ তারপর রাসুল (সা.) নির্দেশ দিলে সেগুলো মাটিতে পুতে ফেলা হয়।’ (বোখারি : ৫৭৬৩)।
বিশ্বমানবতার একনিষ্ঠ বন্ধু, মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের স্পন্দন প্রিয়নবী (সা.) এতটাই উদার প্রকৃতির ছিলেন যে, তার অনিষ্ট সাধনকারী শত্রুকে হাতের নাগালে পেয়েও ক্ষমা করে দিতেন। প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মাফ করে দিতেন। ইতিহাস সাক্ষী, যখন মক্কা বিজয় হলো, তখন নবীজি (সা.) বাইতুল্লাহ তওয়াফ করে দু’রাকাত নামাজ পড়লেন, এরপর দু’হাতে (বাইতুল্লাহর) দরজা ধরে মক্কাবাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কী ধারণা করছ? (তোমাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করব বলে তোমাদের ধারণা?)’ তারা বলল, ‘আমরা মনে করি, ভ্রাতৃত্ব, দয়া ও ধৈর্যশীলের পরিচয় দেবেন।’ কথাটি তারা তিনবার বলল। নবীজি (সা.) বললেন, ‘আমি আজ বলব সে কথা, যা ইউসুফ (আ.) তার ভাইদের বলেছিলেন। তা হলো, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সব মেহেরবানদের চেয়ে অধিক মেহেরবান।’ (সুরা ইউসুফ : ৯২)। এরপর তারা চতুর্দিক থেকে বেরিয়ে এসে নবীজি (সা.)-এর হাতে ইসলামের ওপর বাইআত গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যান। (আল আহকামুল উস্তা : ৩/৬৫)।
নবীজি (সা.)-এর সাদামাটা জীবনযাপন : বিশ্বনবী (সা.) আখেরাতমুখী অনাড়ম্বর জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ভোগ-বিলাস ও আমোদণ্ডপ্রমোদ থেকে তিনি যোজন যোজন দূরে থাকতেন। তিনি কখনও আরামদায়ক বিছানায় ঘুমাননি। খেজুর গাছের ছাল ও লতাপাতার তৈরি বিছানায় শয়ন করতেন। এতে তার শরীর মোবারকে দাগ হয়ে যেত। আবদুল্লাহ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) খেজুর পাতার মাদুরে শুয়েছিলেন। তিনি ঘুম থেকে জেগে দাঁড়ালে দেখা গেল, তার গায়ে চাটাইয়ের দাগ পড়ে গেছে। আমরা বললাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা আপনার জন্য যদি নরম বিছানার (তোষকের) ব্যবস্থা করতাম, (তবে তা এই শক্ত চাটাইয়ে শয়নের চেয়ে অধিক উত্তম হতো)।’ তিনি বললেন, ‘দুনিয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? দুনিয়াতে আমি এমন একজন পথচারী মুসাফির ছাড়া তো আর কিছুই নই যে, একটি গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিল (বিশ্রাম করল), তারপর তা ছেড়ে গন্তব্যের দিকে চলে গেল।’ (তিরমিজি : ২৩৭৭)। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর বিছানা ছিল চামড়ার তৈরি এবং তার ভেতরে ছিল খেজুরপাতার আঁশ।’ (বোখারি : ৬৪৫৬)। রাসুল (সা.) সাদাসিধে অনাড়ম্বর ও কৃচ্ছ্রের জীবন গ্রহণ করেছেন স্বেচ্ছায়; যেন উম্মত ভঙ্গুর পৃথিবীর মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে না আনে, দু’দিনের এ পান্থশালার মোহে পড়ে চিরস্থায়ী জীবনকে ভুলে না যায়। আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.)-এর বিছানা দেখে একজন আনসারি নারী তার জন্য তুলার একটি বিছানা পাঠালে তিনি তা ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেন এবং বলেন, ‘আমি যদি আল্লাহর কাছে প্রতিদান চাইতাম, তবে তিনি আমাকে পাহাড় পরিমাণ সোনারুপা দান করতেন।’ (শোআবুল ঈমান : ১৩৯৫)।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম