আল্লাহতায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন কোনো খেলা বা মজা করার জন্য নয়, তিনি আমাদের অবহেলায় ছেড়ে দেবেন না। তিনি জীবন ও মৃত্যুকে সৃষ্টি করেছেন যেন আমাদের পরীক্ষা করতে পারেন- কে আমাদের মধ্যে ভালো কাজ করে। তিনি আমাদের কাছ থেকে একটি অঙ্গীকারও নিয়েছেন যে, তোমরা তার একত্ব ও মালিকানা স্বীকার করবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্মরণ কর, তোমার প্রতিপালক আদমসন্তানের পৃষ্ঠদেশ হতে তার বংশধরকে বের করেন আর তাদের নিজেদের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন ও বলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’ তারা বলে, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আমরা সাক্ষী থাকলাম।’ এটা এজন্যে যে, তোমরা যেন কেয়ামতের দিন না বল, ‘আমরা তো এ বিষয়ে গাফিল ছিলাম।’ কিংবা তোমরা যেন না বল, ‘আমাদের পূর্বপুরুষগণই তো আমাদের পূর্বে শিরক করেছে, আর আমরা তো তাদের পরবর্তী বংশধর; তবে কি পথভ্রষ্টদের কৃতকর্মের জন্যে তুমি আমাদের ধ্বংস করবে?’ এভাবে নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করি যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।’ (সুরা আরাফ : ১৭২-১৭৪)।
আল্লাহ আরও তোমাদের সঙ্গে অঙ্গীকার করেছেন যে, শুধুমাত্র তারই ইবাদত করবে ও কারো সঙ্গে তাকে শরিক করবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বনী আদম! আমি কি তোমাদের নির্দেশ দিইনি যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব কর না, কারণ সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? আর আমারই ‘ইবাদত কর, এটাই সরল পথ।’ (সুরা ইয়াসিন : ৬০-৬১)। তিনি তোমাদের উৎসাহিত করেছেন ও নির্দেশ দিয়েছেন এই বিষয়ে যে, ‘বল, ‘এসো, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে যা হারাম করেছেন তোমাদের তা পড়ে শুনাই। এটা এই, ‘তোমরা তার কোনো শরিক করবে না, পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে, দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, আমিই তোমাদের ও তাদের রিযিক দিয়ে থাকি। প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে হোক, অশ্লীল কাজের নিকটেও যাবে না। আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তোমরা তাকে হত্যা করবে না।’ তোমাদের তিনি এই নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা অনুধাবন কর।’ (সুরা আনআম : ১৫১)।
আল্লাহতায়ালা মানুষকে একটি মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য সৃষ্টি করেছেন, এক উচ্চতর লক্ষ্য অর্জনের জন্য, আর সেটি হচ্ছে তার একত্ব স্বীকার করা ও তার ইবাদত করা। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি সবচেয়ে বড় নির্দেশ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো তার একত্বে বিশ্বাস রাখা। তিনি এই উদ্দেশ্যেই নবী ও রাসুলদের পাঠিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষকে এজন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।’ (সুরা জারিয়াত : ৫৬)। এই আয়াতের প্রতিপাদ্য হলো, মানুষ ও জিনেরা যেন আল্লাহর একত্ব স্বীকার করে শুধু তারই ইবাদত করে। অন্য কাউকে না ডাকে, কারো ওপর ভরসা না করে, কাউকে ভয় না পায়, তাকে ছাড়া কাউকে সিজদা না করে, শুধু তার নামেই শপথ করে ও তার উপরই নির্ভর করে। আল্লাহর একত্ব ও ইবাদতই হলো মানব অস্তিত্বের আসল উদ্দেশ্য। এটাই মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। এই একত্বের ওপর ভিত্তি করেই আল্লাহ শরিয়ত দিয়েছেন, নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন ও কিতাব নাজিল করেছেন। সব আসমানী ধর্মই এ বিষয়ে একমত। নবী-রাসুলদের একই আহ্বান ছিল ‘আল্লাহর ইবাদত করা ও মিথ্যা উপাস্যদের পরিহার করা।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেবার জন্যে আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। এরপর এদের কতককে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন। আর এদের কতকের ওপর পথভ্রান্তি সাব্যস্ত হয়েছিল।’ (সুরা নাহল : ৩৬)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই অহি ব্যতীত যে, ‘আমি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই; সুতরাং আমারই ইবাদত কর।’ (সুরা আম্বিয়া : ২৫)। সুতরাং, হে আল্লাহর বান্দা, তোমার জীবনের আসল লক্ষ্য হলো আল্লাহর একত্ব স্বীকার করে তার ইবাদত করা। এটাই তোমার সৃষ্টির উদ্দেশ্য। আর এ পথেই শুধুই জান্নাতে পৌঁছানো সম্ভব।
আল্লাহ তার তাওহিদ প্রমাণ করার জন্য স্পষ্ট ও জ্বলন্ত প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন, এমন প্রমাণ যা শরিয়ত, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা সব কিছু দিয়েই টের পাওয়া যায়। এই পুরো মহাবিশ্ব যেন এক খোলা বই, যা সবসময় আল্লাহর পবিত্রতা ও একত্বের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিটি কণা আল্লাহর মহিমা ও গৌরবগাঁথা গাইছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সপ্ত আকাশ, পৃথিবী ও এদের অন্তর্র্বর্তী সমস্ত কিছু তারই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। আর এমন কিছু নেই যা তার সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না; কিন্তু এদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না।’ (সুরা ইসরা : ৪৪)।
তাওহিদই হলো স্পষ্ট সত্য, নিশ্চিত প্রমাণ ও বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চিরন্তন সত্য। আল্লাহ মানুষকে তাওহিদের স্বভাব নিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এটি মানুষের সম্মান ও মর্যাদার ভিত্তি। এই বিশ্বাসেই মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিহিত। তাওহিদের মূল বিষয় হলো- আল্লাহকে তার সমস্ত গুণ, ক্ষমতা ও ইবাদতের অধিকার এই সবকিছুর একচ্ছত্র মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া। বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহ একমাত্র মালিক ও পরিচালনাকারী, তার কোনো শরিক নেই। একমাত্র তিনিই ইবাদতের যোগ্য, তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করা যাবে না। এই তাওহিদের মাধ্যমে একজন মুসলমান মুক্তি পায় মূর্তি বা ভ্রান্ত উপাস্যদের দাসত্ব থেকে, প্রতারক, জাদুকর, জ্যোতিষী বা বিভ্রান্ত নেতাদের অনুসরণ থেকে, শয়তানের দোসরদের ভয় ও আধিপত্য থেকে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পণ্ডিতগণকে ও সংসার-বিরাগীগণকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে ও মারইয়ামণ্ডতনয় মসীহকে। কিন্তু এরা এক ইলাহের ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। তারা যাকে শরিক করে তা হতে তিনি কত পবিত্র!’ (সুরা তাওবা : ৩১)।
এই তাওহিদই একজন মুসলমানকে গোমরাহি ও কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে বের করে আনে আলো ও ইসলামের সঠিক পথে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা ঈমান আনে আল্লাহ তাদের অভিভাবক, তিনি তাদের অন্ধকার হতে বের করে আলোকে নিয়ে যান। আর যারা কুফরি করে তাগুত তাদের অভিভাবক; এরা তাদের আলো হতে অন্ধকারে নিয়ে যায়। এরাই অগ্নি-অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।’ (সুরা বাকারা : ২৫৭)।
আল্লাহর তাওহিদই ইসলাম ধর্মের প্রাণ ও মূলভিত্তি। এটি ইসলাম ধর্মে প্রবেশের প্রথম ধাপ ও মূল চাবিকাঠি। তাওহিদের ঘোষণা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ হলো মুসলমান হওয়ার শর্ত, ইসলামি পরিচয়ের পরিচায়ক এবং বিশ্বাস ও শিরকের মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা। এ কথাই জান্নাতের চাবি। এই তাওহহিদই বান্দাদের জন্য আল্লাহর দরবারে পৌঁছানোর সিঁড়ি। আল্লাহ এই তাওহিদের জন্যই সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি করেছেন, নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন ও আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন।
আল্লাহর একত্ব স্বীকার করা ও শুধু তার ইবাদত করা এমন এক শর্ত, যার উপর সব আমল কবুল হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই অহি হয়েছে, তুমি আল্লাহর শরিক স্থির করলে তোমার কর্ম তো নিষ্ফল হবে। আর অবশ্যই তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সুরা যুমার : ৬৫)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘এটা আল্লাহর হিদায়াত; নিজ বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি এটা দিয়ে সৎপথে পরিচালিত করেন। তারা যদি শিরক করত তবে তাদের কৃতকর্ম নিষ্ফল হতই।’ (সুরা আনআম : ৮৮)।
শয়তান সবসময়ই আদম সন্তানের উপর নজর রাখে, তাদের তাওহিদ থেকে বিচ্যুত করতে চায় ও তাদের বিভ্রান্ত করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ইবলিস বলল, ‘আপনার ক্ষমতার শপথ! আমি এদের সকলকেই পথভ্রষ্ট করব, ‘তবে এদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদের নয়।’ (সুরা সাদ : ৮২-৮৩)। হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে, ‘আমি আমার সব বান্দাকে প্রকৃত ইসলামের উপর সৃষ্টি করেছি। কিন্তু শয়তান এসে তাদের তাদের দ্বীন থেকে সরিয়ে নিয়েছে, তাদের জন্য আমি যা হালাল করেছিলাম তা হারাম করেছে ও তাদের আদেশ দিয়েছে এমন সব জিনিসে আমাকে শরিক করতে, যার জন্য আমি কোনো দলিল নাজিল করিনি।’ (মুসলিম : ৬৭)।
আল্লাহর সঙ্গে শরিক করার ধরন : বড় শিরক, যা ইসলামের গণ্ডি থেকে মানুষকে বের করে দেয়। যেমন: আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে কোরবানি বা মানত করা বা এমন বিষয়ে কারো উপর ভরসা করা, যা একমাত্র আল্লাহই করতে পারেন। এটা সবচেয়ে বড় গোনাহ। হজরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) বলেন, আমি নবী করিম (সা.) কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন গোনাহ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড়? তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য অংশীদার দাড় করানো, অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি বললাম, এতো সত্যিই বড় গোনাহ। আমি বললাম, তারপর কোন গোনাহ? তিনি উত্তর দিলেন, তুমি তোমার সন্তানকে এই ভয়ে হত্যা করবে যে, সে তোমার সঙ্গে আহার করবে। আমি আরয করলাম, এরপর কোনটি? তিনি উত্তর দিলেন, প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে তোমার ব্যভিচার করা।’ (বোখারি : ৪৪৭৭)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সঙ্গে শরিক করা ক্ষমা করেন না। এটা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন; আর যে কেউ আল্লাহর শরিক করে সে এক মহাপাপ করে।’ (সুরা নিসা : ৪৮)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘কেউ আল্লাহর সঙ্গে শরিক করলে আল্লাহ তার জন্যে জান্নাত অবশ্যই নিষিদ্ধ করবেন। আর তার আবাস জাহান্নাম।’ (সুরা মায়েদা : ৭২)।
ছোট শিরক, যা ইসলামের বাইরে বের করে দেয় না; কিন্তু বড় শিরকের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যেমন : আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর নামে কসম করা, কুসংস্কার ও অশুভ ধারণা পোষণ করা, লোক দেখানো ইবাদত করা ও নাম কুড়ানোর জন্য কাজ করা। এগুলো ‘গোপন শিরক’ নামে পরিচিত, কারণ অনেকেই তা বুঝতে পারেন না। যদিও তা মানুষকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয় না; কিন্তু এটা অনেক বড় বিপদের কারণ।
শিরক শুধু মূর্তির উপাসনায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতিটি সেই হৃদয় যেখানে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রতি আসক্তি আছে, প্রতিটি সেই কাজ যা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে করা হয়, প্রতিটি সেই দোয়া যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে করা হয়, প্রতিটি সেই কসম যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর নামে করা হয় ও প্রতিটি কুসংস্কার বা অশুভ ধারণা এগুলোও শিরকের অন্তর্ভুক্ত। হজরত মাহমুদ ইবনে লাবিদ (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর যেটা মনে করি তা হলো ছোট শিরক।’ লোকেরা জিজ্ঞেস করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! ছোট শিরক কী?’ তিনি বললেন, ‘রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদত।’ (মুসনাদ আহমদ)।কোরআন হচ্ছে তাওহিদের গ্রন্থ ও ইসলামি জীবন বিধানের মূল উৎস। এই কোরআনই সেই গ্রন্থ যার মধ্যে রয়েছে, ‘স্পষ্ট প্রমাণ, যুক্তির শক্তি, পরিপূর্ণ পথনির্দেশ, তাওহিদের মর্মবাণী, পুনরুত্থান, নবুয়ত, আল্লাহর গুণাবলির স্পষ্ট বর্ণনা ও বাতিল মতবাদগুলোর জবাব।’ কিন্তু এই কোরআনের উপকার তখনই পাওয়া যাবে, যখন আমরা তা সঠিকভাবে বুঝব ও তার অর্থ জেনে আমল করব।
(২০-১০-১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ১৮-০৪-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- আবদুল কাইয়ুম শেখ)।