ঢাকা বুধবার, ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ২৬ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মদিনা শরিফের জুমার খুতবা

রমজান সংযম ও আত্মশুদ্ধির আহ্বান

শায়খ ড. আবদুল বারি বিন ইওয়ায আস-সুবাইতি
রমজান সংযম ও আত্মশুদ্ধির আহ্বান

রমজানুল মোবারক আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। এর আগমনে আল্লাহ প্রেমিকদের হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার বইছে। এর ভোর পবিত্র আবহ সৃষ্টি করছে ও তার নুর হৃদয় আলোকিত করছে। রমজান সেরা মাস, ইবাদতের অফুরন্ত উৎস। এই মাসেই নাজিল হয়েছে আল কোরআন। ইসলামের মর্যাদা বেড়েছে এরই ছায়ায় ও পরশে। আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে এর অগণিত ফজিলত। এটি প্রতিযোগিতার ময়দান তাদের জ্বন্য, যারা এর মূল্য বোঝে। এটি আলোকিত পথযাত্রার উৎস তাদের জ্বন্য, যারা এর রহস্য উপলব্ধি করে। এটি মুক্তির মৌসুম তাদের জ্বন্য, যারা আন্তরিকভাবে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। এটি ঈমানের বাগান তাদের জ্বন্য, যাদের অন্তর পবিত্র এবং চিন্তা পরিষ্কার। হজ্বরত জাবির (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা প্রতি ইফতারের প্রতি রাতে বেশ সংখ্যক লোককে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তি দান করেন।’ (ইবনে মাজাহ : ১৬৪৩)। ?হজ্বরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রাতে ঈমানসহ পুণ্যের আশায় রাত জেগে ইবাদত করে, তার আগের কৃত গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়।’ (বোখারি : ৩৭)। হজ্বরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় তারাবির সালাতে দাঁড়াবে তার পূর্ববর্তী গোনাহগুলো মাফ করে দেয়া হবে।’(বোখারি : ২০০৯)।

রমজানের প্রস্তুতি : রমজান এসেছে। এর বরকত বর্ষিত হচ্ছে। বইয়ে যাচ্ছে এর সওয়াবের স্রোতধারা। এই মহান মাসে আমাদের যথাযথ প্রস্তুতি নেয়া কি উচিত নয়? আমাদের আচরণ ও আমল কি এর মর্যাদা অনুযায়ী হওয়া উচিত নয়? রমজানের দিনগুলো সীমিত, এর সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়। এটি যেন এক নির্মল বাতাসের মতো, মুহূর্তেই বয়ে যায়। তাই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া : অপ্রয়োজ্বনীয় ব্যস্ততা কমিয়ে মনকে ফোকাস করা, চিন্তাগুলো পরিশুদ্ধ করা। প্রশান্ত হৃদয় অর্জিত হলে জিকিরের স্বাদ মিষ্টি হয়, তাসবিহ আরও গভীর হয়, কোরআন তিলাওয়াতে এক অনন্য অনুভূতি আসে, আর রাতের কিয়াম (তারাবিহ ও তাহাজ্জুদ) হয়ে ওঠে প্রশান্তির উৎস।

হৃদয় পরিশুদ্ধ করা : রমজান মাসে অবশ্যই হিংসা, বিদ্বেষ, সম্পর্কের টানাপোড়েন ও অন্তরের অসুস্থতা দূর করা উচিত। কেননা, এসব অশিষ্ট আচরণ আল্লাহর রহমত পাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে। রোজার প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না, যদি অন্তরে ঘৃণা থাকে, আর কিয়ামুল লাইলের আলো পাওয়া যায় না যদি আত্মা হিংসায় ডুবে থাকে।

সময়ের সদ্ব্যবহার : রমজান মাসে প্রতিটি মোমিনের জ্বন্য আবশ্যক কাজ্ব হলো, অপ্রয়োজ্বনীয় কাজ্ব কমিয়ে সময়ের সদ্ব্যবহার করা, যাতে ফজিলতপূর্ণ রমজান মাস খেলাধুলা ও তুচ্ছ কাজে নষ্ট না হয়। রমজানের জ্বন্য সর্বোত্তম প্রস্তুতি হলো, আল্লাহর দরবারে বিনীত মনে এই দোয়া করা, ‘হে আল্লাহ, আমাকে তোমার স্মরণ, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও সুন্দর ইবাদতের তৌফিক দান করো।’

রোজাদারের আনন্দ : রমজান হৃদয়ে আনন্দ ছড়িয়ে দেয়। আর তা প্রত্যেক ইবাদতের প্রভাব ও প্রতিটি আনুগত্যের ফল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রোজাদারের জ্বন্য দুটি আনন্দ রয়েছে। একটি ইফতারের সময় ও অন্যটি তার প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।’ (মুসলিম : ২৫৯৭)। ইফতারের আনন্দ আসে দিনের দীর্ঘ ধৈর্যের পর, যখন এক ফোঁটা পানি তৃষ্ণা মেটায়, এক টুকরো খাবার ক্ষুধা নিবারণ করে। কিন্তু আসল আনন্দ সেই সময়, যখন বান্দা তার রবের সঙ্গে মিলিত হবে, আর তিনি সন্তুষ্ট হবেন। তখন বছরের পর বছর কষ্টের স্মৃতি মুছে যাবে, দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট ধুয়ে যাবে, জান্নাতের দরজা খুলে যাবে, আর রোজাদার উজ্জ্বল মুখ আর প্রশান্ত আত্মা নিয়ে ‘রাইয়ান’ নামক বিশেষ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

রমজান কোরআনের মাস : রমজান কোরআনের মাস। এই মাসে কোরআন তেলাওয়াতের এক অনন্য স্বাদ আছে, যা হৃদয়কে আনন্দে ভরিয়ে দেয় ও আত্মাকে প্রশান্ত করে। কোরআনের আয়াত অন্তরে আলো ছড়িয়ে দেয়, শব্দগুলো মনে প্রশান্তি আনে, আর তেলাওয়াতের সুর হৃদয় নরম করে তোলে। মনে হয়, প্রতিটি আয়াত যেন নতুন করে আত্মাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি অক্ষর যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।

রমজান দোয়ার মাস : রমজানে মনের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে বিনয়ী প্রার্থনা। আত্মা দোয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করে, হৃদয় প্রশান্ত হয় আল্লাহর সান্নিধ্যে। রাতের নীরবতায় দোয়া উঠে যায় আল্লাহর দরবারে, যেখানে দরজা খোলা থাকে, আর রব অত্যন্ত নিকটে থাকেন। রমজানের রোজার আয়াতের পরই আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। প্রার্থনাকারী যখন আমার নিকট প্রার্থনা করে আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দিই। সুতরাং তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক ও আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা ঠিক পথে চলতে পারে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৬)। আল্লাহতায়ালা এখানে বলেননি, ‘বলো আমি কাছাকাছি’, বরং নিজেই সরাসরি বললেন, ‘আমি তো কাছেই আছি’। এটি আল্লাহর অগাধ দয়া, অপার ভালোবাসা ও দ্রুত দোয়া কবুল করার প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে। রমজানে আল্লাহতায়ালা বান্দার দোয়া কবুল করেন। তিনি বান্দার আরজি মঞ্জুর করেন, ফিরিয়ে দেন না।

রমজান সংযমের প্রশিক্ষণ : রমজান ইচ্ছাশক্তির প্রশিক্ষণ ও আত্মসংযমের ময়দান। এটি রোজাদারকে নিজের প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়, জিহ্বাকে সংযত রাখতে বলে, রাগ ও খারাপ কথাবার্তা থেকে দূরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। সে শিখে কীভাবে নিজের চাহিদাকে সংযত রাখতে হয় ও আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। রোজাদার দীর্ঘসময় তারাবিহতে দাঁড়িয়ে ধৈর্যের শিক্ষা নেয়, ইবাদতে আত্মাকে সংযত করে, কষ্টের সঙ্গে লড়াই করে। এর ফলে দৃঢ় সংকল্প তৈরি হয়, ইচ্ছাশক্তি প্রবল হয়। এই ইচ্ছাশক্তি শুধু রমজানেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং জীবনেজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের স্বাদ পেয়েছে, তার ঈমান উচ্চ হয়। আর ইসলাম তার জীবনে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে প্রবৃত্তির দাস হয় না, অলসতাকে প্রশ্রয় দেয় না, বরং তার লক্ষ্য থাকে বড় ও সংকল্প থাকে দৃঢ়। দুনিয়ায় সফল ও পরকালে বিজ্বয়ী তারাই, যাদের ইচ্ছাশক্তি অটুট ও সংকল্প প্রবল।

রমজানে আল্লাহর বিশেষ ছাড় : আল্লাহ রোগী ও মুসাফিরের জ্বন্য বিশেষ ছাড় দিয়েছেন; তাদের জ্বন্য রোজা পরে রাখার সুযোগ রেখেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জ্বন্যে যা সহজ্ব, তা চান আর যা তোমাদের জ্বন্যে কষ্টকর, তা চান না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)। এতে বোঝা যায়, ইসলামের প্রতিটি বিধানই দয়া ও সহজ্বতার জ্বন্য, কষ্ট দেয়ার জ্বন্য নয়। রোজা কেবল শারীরিক কষ্টের জ্বন্য নয়, বরং আত্মার পরিশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের জ্বন্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমাদের জ্বন্যে সিয়ামের বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা পরহেজ্বগার হতে পার।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)।

মানুষকে উন্নত করার মাস : রমজান শুধু ইবাদতের মাস নয়, এটি মানুষকে উন্নত করার এক প্রশিক্ষণও। এটি ব্যক্তি ও সমাজের নৈতিকতা গঠনে ভূমিকা রাখে। রোজা চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করে, তারাবিহ আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখায়, কোরআন আত্মায় সততা ও নিষ্ঠার বীজ্ব বোনে। যদি কোনো ব্যক্তি নিজেকে শুদ্ধ করতে পারে, তাহলে তার চারপাশের সমাজ্বও উন্নত হয়। ইবাদত নিছক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি জীবনের একটি চালিকাশক্তি, যা মানুষকে প্রকৃত সভ্যতা ও উন্নতির পথে এগিয়ে নেয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না এরা নিজ্ব অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।’ (সুরা রাদ : ১১)।

ঐক্যের প্রতীক : রমজান উম্মাহকে একসূত্রে গেঁথে দেয়। এই মাসে ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা সবাই একসঙ্গে রোজা রাখে, একসঙ্গে ইফতার করে ও কাতারবদ্ধ হয়ে নামাজ্ব পড়ে। এসময় মুসলিম উম্মাহ একটি দেহের মতো হয়ে যায়। যদি এক অংশ ব্যথিত হয়, তাহলে পুরো দেহই তার অনুভূতি পায়। কাজেই রমজান বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যের প্রতীক।

সহমর্মিতার শিক্ষা : রমজান আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই ভাই-বোনদের কথা, যারা ক্ষুধার্ত থাকে, তৃষ্ণায় কষ্ট পায়। যারা এক টুকরো খাবারের অপেক্ষায় থাকে ও এক ফোঁটা পানির জ্বন্য আকুল হয়। রোজা রাখার ফলে ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুভব করা যায়, তৃষ্ণার কষ্ট বোঝা যায়। এগুলোই দানশীলতা ও সহমর্মিতার চেতনাকে জাগিয়ে তোলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সবচেয়ে উদার ব্যক্তি, আর তিনি রমজানে সবচেয়ে বেশি দানশীল হতেন। তিনি যেন এক মুক্ত বাতাসের মতো ছিলেন। অব্যাহত দান করতেন, কারো আবদার প্রত্যাখ্যান করতেন না, কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না।

দান-সদকার গুরুত্ব : রমজানে দান করা শুধু অর্থ ব্যয় নয়, বরং এটি হতে পারে একজ্বন গরিবের জ্বন্য খাবার, একজ্বন বন্দির জ্বন্য সহায়তা, একজ্বন অভাবীর জ্বন্য খাদ্যসামগ্রী বা মৃত বাবা-মায়ের জ্বন্য সদকায়ে জারিয়া। দানের পথ অসংখ্য । যে ব্যক্তি খালেস নিয়তে দান করে, সে নিশ্চিত থাকে যে, তার প্রতিটি দান বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা নিজেদের ধনৈশ্বর্য আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি শস্যবীজ্ব, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশত শস্যদানা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা : ২৬১)।

(২২-০৮-১৪৪৬ হিজ্বরি মোতাবেক ২১-০২-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- আবদুল কাইয়ুম শেখ)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত