ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ে নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী

শরিফ আহমাদ
বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ে নবীজির ভবিষ্যদ্বাণী

বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক। ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এর প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধের দৃষ্টিভঙ্গি রাখা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর আবশ্যক। ঐতিহাসিক এই স্থান নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ইহুদিদের চরম আগ্রাসনের থাবায় আজ তার বাস্তবতা ফুটে উঠছে। বাইতুল মুকাদ্দাস সংক্রান্ত নির্বাচিত ৯টি হাদিস এখানে উল্লেখ করা হলো।

পৃথিবীর প্রাচীন মসজিদ : বাইতুল মুকাদ্দাস পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীন মসজিদ। বাইতুল্লাহ নির্মাণের পরে এই মসজিদের বুনিয়াদ স্থাপিত হয়েছে। আবু জার (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন মসজিদ তৈরি করা হয়েছে? তিনি বললেন, মসজিদে হারাম। আমি বললাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদে আকসা। আমি বললাম, উভয় মসজিদের (তৈরির) মাঝে কত সময় ব্যবধান ছিল? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। (তিনি আরো বললেন) এরপর তোমার যেখানেই নামাজের সময় হবে, সেখানেই নামাজ আদায় করে নিবে। কেননা এর মধ্যে ফজিলত নিহিত রয়েছে।( বোখারি : ৩১২৭)।

মর্যাদাপূর্ণ তৃতীয় মসজিদ : মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে প্রথমে বাইতুল্লাহ এরপরে মসজিদে নববির অবস্থান। এরপরে বাইতুল মুকাদ্দাস। এই তিনটি মসজিদে নামাজ আদায়ের তাকিদ দেয়া হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মসজিদুল হারাম, মসজিদুর রাসুল (সা.) এবং মসজিদুল আকসা (বায়তুল মুকাদ্দাস) তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো মসজিদে (নামাজের) উদ্দেশ্যে হাওদা বাঁধা যাবে না অর্থাৎ সফর করবে না। (বোখারি : ১১১৬)।

বাইতুল মুকাদ্দাসে নামাজ : বাইতুল মুকাদ্দাসে নামাজ আদায় করলে স্বাভাবিক নামাজের তুলনায় অনেক গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। উপরন্তু নামাজ আদায়কারীর গোনাহ মাফ হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সুলায়মান ইবনে দাউদ (আ.) যখন বাইতুল মুকাদ্দাস তৈরির কাজ করেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে তিনটি বিষয়ের প্রার্থনা করেন- সুবিচার, যা আল্লাহর হুকুমের অনুরূপ, এমন রাজত্ব যা তাঁর পরে আর কাউকে দেয়া হবে না, আর যে ব্যক্তি বাইতুল মুকাদ্দাসে কেবল সালাত আদায় করার জন্য আসবে, সে তার গোনাহ থেকে সদ্যপ্রসূত সন্তানের মতো নিষ্পাপ অবস্থায় বেরিয়ে যাবে। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, প্রথম দু’টো তাকে দান করা হয়েছে, আর আমি আশা করি তৃতীয়টি তাকে দান করা হবে। (ইবনে মাজা : ১৪০৮)।

বাইতুল মুকাদ্দাসের খেদমত : বাইতুল মুকাদ্দাসের খেদমত করা সৌভাগ্যের বিষয়। এর প্রতি সবাইকে উৎসাহিত করা হয়েছে। মাইমুনা (রা.) বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! যে ব্যক্তি সরাসরি বাইতুল মাকদিস (মুকাদ্দাস) জিয়ারত করতে সক্ষম না হবে, সে কী করবে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি এখানে আসার সামর্থ্য রাখবে না, সে যেন এখানের বাতি জ্বালানোর জন্য তেল হাদিয়া পাঠায়। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি তেল হাদিয়া পাঠাবে সে ঐ ব্যক্তির মতো সওয়াবের অধিকারী হবে, যে সরাসরি বাইতুল মাকদিস জিয়ারত করেছে। (মুসনাদে আবু ইয়ালা : ৭০৮৮)।

বিজয়ী জামাতের অবস্থান : বাইতুল মুকাদ্দাস এবং আশেপাশের অঞ্চলে সর্বদা এমন একটি জামাত উপস্থিত থাকবে যারা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তারা সাময়িক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কখনো নিশ্চিহ্ন হবে না। আবু উমামা বাহিলী (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সত্যের ওপর অবিচল থাকবে। তারা দুশমনদের ওপর বিজয়ী থাকবে। তাদের সঙ্গ ত্যাগ করে কেউ তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। অবশেষে আল্লাহর নির্দেশ আসবে আর তারা এভাবেই থেকে যাবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, এই দলটির অবস্থান কোথায় হবে? তিনি বললেন, বাইতুল মাকদিস ও তার আশেপাশে। (মুসনাদে আহমদ : ২২৩২০)। এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মুসলমানগণ শত নির্যাতন ভোগের পরেও অবশ্যই আল্লাহর ফজলে বিজয় লাভ করবে।

এক টুকরো মাটির মূল্য : বাইতুল মুকাদ্দাসে বসবাস করতে পারা চরম সৌভাগ্যের বিষয়। এর এক ইঞ্চি মাটির মূল্য সমগ্র পৃথিবীর চেয়ে বেশি। আবু জার (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, অচিরেই এমন সময় আসবে, যখন কোনো ব্যক্তি যদি ঘোড়ার রশি পরিমাণ জায়গাও পেয়ে যায়, যেখান থেকে বাইতুল মাকদিস দেখা যায়, তাহলে এটা তার জন্য সমগ্র দুনিয়া থেকে বেশি উত্তম হবে। (মুসতাদরাকে হাকেম : ৮৫৫৩)। ফিলিস্তিনের মাটি, সেখানে মুসলমানদের অবস্থান করাটা জরুরি। হাদিস থেকে এ কথাই বোঝা যাচ্ছে।

হক বাতিলের লড়াই : পবিত্র এ ভূখণ্ডের মধ্যে যুগে যুগে হক বাতিলের লড়াই চলছে। কেয়ামতের আগে এখানে একটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হবে। যেখানে মুসলমানরা ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে। এই যুদ্ধে পাথর ও গাছ পর্যন্ত মুসলমানদের সহায়তা করবে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কেয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানগণ ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের সাথে লড়াই না করবে। মুসলমানগণ তাদেরকে হত্যা করবে। ফলে তারা পাথর বা বৃক্ষের আড়ালে আত্মগোপন করবে। তখন পাথর বা গাছ বলবে, হে মুসলিম, হে আল্লাহর বান্দা! এই তো ইয়াহুদী আমার পশ্চাতে। এসো, তাকে হত্যা কর। কিন্তু গারকাদ গাছ এ কথা বলবে না। কারণ এ হচ্ছে ইয়াহুদীদের গাছ। (মুসলিম : ৭০৭৫)।

শহিদ হওয়ার তামান্না : পবিত্র এই ভূমিতে মৃত্যু হওয়াটাও সৌভাগ্যের বিষয়। মুসা (আ.)-এর এখানে মৃত্যুর তামান্না পূর্ণ করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মালাকুল মাওতকে মুসা (আ.)-এর কাছে পাঠানো হলো। তিনি তার কাছে এলে, মুসা (আ.) তাকে চপেটাঘাত করলেন। (এতে তার চোখ বেরিয়ে গেল।) তখন মালাকুল মাওত তার প্রতিপালকের দরবারে ফিরে গিয়ে বললেন, আমাকে এমন এক বান্দার কাছে পাঠিয়েছেন যে মরতে চায় না। তখন আল্লাহ তার চোখ ফিরিয়ে দিয়ে হুকুম করলেন, আবার গিয়ে তাকে বল, তিনি একটি ষাঁড়ের পিঠে তার হাত রাখবেন, তখন তার হাত যতটুকু আবৃত করবে, তার সম্পূর্ণ অংশের প্রতিটি পশমের বিনিময়ে তাকে এক বছর করে আয়ু দান করা হবে। মুসা (আ.) এ শুনে বললেন, হে আমার রব! তারপর কী হবে? আল্লাহ বললেন ,তারপর মৃত্যু। মুসা (আ.) বললেন, তা হলে এখনই আমি প্রস্তুত। তখন তিনি একটি পাথর নিক্ষেপ করলে যতদূর যায় বাইতুল মুকাদ্দাসের ততটুকু নিকটবর্তী স্থানে তাকে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে আরজ করলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এখন আমি সেখানে থাকলে অবশ্যই পাথরের পাশে লাল বালুর টিলার নিকটে তার কবর তোমাদের দেখিয়ে দিতাম। (বোখারি : ১২৫৮)। এ হাদিস থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস ও পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।

কেয়ামতের সূচনা স্থান : বাইতুল মুকাদ্দাস কেবল একটি ভবন নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক, আধ্যাত্মিক ও কেয়ামতের বাস্তবতার অংশ। এখান থেকে কেয়ামতের দিন মানুষের পুনরুত্থান ও জমায়েত হওয়া আরম্ভ হবে। মাইমুনা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের বাইতুল মাকদিস সম্পর্কে কিছু বলুন! রাসুল (সা.) বললেন, বাইতুল মাকদিস হলো হাশরের ময়দান। পুনরুত্থানের জায়গা। তোমরা তাতে গিয়ে নামাজ আদায় কর। কেননা তাতে এক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা অন্যান্য মসজিদে ১ হাজার নামাজ আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায়। (মুসনাদে আহমদ : ২৬৩৪৩)।

লেখক : শিক্ষক ও খতিব

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত