রোজা ফার্সি শব্দ। রোজ থেকে রোজা। সারা দিনমান উপবাস থাকতে হয়, তাই এই ইবাদতের নাম রোজা। রোজাকে আরবি ভাষায় সওম বা সিয়াম বলে। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় সওম বলতে বোঝায়, প্রত্যেক জ্ঞানসম্পন্ন, সাবালক মুসলমান নর-নারীর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোজাভঙ্গকারী যাবতীয় কাজ থেকে বিরত থাকা।
রোজা যার উপর ফরজ : ফরজ রোজা শুরু হয় রমজানের চাঁদ ওঠার পর। রমজান মাসের চাঁদ উদিত হলেই প্রত্যেক সুস্থ, মুকিম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং মাসিক ও নেফাসমুক্ত প্রাপ্তবয়স্কা নারীর উপর পুরো রমজান মাসব্যাপী রোজা রাখা ফরজ। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, হে ঈমানদাররা! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা খোদাভীরু হতে পার। (সুরা বাকারা : ১৮৩)।
অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস (রমজান) পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। -(সুরা বাকারা : ১৮৫) পবিত্র কোরআনের উপর্যুক্ত দুটি আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ। রাসুল (সা.)-এর হাদিস থেকে আয়াতদুটির অর্থ আরো স্পষ্ট হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমরা (রমজানের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোজা রাখবে, আর যখন (শাওয়ালের) চাঁদ দেখবে, তখন থেকে রোজা রাখা বন্ধ করবে। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে ত্রিশ দিন রোজা রাখবে। (বোখারি : ১৯০৯; মুসলিম : ১০৮০) ইসলামের আবশ্যক বিধান হিসেবে রোজা পালন করা ফরজ এবং রোজা রাখা ফরজ এ কথা বিশ্বাস করাও মুসলমানের ওপর ফরজ।
রমজানের রোজা না রাখার শাস্তি : ইসলামি শরিয়তে গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়া কোনো মুসলমান যদি রমজান মাসের একটি রোজাও ইচ্ছাকৃতভাবে না রাখে, তাহলে সে বড় পাপী হিসেবে গণ্য হবে। দ্বীনের মৌলিক বিধান লঙ্ঘনকারী ও ঈমান-ইসলামের ভিত্তি বিনষ্টকারী হিসেবে পরিগণিত হবে। হাদিসে ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ত্যাগকারী ও ভঙ্গকারীর জন্য কঠিন শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবু উমামা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম আমার কাছে দুই ব্যক্তি আগমন করল। তারা আমার বাহুদ্বয় ধরে আমাকে এক দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে এলো। তারপর আমাকে বলল, আপনি পাহাড়ের উপর উঠুন। আমি বললাম, আমি তো উঠতে পারব না। তারা বলল, আমরা আপনাকে সহজ করে দেব। আমি উপরে উঠলাম। যখন পাহাড়ের সমতলে পৌঁছালাম, হঠাৎ ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি বললাম, এসব কীসের আওয়াজ? তারা বলল, এটা জাহান্নামীদের আর্তনাদ। তারপর তারা আমাকে নিয়ে এগিয়ে চলল। হঠাৎ কিছু লোক দেখতে পেলাম, যাদের তাদের পায়ের মাংসপেশী দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং তাদের মুখের দুই প্রান্ত ছিড়ে ফেলা হয়েছে এবং তা থেকে রক্ত ঝরছে। আমি বললাম, এরা কারা? তারা বলল, যারা ইফতারের সময় হওয়ার আগেই রোজা ভেঙে ফেলে। (সহি ইবনে হিববান : ৭৪৪৮; সুনানে নাসায়ী কুবরা: ৩২৮৬ )
রমজান মাসের একদিন রোজা না রাখলে মানুষ শুধু গোনাহগারই হয় না, ওই রোজার পরিবর্তে আজীবন রোজা রাখলেও রমজানের এক রোজার যে মর্যাদা ও কল্যাণ, যে অনন্ত রহমত ও খায়ের-বরকত, তা কখনো লাভ করতে পারবে না এবং কোনোভাবেই এর যথার্থ ক্ষতিপূরণ আদায় হবে না। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি অসুস্থতা ও সফর ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে রমজানের একটি রোজাও ভঙ্গ করে, সে আজীবন রোজা রাখলেও ওই রোজার হক আদায় হবে না। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ৯৮৯৩; বোখারি : ৪/১৬০)।
রোজার ফজিলত ও বৈশিষ্ট্য : রোজার প্রতিদান আল্লাহতায়ালা নিজেই দেবেন এবং বিনা হিসাবে দেবেন। এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়; একটি নেকির সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতাশ গুণ পর্যন্ত। আল্লাহতায়ালা বলেন, কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। কেননা তা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর বিনিময় প্রদান করব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে। ( মুসলিম : ১১৫১ )
অন্য হাদিসে আছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা বলেন, বান্দা একমাত্র আমার জন্য তার পানাহার ও কামাচার বর্জন করে, রোজা আমার জন্যই, আমি নিজেই তার পুরস্কার দেব আর (অন্যান্য) নেক আমলের বিনিময় হচ্ছে তার দশগুণ। বোখারি : ১৮৯৪)।
আল্লাহতায়ালা পানি পান করাবেন : কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা রোজাদারকে নিজ হাতে পানি পান করাবেন। এ সম্পর্কে হাদিসে আছে, হজরত আবু মুসা (রা.) হতে বর্ণিত, আল্লাহতায়ালা নিজের উপর অবধারিত করে নিয়েছেন, যে ব্যক্তি তার সন্তুষ্টির জণ্য গ্রীষ্মকালে (রোজার কারণে) পিপাসার্ত থেকেছে, তিনি তাকে তৃষ্ণার দিন (কেয়ামতের দিন) পানি পান করাবেন। (মুসনাদে বাযযার,: ১০৩৯; মাজমাউয যাওয়াইদ : ৫০৯৫) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত অপর হাদিসে নবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা বলেন, রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। কেয়ামতের দিন রোজাদারদের জন্য একটি বিশেষ পানির হাউজ থাকবে, যেখানে রোজাদার ছাড়া অন্য কারো আগমন ঘটবে না। (মুসনাদে বাযযার : ৮১১৫; মাজমাউয যাওয়াইদ : ৫০৯৩)।
জান্নাত লাভের মাধ্যম : হজরত হুযায়ফা (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর নবী (সা.)-কে আমার বুকের সাথে মিলিয়ে নিলাম, তারপর তিনি বললেন, যে ব্যক্তি লাইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে মৃত্যুবরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় একদিন রোজা রাখবে, তারপরে তার মৃত্যু হয় সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো দান-সদকা করে তারপর তার মৃত্যু হয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুসনাদে আহমদ : ২৩৩২৪ )
‘রাইয়ান’ গেট দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ : হজরত সাহল ইবনে সা’দ (রা.) হতে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, জান্নাতে একটি গেট আছে, যার নাম রাইয়ান। কেয়ামতের দিন এ গেট দিয়ে শুধু রোজাদার ব্যক্তিরাই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা করা হবে- কোথায় সেই সৌভাগ্যবান রোজাদাররা? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। তারা ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। অতঃপর রোজাদাররা যখন প্রবেশ করবে, তখন তা বন্ধ করে দেয়া হবে। ফলে কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বোখারি : ১৮৯৬; মুসলিম : ১১৫২)।
জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢাল : রোজা জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢালস্বরূপ। হজরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, আমাদের মহান রব বলেন- রোজা হলো ঢাল। বান্দা এর দ্বারা নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। রোজা আমার জন্য আর আমিই এর পুরস্কার দেব। (মুসনাদে আহমদ: ১৪৬৬৯)। অন্য হাদিসে আছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, রোজা হলো (জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ লাভের) ঢাল এবং সুরক্ষিত দুর্গ। (মুসনাদে আহমদ : ৯২২৫)।
কেয়ামতের দিন সুপারিশকারী : রোজা কেয়ামতের দিন রোজাদারের জন্য সুপারিশ করবে। এ প্রসঙ্গে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, রোজা ও কোরআন কেয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে রব! আমি তাকে খাদ্য ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব, তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, (অর্থাৎ না ঘুমিয়ে সে তেলাওয়াত করেছে) অতএব, তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। রাসুল (সা.) বলেন, অতঃপর তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। (মুসনাদে আহমদ : ৬৬২৬)।
রোজা পাপমোচনকারী : রোজা গোনাহের কাফফারা হওয়া তথা পাপমোচনকারী হওয়া কোরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন প্রকার গোনাহের কাফফারা স্বরূপ রোজার বিধান নাজিল করেছেন। যেমন ইহরাম অবস্থায় (অসুস্থতা বা মাথার কষ্টের কারণে) মাথা মুণ্ডানোর কাফফারা স্বরূপ (২:১৯৬), কোনো জিম্মি বা চুক্তিবদ্ধ কাফেরকে ভুলক্রমে হত্যার কাফফারা স্বরূপ (৪:৯২), কসমের কাফফারা স্বরূপ (৫:৮৯) এবং জিহারের কাফফারা স্বরূপ (৫৮:৩-৪); আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বিভিন্ন মেয়াদে রোজার হুকুম দেয়া হয়েছে। তাই সহজেই বোধগম্য, রোজা বান্দার পাপগুলোকে ধুয়ে-মুছে রোজাদারকে পরিশুদ্ধ করে। হজরত হুযায়ফা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, মানুষের জন্য তার পরিবার, ধন-সম্পদ, তার আত্মা, সন্তান-সন্ততি ও প্রতিবেশী ফিতনা স্বরূপ। তার কাফফারা হলো নামাজ, রোজা, দান-সদকাহ, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। (বোখারি : ৫২৫, ১৮৬৫; মুসলিম : ২৮৯২-২৬)।
লেখক : ভাইস প্রিন্সিপাল, ঢাকা আইডিয়াল সিটিজেন মাদ্রাসা, মানিকনগর, মুগদা, ঢাকা