ঢাকা শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫, ২৯ ফাল্গুন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রিয়নবীর পিতামহ আবদুল মুত্তালিব

আলী হাসান তৈয়ব
প্রিয়নবীর পিতামহ আবদুল মুত্তালিব

রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পিতামহ আবদুল মুত্তালিব বিন হাশেম। তিনি ছিলেন কোরাইশ গোত্রের অন্যতম প্রধান সর্দার, কাবার রক্ষণাবেক্ষণকারী। ছিলেন উত্তম আখলাকসম্পন্ন ও চুক্তি রক্ষাকারী নেতা। গরিবদের ভালোবাসতেন। হাজীদের খেদমত করতেন। দুর্ভিক্ষে অন্ন দান করতেন। এমনকি পাহাড়ের চূড়ায় জীবজন্তুকেও খাদ্য দান করতেন। বিপুল বদান্যতা ও দানশীলতার দরুন কোরাইশরা তাকে ফাইয়ায বা দানবীর বলে ডাকত।

নবীজির (সা.) দাদা আবদুল মুত্তালিব নিজ গোত্রের নেতৃত্বদানে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি ছিলেন প্রাক-ইসলামি যুগে ফুজ্জার যুদ্ধে বনি হাশেম ও বনি মুত্তালিবের নেতা। তিনিই কোরাইশ ও নাজ্জাশির মধ্যে মৈত্রী চুক্তি করিয়েছিলেন। বংশে তিনি ছিলেন সম্মানীয় ও কবি। ইসলামি যুগ তিনি পাননি।

তার সন্তানদের মধ্যে পুত্ররা হলেন হারেছ বিন আবদুল মুত্তালিব, আবদে মানাফ বিন আবদুল মুত্তালিব, দিদার বিন আবদুল মুত্তালিব, যুবাইর বিন আবদুল মুত্তালিব, আবদুল উজ্জা বিন আবদুল মুত্তালিব ওরফে আবু লাহাব, মুসআব বিন আবদুল মুত্তালিব, মুকাওয়িম বিন আবদুল মুত্তালিব, কাছাম বিন আবদুল মুত্তালিব, আবদুল্লাহ বিন আবদুল মুত্তালিব (নবীজির পিতা), আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিব, হামজা বিন আবদুল মুত্তালিব। আর মেয়েরা হলেনÑ বাইজা উম্মে হাকিম বিনতে আবদুল মুত্তালিব, আতেকা বিনতে আবদুল মুত্তালিব, বাররা বিনতে আবদিল মুত্তালিব, উমাইমা বিনতে আবদুল মুত্তালিব, আরওয়া উম্মে আলে জাইশ বিনতে আবদুল মুত্তালিব, সাফিয়্যা বিনতে আবদুল মুত্তালিব ও জুমানা বিনতে আবদুল মুত্তালিব। এদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছেনÑ হামজা বিন আবদুল মুত্তালিব (রা.), আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিব (রা.), আতেকা উম্মে আবদুল্লাহ বিন আবি উমাইয়া (রা.) ও সাফিয়্যা উম্মে যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.)।

নবীজির (সা.) পিতা আবদুল্লাহ ছিলেন তার পিতা আবদুল মুত্তালিবের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। পিতার হৃদয়ে এই সন্তানের ছিল বিশেষ স্থান। একবার আবদুল মুত্তালিব মানত করলেন, আল্লাহ যদি তাকে ১০টি পুত্র সন্তান দান করেন, তিনি তাদের একজনকে আল্লাহর জন্য কোরবানি দেবেন। আল্লাহ তাকে ১০টি পুত্র দান করলেন। এবার তিনি এদের কাকে কোরবানি দেবেন সে ব্যাপারে লটারি করলেন। লটারিতে কনিষ্ঠতম সন্তান আবদুল্লাহর নাম উঠল। প্রিয়তম এ সন্তান তিনি কোরবানি করতে চাইছিলেন না। আবদুল মুত্তালিব দোয়া করলেন, হে আল্লাহ, তাকে নাকি ১০০ উট? অতঃপর তিনি আবদুল্লাহ ও ১০০ উটের মধ্যে লটারি করলেন। অবশেষে লটারিতে ১০০ উটের নাম উঠল। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা নবীজির (সা.) পিতাকে রক্ষা করেন।

এ ঘটনার সত্যতার ইঙ্গিত পাওয়া যায় নবীজি (সা.) এর বাণী থেকেও। একটি হাদিসে তিনি বলেন, ‘আমি দুই জবাইকৃতের সন্তান।’ এখানে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষ ইসমাঈল (আ.) ও পিতা আবদুল্লাহর কোরবানি হওয়ার দিকে ইংগিত করেছেন। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশে নিজ পুত্র ইসমাঈলকে জবাই করছিলেন। আল্লাহ তার স্থলে দুম্বা কোরবানি করে দেন। ফলে তিনি বেঁচে যান। যে ঘটনা কোরআনে কারিমে সুরা সাফফাতে উল্লেখ হয়েছে। আর আবদুল্লাহর এই জবাই হওয়ার ঘটনা।

আবদুল মুত্তালিব পুত্র আবদুল্লাহর জন্য একজন পুত্রবধূ নির্বাচন করেন। তিনি হলেন আমেনা বিনতে ওহাব বিন আবদে মানাফ বিন যাহরাহ বিন কিলাব। ওই সময় আমেনাই ছিলেন বংশ ও অবস্থানের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ কোরাইশ নারী। তার পিতা ছিলেন বনু যাহরা উপগোত্রের নেতা। পুত্র আবদুল্লাহর সঙ্গে এই নারীকে তিনি বিয়ে দেন। তারপর আবদুল্লাহ মক্কায় দাম্পত্যজীবন শুরু করেন। কয়েক মাস পর আবদুল্লাহ জীবিকার সন্ধানে সফরে বের হন। গ্রীষ্মকালে তিনি শামে যান। সেই যাওয়াই শেষ যাওয়া। আর তিনি ফেরেননি। কাফেলা মক্কায় ফিরে তার অসুস্থতার সংবাদ দিল। এর কিছুদিন পরে তার মৃত্যু সংবাদ আসে। রাসুলুল্লাহ (সা.) জন্মের আগেই পিতা আবদুল্লাহর মৃত্যু হয়।

মা আমেনা নবীজিকে (সা.) জন্ম দেওয়ার পর তাকে দাদা আবদুল মুত্তালিবের কাছে নাতি জন্মের সুসংবাদ জানিয়ে পাঠিয়ে দেন। দাদা খুশিতে আমোদিত হয়ে নাতি কোলে চলে যান কাবা শরিফে। আল্লাহর শুকরিয়া জানান, তার কাছে দোয়া করেন। আদরের নাতির নাম ঠিক করেন মুহাম্মদ। এর আগে আরবরা এ নাম পছন্দ করত না। তারা বলাবলি করল, কেন তিনি বাপ-দাদাদের নাম উপেক্ষা করলেন? আবদুল মুত্তালিব উত্তর দিলেন, আমি চাই আল্লাহ তার প্রশংসা করবেন আসমানে আর জমিনে প্রশংসা করবে মানবজাতি।

মা আমেনা মারা যাওয়ার পর দাদা আবদুল মুত্তালিব নবীজি (সা.) কে অসম্ভব আদর-যতœ দিয়ে লালনপালন করেছেন। এ সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে। যেমন হাসান সনদে বর্ণিত মুসনাদে আবি ইয়ালায় বর্ণিত হয়েছেÑ একদিন আবদুল মুত্তালিব মুহাম্মদকে (সা.) হারানো উট খুঁজতে পাঠান। তার ফিরতে বিলম্ব হলে আবদুল মুত্তালিব একেবারে চিন্তায় পড়ে যান। অবশেষে উটসহ নবীজি (সা.) ফিরে এলে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, প্রিয় নাতিকে আর কখনও কোনো প্রয়োজনে চোখের আড়াল করবেন না। কখনও নিজের থেকে আলাদা করবেন না। আরও বর্ণিত হয়েছে, আবদুল মুত্তালিব নবীজিকে চোখে চোখে রাখতেন। তিনি ঘুমালে কাউকে তার কাছে আসতে দিতেন না। নিজে ঘুমালে অবশ্যই মুহাম্মদকে (সা.) পাশে নিয়ে শুতেন।

বাড়ি থেকে বের হলে নাতিকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। নাতিকে নিয়ে বসলে তিনি সেখানে কাউকে ঘেঁষতে দিতেন না।

আবদুল মুত্তালিবের জীবনের সেরা ঘটনার ইতিহাস হস্তিবাহিনীর সঙ্গে। ইয়ামানের বাদশাহ আবরাহা বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কায় এলো কাবাঘর ধ্বংস করতে। মক্কার উপকণ্ঠে এসে তারা তাঁবু গাড়ল। তার বাহিনীর লোকজন এসে কোরাইশ সর্দার আবদুল মুত্তালিবের উট ছিনতাই করে নিয়ে গেল। আবদুল মুত্তালিব আবরাহার সামনে গিয়ে বললেন, আমরা উটগুলো ফেরত দাও। আবরাহা বলল, নিজের উট নিতে এসেছ, কাবাঘরের নিরাপত্তা চাইবে না? তিনি বললেন, আমি উটের মালিক উট নিতে এসেছি। কাবাঘরের মালিক যিনি ওই ঘর তিনিই রক্ষা করবেন।

কাবাঘরে হামলার উদ্দেশে আবরাহা বাহিনী রওনা করলে আল্লাহ তায়ালা পথিমধ্যে তাদের মাথার ওপর ক্ষুদ্র পাখি দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পাথরকণা নিক্ষেপ করতে লাগলেন। এতে করে ওই পাথর সৈন্যদের মাথার ওপর পড়ে। তারপর মাথা দিয়ে ঢুকে পুরো শরীর ভেদ করে হাতিগুলোকেও ধ্বংস করে দিল। এই ঘটনার দিকেই আল্লাহ ইংগিত করেছেন পবিত্র কোরআনের সুরা ফিলে : ‘আপনি কি দেখেননি আপনার পালনকর্তা হস্তিবাহিনীর সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করেছেন? তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেননি? তিনি তাদের ওপর প্রেরণ করেছেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি, যারা তাদের ওপর কংকর নিক্ষেপ করছিল। অতঃপর তিনি তাদের ভক্ষিত তৃণসদৃশ করে দেন।’ (সুরা ফিল : ১-৬)।

আবদুল মুত্তালিব নাতির ছায়াসঙ্গী ছিলেন। সর্বদা নিজের তত্ত্বাবধানে রাখতেন। যখন নিজের মৃত্যু অত্যাসন্ন মনে করলেন, পুত্র আবু তালেবের হাতে তাকে অর্পণ করেন। ৯৮ বছর বয়সে অনুমানিক ৫৭৮ সালে মক্কায় তার মৃত্যু হয়। মক্কাতেই তার দাফন অনুষ্ঠিত হয়। তখন নবী (সা.) এর বয়স হয়েছিল কেবল আট বছর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত