মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র মাহে রমজান দিয়েছেন ইবাদতের মৌসুম হিসেবে। বিভিন্ন আমলের মাধ্যমে এই রমজানের শেষ দশককে করেছেন আরো সম্মানিত ও মহিমান্বিত। শেষ দশকের মর্যাদা তাই অন্য দুই দশক থেকে অনেকাংশে বেশি। এই দিনগুলোতে মহানবী (সা.) সবচেয়ে বেশি ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন বলে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে।? হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) শেষ দশকে যে পরিমাণ ইবাদত করতেন, অন্যকোনো সময় তা করতেন না।’ (মুসলিম : ১১৭৫)। তিনি এ দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে রাত জেগে ইবাদত করতেন। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথম বিশদিন (রাতে) নামাজ পড়তেন এবং ঘুমাতেন। কিন্তু শেষ ১০ দিন ঘুমাতেন না, বরং পরিধেয় বস্ত্রকে শক্ত করে বেঁধে নামাজে মনোনিবেশ করতেন।’ (বোখারি : ২০২৪)।
মহানবী (সা.) শেষ দশকে শুধু নিজে ইবাদত করতেন না, বরং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও ইবাদতের জন্য জাগিয়ে তুলতেন। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক আসত, মহানবী (সা.) শরীরের পোশাককে শক্ত করে বাঁধতেন। রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।’ (মুসলিম : ১১৭৪)। শেষ দশকের বিশেষ ফজিলতপূর্ণ দুটি ইবাদত রয়েছে, যেগুলোর মর্যাদা আল্লাহতায়ালার কাছে অনেক বেশি। সেগুলো হলো- ইতিকাফ ও লাইলাতুল কদর।
ইতিকাফ : ইতিকাফ মানে হলো আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদত করার নিমিত্তে জাগতিক জীবনের ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে মসজিদে অবস্থান করা। ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। প্রত্যেক মসজিদে অন্তত একজন হলেও শেষ দশকের ইতিকাফ করতে হবে। নয়তো মসজিদের আশপড়শি সবাই গোনাহগার হবে। মহানবী (সা.) সারাজীবন শেষ দশকের ইতিকাফ করতেন। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক রমজানে শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন।’ (বোখারি : ২০৪৪)। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম এমনকি উম্মাহাতুল মোমিনিনরাও নিজেদের ঘরে ইতিকাফ করেছেন। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আমৃত্যু রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। তার ইন্তেকালের পর তার স্ত্রীগণও ইতিকাফ করতেন।’ (বোখারি : ২০২৬)। মহানবী (সা.) শেষ দশকে ইতিকাফ করতে উম্মতকেও আদেশ করেছেন। হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই ইতিকাফ করতে চায়, সে যেন শেষ দশকে ইতিকাফ করে।’ (মুসলিম : ১১৬৭)।
ইতিকাফের ফজিলত : ইতিকাফের বিভিন্ন ফজিলতের কথা হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য একদিন ইতিকাফ করবে, আল্লাহতায়ালা তার ও জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন। প্রত্যেক পরিখার দূরত্ব হবে দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি।’ (মুজামুল আওসাত : ৭৩২৬)। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে নেকির প্রত্যাশায় ইতিকাফ করবে, তার পেছনের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ (জামে সগির : ১২২৩০)। হজরত হোসাইন ইবনে আলি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করবে, সে দুটি হজ অথবা ওমরার সওয়াব পাবে।’ (শুআবুল ইমান : ৩৯৬৬)।
শবেকদর : রমজানের শেষ দশকে রয়েছে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বরকতময় কদরের রজনী। এ রাতে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় আমি এটি (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনীতে।’ (সুরা দুখান : ০৩)। এই বরকতময় রজনী কোনটি, তা বর্ণিত হয়েছে অন্য আয়াতে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি এটি (কোরআন) নাজিল করেছি কদরের রজনীতে।’ (সুরা ক্বদর : ০১)
কদর শব্দের অর্থ : কদর শব্দটি সম্মান ও মর্যাদার অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর আরেকটি অর্থ হলো তাকদির ও ফায়সালা করা। এ রাত অত্যধিক সম্মানিত, মহত্বপূর্ণ ও মহিমান্বিত। এ রাতে আল্লাহতায়ালা আগামী এক বছর যা কিছু হবে তা নির্ধারণ করেন এবং প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এজন্যই একে ‘কদরের রাত’ বলা হয়।
শবেকদরের ফজিলত : কোরআন ও হাদিসে এ রাতের অনেক ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- এক. এ রাতে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করেছেন, যা কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক। দুই. এ রাত হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কদরের রাত হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।’ (সুরা কদর : ০৩)। সুতরাং এই রাতের ইবাদতের বিনিময়ে হাজার মাস ইবাদতের প্রতিদান পাওয়া যাবে। তিন. এ রাতে ফেরেশতারা রহমত, বরকত ও কল্যাণ নিয়ে পৃথিবীর বুকে আগমন করেন। (সুরা কদর : ৪-৫)। চার. এ রাতের সম্মানে আল্লাহতায়ালা ‘কদর’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা নাজিল করেছেন, যা কেয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে। পাঁচ. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে নেকির প্রত্যাশায় কদরের রাতে ইবাদত করবে, তার পূর্বের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ (বোখারি : ১৯০১)।
কদরের রাত অন্বেষণ : মহানবী (সা.) কদরের রাতকে সুনির্দিষ্ট করেননি। বরং বলা যায় আল্লাহতায়ালাই তা গোপন রেখেছেন, যেন মানুষ কদরের আশায় শেষ দশকের প্রতি রাতে ইবাদতে লিপ্ত হয়। কোনো কোনো হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, শেষ দশকের যেকোনো রাত শবেকদর হতে পারে। (বোখারি : ২০২০) অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবেকদর অন্বেষণ করতে বলেছেন। (বোখারি : ২০১৭) শেষ দশকের ২৭ তারিখ শবেকদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলেও হাদিস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে ২৭ তারিখই হবে, এমনটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। (মুসলিম : ৭৬২)। আল্লাহতায়ালা আমাদের রমজানের শেষ দশকে অধিক ইবাদত করার তৌফিক দান করুন।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুস সুন্নাহ রাজাবাড়ী, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।