আল্লাহতায়ালা এই উম্মতের প্রতি অসংখ্য অনুগ্রহ ও দয়া করেছেন। তিনি তাদের জন্য দ্বীন পূর্ণ করেছেন, তার সমস্ত নেয়ামত তাদের ওপর পূর্ণভাবে দান করেছেন ও ইসলামকে তাদের জন্য একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম হিসেবে পছন্দ করেছেন। তাই ইসলামের পর সবচেয়ে বড় নেয়ামত হলো এই দ্বীনের ওপর অটল থাকা ও সুন্নাহ অনুসরণ করে জীবনযাপন করা, যাতে মানুষ তার দ্বীনের কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে ও সঠিক পথে থেকে আপন প্রভুর কাছে পৌঁছে যায়। যে ব্যক্তি এভাবে জীবন শেষ করে, মৃত্যুর সময় সে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের সুসংবাদ পায়। আল্লাহর কসম, এটি এক মহামর্যাদাপূর্ণ অবস্থান, যা আল্লাহ তার সেই বান্দাদের দেন, যারা তার প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং সঠিক পথের দিকনির্দেশনা চাইলে তিনি তাদের সে পথ দেখান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে ও আখেরাতে আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন। আর যারা জালিম আল্লাহ তাদেরকে বিভ্রান্তিতে রাখবেন।’ (সুরা ইবরাহীম : ২৭)। মহান আল্লাহ
আরও বলেন, ‘আল্লাহ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন, সে সৎপথপ্রাপ্ত।’ (সুরা কাহফ : ১৭)। বিশ্বনবী (সা.) কে সম্বোধন করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তোমাকে অবিচলিত না রাখলে তুমি এদের দিকে প্রায় কিছুটা ঝুঁকে পড়তে।’ (সুরা বনী-ইসরাঈল : ৭৪)। এক হাদিসে কুদসিতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা সবাই পথভ্রষ্ট, যতক্ষণ না আমি তোমাদের হিদায়াত দিই। তাই তোমরা আমার নিকট হিদায়াত চাও, আমি তোমাদের হিদায়াত দেবো।’
শেষ আমলের ওপর বিচার হয় : বিচার হয় শেষ অবস্থার ওপর, তাই আল্লাহর ভক্ত পরহেজগার বান্দারা ও তার প্রিয় অলিরা সবসময় এই নিয়ে চিন্তিত থাকেন যেন তাদের শেষ পরিণতি খারাপ না হয় বা তারা হিদায়াতের পর পথভ্রষ্ট না হয়ে পড়ে। তারা কখনো নিজেদের আমল নিয়ে আত্মতুষ্ট হয় না, তওবা করলেও আত্মবিশ্বাসে গা ভাসিয়ে দেয় না। তারা আল্লাহর প্রতি আশা রাখেন কিন্তু অলস থাকেন না, আর ভয় পান কিন্তু হতাশ হন না। তারা নিজেদের গোনাহকে তুচ্ছ মনে করেন না, আবার অন্যদের বড় গোনাহের কারণেও কাউকে হতাশ করেন না। ইমাম বোখারি রহ. সহিহ বোখারিতে একটি অধ্যায় রেখেছেন যে, ‘আমলের বিচার হয় শেষ অবস্থার ওপর তাই তা নিয়ে ভয় থাকা উচিত’। এই অধ্যায়ে রয়েছে, হজরত সাহল ইবনু সাদ আস-সাঈদি রা. বলেন, মহানবী (সা.) মুশরিকদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত এক ব্যক্তির দিকে তাকালেন। লোকটি ছিল ধনী ও প্রভাবশালী লোকদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি বললেন, কেউ জাহান্নামি লোক দেখতে চাইলে, সে যেন এই লোকটিকে দেখে। এক লোক তার পেছনে পেছনে যেতে লাগল। সে যুদ্ধ করতে থাকল অবশেষে আহত হয়ে গেল। তখন সে শিগগির মৃত্যু কামনা করে নিজের তরবারির অগ্রভাগ বুকের উপর রেখে সজোরে এমনভাবে চাপ দিল যে, তলোয়ারটি তার বক্ষ ভেদ করে পৃষ্ঠদেশ পার হয়ে গেল। এরপর মহানবী (সা.) বললেন, কোনো লোক এমন কাজ করে যায়, যা দেখে লোকেরা একে জান্নাতি লোকের কাজ বলে মনে করে। কিন্তু (আসলে) সে জাহান্নামবাসীদের অন্তর্ভুক্ত। আর কোনো বান্দা এমন কাজ করে যায়, যা দেখে লোকেরা একে জাহান্নামিদের কাজ বলে মনে করে। অথচ সে জান্নাতি লোকদের অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত শেষ অবস্থার উপরই আমলের ফলাফল নির্ভর করে। (সহিহ বোখারি : ৬৪৯৩)।
কত মহান এই হাদিস! যে মনোযোগ দিয়ে তা বুঝবে, সে এর মাধ্যমে অনেক উপকার পাবে। এতে মহানবী (সা.) স্পষ্ট করে বলেছেন, কেবল ভালো কাজ করাই যথেষ্ট নয়, বরং জীবন শেষ পর্যন্ত সে কাজের ওপর অটল থাকা জরুরি। কারণ জীবন শেষ হয় যেভাবে, সেটিই আসল। হজরত জাবির রা. বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক বান্দাকে সে অবস্থার উপরই পুনরুত্থিত করা হবে, যেভাবে সে মৃত্যুবরণ করেছে।’ (সহিহ মুসলিম)।
অনেক মানুষ আল্লাহর আনুগত্যে জীবন কাটালেও শেষ পরিণতি হয় খারাপ। আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই এমন পরিণতি থেকে। আল্লাহ সুবিচারক, তিনি কারো প্রতি কোনো অন্যায় করেন না; বরং মানুষ নিজেরাই নিজেদের প্রতি অন্যায় করে। কারো ভালো কাজের উদ্দেশ্য থাকে শুধু মানুষের দৃষ্টিতে ভালো হওয়া ও তাদের প্রশংসা পাওয়া। আরেকজন নিজের নেক কাজের বিনিময়ে দুনিয়ার সুবিধা আশা করে, তাই সে ধৈর্য হারায়। কেউ আবার নিজের আমলে গর্বিত হয়ে পড়ে। এভাবে নানা রকম ভুল নিয়ত ও উদ্দেশ্যে মানুষ ভালো কাজ করলেও, শেষটা হতে পারে খারাপ। সত্যিকার হুসনুল খাতিমা ও সুন্দর পরিণতি কেবল তারাই পায়, যারা সুন্দরভাবে কাজ করে। কারণ আল্লাহতায়ালা সবচেয়ে দয়ালু, ক্ষমাশীল ও কৃতজ্ঞতা গ্রহণকারী। তিনি কোনো আন্তরিক, একনিষ্ঠ বান্দাকে নিরাশ করেন না, যদি সে নবীজির অনুসরণ করে, সঠিক পথে স্থির থাকে ও আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্যন্ত সেই দ্বীনের ওপর অটল থাকে।
সঠিক পথে অটল থাকার উপায় : মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সঠিক পথে অবিচল থাকার জন্য কিছু কারণ ও পদ্ধতি আছে, যেগুলো আল্লাহ নিজেই শিখিয়েছেন ও আল্লাহর রাসুল (সা.) দয়াপরবশ হয়ে তার উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। সাহাবিগণ ও পূর্ববর্তী নেককাররা এই পদ্ধতিগুলো মেনে চলেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর উপায় হলো, আল্লাহর কাছে সঠিক পথের দোয়া করা ও সেই পথে অটল-অবিচল থাকার জন্য প্রার্থনা করা। কেননা, একমাত্র সঠিক পথই মানুষকে আল্লাহর কাছে পৌঁছে দিতে পারে। বাকি সব পথ শয়তানের পথ। আর এই দোয়া কোরআনের সুরা ফাতেহার মধ্যে মহান আল্লাহ নিজেই তার বান্দাদের শিখিয়েছেন। সুরাটির শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা করার পরই আমাদের শেখানো হয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনা যে, ‘আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন কর।’ (সুরা ফাতিহা : ৬)। আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজেও দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি তোমার অনুমতিতে আমাকে সেই বিষয়ে হিদায়েত দাও, যাতে সত্য ও ভুলের ভেদ আছে। নিশ্চয়ই তুমি যাকে চাও, তাকে সোজা পথে চালিত করো।’ আরেকটি দোয়ায় তিনি বলতেন,‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে হিদায়াত ও পরহেজগারিতা চাই।’ মহানবী (সা.) হজরত আলী (রা.)- কে এই দোয়া শিখিয়েছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আমাকে সঠিক পথে চালিত কর এবং আমার কথাবার্তা ও কাজকে সঠিক রাখ।’ তিনি আরও বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি, যাতে প্রতিটি কাজে স্থির থাকতে পারি।’ এমনকি আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয়ভাজন ও সচেতন ব্যক্তি হয়েও রাসুল (সা.) দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! তোমাকে ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই, তোমার সম্মানের নামে আশ্রয় চাই, আমি যেন পথভ্রষ্ট না হয়ে যাই।’
রাসুলের সুন্নাহর অনুসরণ : দ্বীনের উপর অটল থাকা ও সঠিক পরিণতির সবচেয়ে বড় উপায় হলো, রাসুল (সা.)-এর অনুসরণ করা ও তার সুন্নাহ আঁকড়ে ধরা। বিপথগামী মন-চাহিদার পেছনে না দৌঁড়ানো। যে ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর অনুসরণ করে, সে তার ডাকে সাড়া দেয়। আর যে ব্যক্তি তার সুন্নাহর আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে নিমজ্জিত হবে বিদয়াতের অন্ধকারে, সরে যাবে সোজা পথ থেকে, নিজের ওপর অন্যায় করবে, আর নিন্দা ও শাস্তির যোগ্য হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এরপর এরা যদি তোমার আহ্বানে সাড়া না দেয়, তা হলে জানবে তারা তো কেবল নিজেদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে। আল্লাহর পথনির্দেশ অগ্রাহ্য করে যে ব্যক্তি নিজ খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে তা অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত আর কে? আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে পথনির্দেশ করেন না।’ (সুরা কাসাস : ৫০)। ইমাম জুনাইদ রহ. বলেছিলেন, ‘সব পথই মানুষের জন্য বন্ধ, শুধু সে পথ ছাড়া, যা রাসুল (সা.)-এর অনুসরণে চলে।’ যে ব্যক্তি মনে করে, মহানবী (সা.)-এর দেখানো পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ তাকে আল্লাহর কাছে নিয়ে যেতে পারে, সে ধোঁকায় পড়ে গেছে, নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে ও মুক্তির বাহন থেকে পড়ে গিয়ে
ধ্বংসে পতিত হয়েছে।
আল্লাহকে স্মরণ করা : দ্বীনের ওপর অটল ও অবিচল থাকার অন্যতম উপায় হলো আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর।’ (সুরা আহযাব : ৪১)। তিনি আরো বলেন, ‘যারা ঈমান আনে ও আল্লাহর স্মরণে যাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়। (সুরা রাদ : ২৮)। অর্থাৎ আল্লাহর বিধান, সিদ্ধান্ত ও পছন্দে মন প্রশান্ত হয়। তখন সন্দেহ-সংশয় ও শয়তানের কুমন্ত্রণা দূর হয়ে যায়। যে বান্দা বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করে, তার অন্তরে হিদায়াতের আলো উদ্ভাসিত হয়, যা তাকে সত্যের ওপর দৃঢ় রাখে ও সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত করে।
কোরআনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা : আল্লাহর ওপর স্থির থাকার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো, আল্লাহর কিতাব কোরআনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখা। তেলাওয়াত করা, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ও তার আলোকে জীবন পরিচালনা করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বল, ‘তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে রুহুল-কুদস জিবরাইল সত্যসহ কোরআন অবতীর্ণ করেছে, যারা মোমিন তাদেরকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে এবং হিদায়াত ও সুসংবাদস্বরূপ মুসলিমদের জন্যে।’ (সুরা নাহল : ১০২)।
গোপনে নেক কাজ করা : সঠিক পথে দৃঢ় থাকার আরও একটি বড় মাধ্যম হলো, গোপনে নেক কাজ করা, যা কেবল আল্লাহই জানেন।
এমন কোনো ভালো কাজ, যা কাউকে না জানিয়ে কেবল আল্লাহর জন্য করা হয়। এই ধরনের কাজ মানুষের অন্তরের সততার প্রমাণ, আর এটাই মানুষকে দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখে।
পরকাল স্মরণে রাখা : আল্লাহর আনুগত্যে দৃঢ় থাকার আরেকটি উপায় হলো,পরকালের কথা স্মরণ রাখা, মৃত্যু স্মরণ করা ও কবর জিয়ারত করা। এগুলো মানুষের দুনিয়ার প্রতি লোভ কমায়, অন্তর নম্র করে ও ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে। পবিত্র কোরআনে বহুবার মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে, যাতে মানুষ ঈমান ধরে রাখে ও আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতি নেয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মৃত্যুর কথা বেশি স্মরণ কর, যা সব রকম ভোগ-বিলাসকে শেষ করে দেয়।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘তোমরা কবর জিয়ারত কর, কারণ এটি পরকালকে স্মরণ করিয়ে দেয়।’।
নেককারদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা : সঠিক পথে অটল থাকার আরেকটি স্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো, নেককার ও আল্লাহভীরু মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা। তারা আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তার আদেশ অনুযায়ী পথ দেখায়, সত্য ও ধৈর্যে একে অপরকে উৎসাহ দেয়। তারা একে অপরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে। কেয়ামতের দিন এই ভালোবাসা কাজে আসবে। সেদিন, মানুষ তার সবচেয়ে কাছের আত্মীয় থেকেও পালাবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বন্ধুরা সেই দিন হয়ে পড়বে একে অপরের শত্রু, মুত্তাকিরা ব্যতীত।’ (সুরা যুখরুফ : ৬৭)। (১৩-১০-১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ১১-০৪-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- আবদুল কাইয়ুম শেখ