মসজিদে নববিতে জুমার খুতবা

রোজা আত্মা পরিচর্যার মাস

শায়খ ড. আহমদ বিন আলি আল-হুযাইফি

প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আল্লাহ মুসলিম উম্মাহর প্রতি দয়া করে রমজান মাসকে শ্রেষ্ঠ মাস হিসেবে দান করেছেন, একে তিনি মাসসমূহের শিরোমণি বানিয়েছেন, ঈমানদারদের জন্য একটি লাভজনক ব্যবসার সুযোগ ও সময়ের বসন্ত বানিয়েছেন। রমজান মাস পাওয়া এক মহা নেয়ামত, যা পাওয়ার পর অবশ্যই-এর দাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের পথনির্দেশ, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে রোজা পালন করে। কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা সহজ তা চান আর যা তোমাদের জন্যে কষ্টকর তা চান না। এজন্যে যে, তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করবে আর তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করানোর কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করবে, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)।

এই আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেন, ‘যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার’ অর্থাৎ রমজান মাস পাওয়া এক মহা নেয়ামত, যার জন্য আল্লাহর প্রতি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। এটি এক সম্মানিত সময়, এক মহিমান্বিত মুহূর্ত, যেখানে বান্দা আল্লাহর নৈকট্যের পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে এবং অল্প সময়ে এমন দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে, যা অন্য সময়ে সম্ভব নয়। কারণ, এই সংক্ষিপ্ত সময়েই ইবাদতের দরজাগুলো উন্মুক্ত হয় ও কল্যাণের পথগুলো প্রশস্ত হয়।

রোজার অভাবনীয় লাভ : হজরত তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রা.) বলেন, দু’ব্যক্তি দূর-দূরান্ত থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এসে উপস্থিত হলো। তারা ছিলো খাঁটি মুসলমান। তাদের একজন ছিলো অপরজন অপেক্ষা শক্তিধর মুজাহিদ। তাদের মধ্যকার মুজাহিদ ব্যক্তি যুদ্ধ করে শহিদ হলো ও অপরজন এক বছর পর মারা গেলো। তালহা (রা.) বলেন, আমি একদা স্বপ্নে দেখলাম, আমি জান্নাতের দরজায় উপস্থিত হয়েছি ও তাদের সঙ্গে আছি। জান্নাত থেকে এক ব্যক্তি বের হয়ে এলো ও তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি পরে মারা গিয়েছিল তাকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দিলো। সে পুনরায় বের হয়ে এসে শহিদ ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দিলো। পরে সে আমার কাছে ফিরে এসে বললো, তুমি চলে যাও। কেননা তোমার (জান্নাতে প্রবেশের) সময় এখনো হয়নি, তোমার পালা পরে। সকাল বেলা তালহা (রা.) উক্ত ঘটনা লোকদের নিকট বর্ণনা করলে তারা এতে বিস্ময়াভিভূত হলো। বিষয়টি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কানে গেলো এবং তারাও তার কাছে ঘটনা বর্ণনা করল। তিনি বলেন, কী কারণে তোমরা বিস্মিত হলে? তারা বললো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এই ব্যক্তি তাদের দুজনের মধ্যে অধিক শক্তিধর মুজাহিদ। তাকে শহিদ করা হয়েছে। অথচ অপর লোকটি তার আগেই জান্নাতে প্রবেশ করল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, অপর লোকটি কি তার পরে এক বছর জীবিত থাকেনি? তারা বলল, হ্যাঁ। তিনি বলেন, সে একটি রমজান পেয়েছে ও রোজা রেখেছে। তাছাড়া সে কি এক বছর যাবৎ এই এই নামাজ কি পড়েনি? তারা বললো, হ্যাঁ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আসমান-জমিনের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে, তাদের দুজনের মধ্যে রয়েছে তার চেয়ে অধিক ব্যবধান।’ (ইবনে মাজাহ : ৩৯২৫)। রমজান পাওয়া ও তার ইবাদত করার মর্যাদা কত বিশাল, তা এই হাদিসের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায়।

আত্মসাধনার মাস : রমজান মাস সাধনার মাস। মানব আত্মাকে আল্লাহর দিকে ফিরে আনার মাস। একজন মোমিন আল্লাহ থেকে যত দূরেই সরে যাক না কেন, তার হৃদয় যত কঠিনই হয়ে যাক না কেন, তার চোখের পানি শুকিয়ে গেলেও, তার অন্তরের গভীরে এখনো কল্যাণের আলো রয়েছে, ভালো পথে ফেরার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সে আল্লাহর স্মরণভূমিতে ফিরে যেতে চায়, বিচ্ছেদের কষ্টে কাঁদে। রমজান মাসে আল্লাহর প্রতি মন ফিরে আসার, তার ইবাদতে প্রশান্তি পাওয়ার, তার সান্নিধ্যে আনন্দ লাভের ও তার সঙ্গে একান্ত মুহূর্ত উপভোগ করার রহস্য লুকিয়ে আছে। এই মাসে আল্লাহ কল্যাণের দরজাগুলো খুলে দেন, রহমতের অসংখ্য মাধ্যম তৈরি করেন ও বরকতের বৃষ্টি বর্ষণ করেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শয়তান ও দুষ্ট জিনদের রমজান মাসের প্রথম রাতেই শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয় ও তার একটি দরজাও তখন আর খোলা হয় না। খুলে দেওয়া হয় জান্নাতের দরজাগুলো ও তার একটি দরজাও তখন আর বন্ধ করা হয় না। (এ মাসে) একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেন, হে কল্যাণ অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে পাপাসক্ত! বিরত হও। আর বহু লোককে আল্লাহতাালার পক্ষ হতে এ মাসে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়। প্রত্যেক রাতেই এরূপ হতে থাকে।’ (তিরমিজি : ৬৮২)।

রমজান কোরআন ও দানের মাস : রমজান মাস কোরআনের মাস, যে মাসে আল্লাহর বাণী নাজিল হয়েছে, যে মাসে তার রহমত ও বরকত প্রবাহিত হয়। তাই এতে আত্মায় ও হৃদয়ে এমন এক কল্যাণের ধারা বইতে থাকে, যার প্রভাব শরীর ও কর্মকাণ্ডেও পরিদৃষ্ট হয়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। রমজানে তিনি আরো অধিক দানশীল হতেন, যখন জিবরীল আ. তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। আর রমজানের প্রতি রাতেই জিবরাঈল (আ.) তাঁর সাথে দেখা করতেন এবং তারা একে অপরকে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুল (সা.) রহমতের বায়ু অপেক্ষাও অধিক দানশীল ছিলেন।’ (বোখারি : ৬)।

আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রশিক্ষণ : রমজান এমন একটি মাস, যে মাসে আত্মার সমস্ত বাধা ও শৃঙ্খল ভেঙে যায়, প্রবৃত্তির জোয়ার ও খেয়াল-খুশির দাসত্ব থেকে বেরিয়ে এসে আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্জিত হয়। যার ফলে মানুষ আল্লাহর পথে চলতে পারে। সুতরাং ধন্য সেই ব্যক্তি, যে এই বরকতময় মুহূর্তগুলো পেয়েছে, যে এগুলোকে কাজে লাগানোর তৌফিক পেয়েছে এবং আল্লাহর আনুগত্য ও সন্তুষ্টির পথে অগ্রসর হয়েছে।

রমজান মাস এমন একটি সময়, যেখানে ইসলামের মহান শিক্ষা ও বিধান বাস্তবায়িত হয়। এই মাসের উদ্দেশ্য শুধু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পানাহার থেকে বিরত থাকা নয়; বরং এটি আত্মশুদ্ধির এক মহাসুযোগ, যেখানে চরিত্র গঠিত হয়, নফস সংযত হয়, কুপ্রবৃত্তি ও খেয়াল-খুশির লাগাম টেনে ধরা হয়। রমজান মানুষকে ধৈর্য ও সহনশীলতার পোশাক পরায়, যা ব্যক্তি ও সমাজের জন্য গভীর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী কাজ করা বর্জন করেনি, তার পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’ (বোখারি : ১৯০৩)। রমজানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো, প্রকৃত দাসত্ব ও ঈমানের সত্যতা অর্জন করা, যা মানুষকে আল্লাহর প্রতি গভীর সচেতনতার (ইহসানের) স্তরে উন্নীত করে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ইহসান হলো, তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে, যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ। যদিও তুমি তাকে দেখতে পাওনা, কিন্তু তিনি তোমাকে দেখছেন।’ (মুসলিম : ১)।

রোজার ফজিলত : রোজা এমন এক ইবাদত, যা মানুষ ও অন্য কারো মধ্যে গোপনীয়। এটি বান্দার অন্তরের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ককে দৃঢ় করে, বিশুদ্ধ নিয়ত ও আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের শিক্ষা দেয়। এক্ষেত্রে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির অবস্থা বাহ্যিকভাবে অভুক্ত থাকা ব্যক্তির মতো হলেও, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রোজা রাখার গভীর তাৎপর্য রয়েছে। এ কারণেই আল্লাহ রোজাকে তার নিজের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারণ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানব সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের সওয়াব দশ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু রোজা আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিফল দান করব। বান্দা আমারই জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে ও পানাহার পরিত্যাগ করেছে।’

(মুসলিম : ২৫৯৭)। সুতরাং একজন মোমিন বান্দা রোজা রাখে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, আল্লাহর উপস্থিতির প্রতি সচেতন থেকে। আল্লাহর আনুগত্যে অটল ও নিবেদিত থেকে। (০৭-০৯-১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ০৭-০৩-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- আবদুল কাইয়ুম শেখ)