রমজান যেমন রোজার মাস, তেমনি পবিত্র কোরআনেরও মাস। রমজান মাসের সঙ্গে আল কোরআনের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও গভীর। ফলে রমজান মাস হলো রোজার মাস। তাকওয়া বা খোদাভীতির মাস। রহমত, বরকত, নাজাত, মাগফেরাতের মাস। বিশেষভাবে কোরআনের মাস। এ মাসেই মহাগ্রন্থ আল কোরআন লওহে মাহফুজ্ব থেকে নিকটবর্তী আসমানে নাজিল হয়েছিল। ফলে রমজান পবিত্র কোরআন নাজিল বা অবতরণের সম্মানে সম্মানিত মাস। রমজানে রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরআনচর্চার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন।
তিনি অধিক পরিমাণ তেলাওয়াত করতেন এবং ফজ্বরের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত মসজিদে নববিতে সাহাবিদের কোরআন শিক্ষা দিতেন। কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অত্যধিক সাওয়াব অর্জনের মাস রমজান। কেননা, কোরআনের বিশেষত্ব হচ্ছে একটি হরফ তেলাওয়াতে ১০টি নেকি লাভ হয়। আর রমজানের বিশেষত্ব হচ্ছে, একটি নেকি ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। তাই রমজানে কোরআনের একটি হরফ তেলাওয়াত করলে ১০ থেকে ৭০০ পর্যন্ত নেকি পাওয়া যায়। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রমজান মাস, যে মাসে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, মানুষের জ্বন্য হেদায়াতরূপে এবং পথনির্দেশনার প্রমাণ ও সত্যমিথ্যা পার্থক্য নির্ণয়কারী হিসেবে। সুতরাং তোমাদের যে কেউ এ মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে এবং আল্লাহকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহর কিতাব থেকে একটি অক্ষর তেলাওয়াত করে, তার বিনিময়ে সে একটি নেকি পাবে। আর একটি নেকির বিনিময় হবে ১০ গুণ। এ কথা বলছি না যে, আলিফ লাম মীম একটি অক্ষর; বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর, মীম একটি অক্ষর। বস্তুত, কোরআন তেলাওয়াত মর্যাদাপূর্ণ একটি আমল। এটিকে লোকসানমুক্ত ব্যবসা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর প্রতিদান কখনো বিনষ্ট হয় না।’ (তিরমিজি : ২৯১০)। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহকে স্মরণ করে আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে, নামাজ্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করে এমন ব্যবসার, যার কোনো ক্ষয় নেই। এজ্বন্য যে, আল্লাহ তাদের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন এবং তিনি নিজ্ব অনুগ্রহে তাদের আরো বেশি দেবেন; তিনি সর্বোত্তম ক্ষমাশীল ও গুণগ্রাহী।’ (সুরা ফাতির : ২৯-৩০)।
প্রতি রমজানে রাসুলুল্লাহ (সা.) ও জিবরিল (আ.) পরস্পরকে কোরআন শোনাতেন। ফাতিমা (রা.) থেকে বর্ণিত; ‘তার পিতা তাকে বলেছেন, প্রতি রমজানে জিবরিল (আ.)-কে একবার কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। কিন্তু মৃত্যুর বছর তিনি তাকে দুবার কোরআন শোনান।’ (বোখারি : ৬২৮৫)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রমজানের প্রতি রাতে জিবরিল (আ.) রাসুল (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হতেন এবং তারা উভয়েই কোরআন তেলাওয়াত করতেন, একে অপরকে শোনাতেন।’ (বোখারি : ০৬)। তাছাড়া রোজা এবং কোরআন কেয়ামতের দিন বান্দাকে সুপারিশ করবে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রোজা এবং কোরআন বান্দার জ্বন্য শাফায়াত করবে। রোজা বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে দিনের বেলা খাবার গ্রহণ করতে ও প্রবৃত্তির তাড়না মেটাতে বাধা দিয়েছি। অতএব, তার ব্যাপারে এখন আমার শাফায়াত কবুল করুন। কোরআন বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। অতএব, তার ব্যাপারে এখন আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে। (মুসতাদারাকে হাকিম : ২০৩৬; শুআবুল ঈমান : ১৮৩৯)।
কোরআন তেলাওয়াতের সর্বোত্তম সময় শেষ রাত। কেননা, এই সময়ে মনমানসিকতা শান্ত ও পবিত্র থাকে। চিন্তা-ভাবনার প্রখরতা তৈরি হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আপনার ওপর ভারী কথা অবতীর্ণ করেছি। অবশ্যই রাত জাগা এমন কাজ্ব, যার মাধ্যমে শক্তভাবে প্রবৃত্তির দমন হয় এবং উত্তমরূপে কথা বলা যায়।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল : ৬)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত; নবি করিম (সা.) আমাকে বলেছেন, ‘তুমি আমাকে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাও। আমি বললাম, আমি আপনাকে তেলাওয়াত করে শোনাব? অথচ আপনার ওপরই এটি অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি বললেন, আমি অন্যের তেলাওয়াত শুনতে পছন্দ করি। এরপর আমি তাকে সুরা নিসা থেকে পড়ে শোনাতে লাগলাম। তখন তিনি বললেন, থামো, যথেষ্ট হয়েছে। দেখা গেল, তখনই তাঁর চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে।’ (বোখারি : ৫০৫০)।
রমজানের তেলাওয়াতে রয়েছে অধিক ফজিলত ও সাওয়াবের ঘোষণা। আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোরআন তেলাওয়াতকারী মোমিন ব্যক্তি কমলালেবুর মতো, যা খেতে সুস্বাদু এবং সুগন্ধিযুক্ত। যে মোমিন ব্যক্তি কোরআন তেলাওয়াত করে না সে খেজুরের মতো, যা খেতে সুস্বাদু কিন্তু সুগন্ধিবিহীন। কোরআন তেলাওয়াতকারী মুনাফিক ব্যক্তি সুগন্ধি গুল্মের সাথে তুলনীয়; যা খুব সুগন্ধিযুক্ত কিন্তু খেতে তিক্ত। যে মুনাফিক ব্যক্তি কোরআন তেলাওয়াত করে না, সে মাকাল ফলের মতো, যা খেতেও বিস্বাদ এবং যার কোনো সুগন্ধিও নেই।’ (বোখারি : ৫০২০; মুসলিম : ৭৯৭) ।
লেখক : তরুণ লেখক ও সম্পাদক
ই-মেইল : durbinsylbd@gmail.com