ঢাকা ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাতিসত্তায় আঘাত ও পরবর্তী পথচলা

সাধন চন্দ্র মজুমদার এমপি
জাতিসত্তায় আঘাত ও পরবর্তী পথচলা

বাঙালির জাতির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করে যে কলংকের ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, যুগে যুগে তা বিশ্বমানবতার বুকে করুণ সুরে বিগলিত থাকবে। ১৫ আগস্ট আমাদের জাতীয় শোক দিবস হলেও এই শোক থেকে আমরা যে শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি সেটা বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতাই প্রমাণ করে। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা বেঁচে যান বিদেশে অবস্থানের কারণে। বেঁচে যান শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকা শিশুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সজীব ওয়াজেদ জয় আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশের কারিগর হিসেবে আলো ছড়াচ্ছেন, অন্যদিকে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম নিয়ে কাজ করে মানবতার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। ছোট বোন রেহানা ও তার পুত্র-কন্যাও বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ সিদ্দিকী ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়ে বাঙালি জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন। এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে পরম সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপাগ্রহে শেখ হাসিনা ও রেহানার বেঁচে যাওয়ার কারণে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ছিল জাতিসত্তার ওপর প্রচণ্ড আঘাত। যে জাতিসত্তা বিকাশের জন্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের পথ বেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হই। এ সক্ষমতার পেছনে যার অবদান অবিস্মরণীয় তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেপথ্যে ভূমিকা পালনকারী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তিনি জীবনের সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পরিত্যাগ করে উজাড় করে দিয়েছেন বাঙালি জাতিকে। দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের পৈশাচিক হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ কথা মনে হলে আজও হৃদয় মন আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠে। স্মৃতিতে অনেক কিছু ভেসে উঠে। উল্লেখ্য, সে সময় আমি নওগাঁতে ছিলাম। বর্তমানে নিয়ামতপুর উপজেলার শিবপুর গ্রামে বসবাস করছিলাম। কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠেই এই দুঃসংবাদটি শুনতে পাই রেডিওতে। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগ তখন ছিল না। নিয়মিত রেডিও শোনার অভ্যাস ছিল আমার। আমাদের বাড়িতে ৩ ব্র্যান্ডের একটি রেডিও ছিল। রেডিওতে কিছুক্ষণ পরপরই অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার মেজর ডালিম অত্যন্ত কর্কশ গলায় দাম্ভিকতার সঙ্গে ঘোষণা করছে বাঙালির প্রিয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা। ১৫ আগস্ট বাংলার মানুষের দিন শুরু হয়েছিল মেজর ডালিমের ঘোষণা শুনে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা ছাড়াও তিনি ঘোষণা করেছিলেন- ‘বাংলাদেশ পুলিশ, বিডিআর ও রক্ষীবাহিনীর সিপাহি ভাইয়েরা, আপনারা সবাই সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিন ও সহযোগিতা করুন। যাহারা অসহযোগিতা করিবেন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের চরম দণ্ড দেয়া হইবে। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।’ খুনি মেজর ডালিমের কথাগুলো সেলের মতো বিঁধেছিল আমার বুকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম। তারপর তিন বাহিনীর প্রধানরা যখন কাপুরুষের মতো অবৈধ মোশতাক সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করে দুটো বাক্যের ভাষণ শুনি, তখন যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল। হত্যার মতো নির্মম বাক্য তারা উচ্চারণ করেছিলেন। দেশের ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বিপন্ন জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে উঠি। বঙ্গবন্ধুর নাম, জয় বাংলা ধ্বনি মুহূর্তের মধ্যে নিষিদ্ধ হয়ে যায় রাষ্ট্রীয়ভাবে। সুদীর্ঘ ২১ বছর আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। আমিসহ অসংখ্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। আমাদের ভেতর বিদ্রোহের আগুন জ¦লে উঠেছিল। কিন্তু নেতৃত্ত্বের নির্দেশনার অভাবে সে দিন বাঙালি জ¦লে উঠতে পারেনি।

একটি জাতি রাষ্ট্রের স্থপতিকে তারই অধীন সেনাবাহিনী হত্যা করতে পারে, তা কল্পনাও করেনি কেউ। স্বাধীনতার এই এত বছর পরও প্রশ্ন জাগে মনে, আসলেই কী কতিপয় বিপথগামী সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করেছে? দিন যত গড়াবে এ প্রশ্ন আরও জোরালো হবে, তাতে সন্দেহ নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে এ যাবৎ বহু লেখালেখি হয়েছে, প্রতি বছরই জাতীয় শোক দিবসকেন্দ্রিক অনেক লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। বর্তমানে গবেষণা চলছে আরও গবেষণা হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বিশ্বাস করি যে, কেবলমাত্র কতিপয় বিপথগামী সেনাবাহিনীই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, এ হত্যার পেছনে ছিল দেশি-বিদেশি সুগভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। সে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত এখনও অব্যাহত আছে। কারণ চক্রান্তকারীদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন হয়নি শেখ হাসিনার কারণে। যে জন্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল আওয়ামী লীগের সমাবেশে। অসংখ্যবার জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, এখনও সে চেষ্টা বহমান রয়েছে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিকূলে। আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে রাষ্ট্রপতি হলেও বেশিদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। বর্ণচোরা আরেক খলনায়ক জেনারেল জিয়া তথাকথিত সিপাহি বিপ্লবের নামে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে দেশ ও জাতির বিকাশমান পথকে চিরস্থায়ীভাবে রুদ্ধ করার পরিকল্পনা করেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ক্ষমতায় এসে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর জেলহত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিয়ে সংসদে ইনডেমিনিটি আইন পাস করিয়েছিলেন। ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা হত্যাকারীদের কেবল দায়মুক্তিই নয়, তাদের তিনি পুরস্কৃতও করেছিলেন বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে।

জিয়ার কর্মকাণ্ডই প্রমাণ করে যে, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে তার হাত ছিল। উচ্চাভিলাষী, ক্ষমতালোভী সেনানায়ক জেনারেল জিয়া বাঙালি জাতিসত্তায় কুঠারাঘাত করে পাকিস্তানি আদলে দেশ শাসন করেছিলেন। তিনি আমাদের পবিত্র সংবিধানের মহৎ আদর্শগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক সমস্ত প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তা নষ্ট করে দিয়েছিলেন। নষ্ট করে দিয়েছিলেন রাজনীতিকে। সুস্থ ধারার রাজনীতির পথকে করে তুলেছিলেন কন্টকাকীর্ণ। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত করেছিলেন।

আঘাতপ্রাপ্ত বাঙালি জাতি সীমাহীন দৈন্যদশায় পতিত হলে আওয়ামী লীগ জনতার সমর্থনে ঘুরে দাঁড়ায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশ যখন হয়ে পড়ে বর্ণহীন, তখন বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনাকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহসের সঙ্গে। বাঙালি পথ খুঁজে পায়। একটি নিন্দনীয় সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়ার মৃত্যু হলেও তারই আদর্শধারীরা ক্ষমতা ভোগ করতে থাকেন। ধূমকেতুর মতো সামনে আসেন আরেক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জিয়ার পথ অণুসরণ করেই এরশাদ সাহেব রাষ্ট্র পরিচালনা করতে থাকেন। রাজনৈতিক নানা ঘটনা প্রবাহের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতি আবার জেগে ওঠে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।

আগস্ট মাস শোকের মাস। আগস্ট ফিরে আসে প্রতি বছর নতুন নতুন বার্তা নিয়ে। স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিষয়বলি, ভেসে ওঠে ২১ আগস্ট ২০০৪-এর গ্রেনেড হামলা কথা। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ও ২১ আগস্ট ২০০৪-এর গ্রেনেড হামলা করে যে হত্যাকাণ্ড ঘটে, এগুলো একই সূত্রে গাঁথা। পরাজিত শত্রুরা এ দেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। তারা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া এ দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা সম্ভব হবে না। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দৃঢ়তায় সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সে জন্য ষড়যন্ত্র থেমে নেই। যে কোনোভাবেই হোক শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে- এমন ভাবনা নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের কর্মপরিকল্পনা অব্যাহত রাখছে। তবে শেখ হাসিনার পাশে রয়েছে কোটি কোটি বাঙালির হাত। এ জাতি সমস্ত ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর দেশে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্য কেউ এগিয়ে আসতে পারেনি। কেবল বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল ছুটে এসেছিলেন। নিজের প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, তিনি বিশ্বস্ত সৈনিক ছিলেন। সেদিন কেউ ছুটে আসেনি কেন, তার রহস্য উদ্ঘাটন করা খুবই জরুরি। কিন্তু এ দেশের সাধারণ মানুষ ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা প্রতিবাদমুখর ছিল। সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার অভাবে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। নেতাকর্মীরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না পরিস্থিতিটা কোন দিকে গড়াচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় ছাত্ররা মিছিল করেছে হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে। সেদিন যদি শক্ত প্রতিবাদ হতো, তবে ইতিহাসও বদলে যেত।

বঙ্গবন্ধুকে সেনাবাহিনী হত্যা করলেও সেনাবাহিনীর জন্য তিনি অনেক কিছু করেছেন। একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীকে আধুনিকায়নের জন্য যতটা সম্ভব তিনি করেছিলেন। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি গঠন করেছিলেন জাতীয় রক্ষীবাহীনী।

রক্ষীবাহিনী গঠন ছিল সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফল। অথচ কতিপয় স্বার্থন্বেষী রক্ষীবাহিনী নিয়ে অপপ্রচার করে সেনাবাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর মধ্যে একটা বিভেদ তৈরি করে রাখবার অপচেষ্টা করছিল। জাতীয় রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর বিকল্প ছিল না, বরং সহযোগী ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্যারামিলিশিয়ার উদাহরণ রয়েছে। রক্ষীবাহিনী মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই গঠন করা হয়েছিল। সময়ের বাস্তবতায় আজ আমাদের সেনাবাহিনী একটি উচ্চাদর্শের বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে কলংকের দাগ লেগেছিল তা থেকে উত্তরণে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিকভাবে গৌরবের বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এগিয়ে যাচ্ছে, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। নেপথ্যের কুশীলবদের উত্তরসূরিরা আজও সক্রিয়, অতএব সাবধান। ৭৫ হত্যাকাণ্ড শহীদদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানাই। অভিবাদন জানাই মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

লেখক : খাদ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত