ঢাকা ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু

মোহাম্মদ আবুল বাশার
ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু

ভূমিকা : সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ তায়ালার। যিনি আমাদেরকে ১৮ হাজার মাখলুকাতের মধ্য হতে একমাত্র শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি আমাদেরকে মুসলিম জাতির অন্তর্ভুক্ত করে এ পৃথিবীতে মর্যাদা সহকারে স্থান দিয়েছেন। সুতরাং, আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ, চিরকৃতজ্ঞ। ইসলাম সকল মানুষের সার্বিক জীবনের পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে যে, যখনই এসেছে, বা আসতে চেয়েছে, তাকেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দুনিয়ায় ও আখিরাতে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তেমনি জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত হয়ে ইসলামের একজন খাদেম হয়ে ইসলাম ও মানবতার জন্য যেসব সেবা প্রদান করেছেন, আমি আমার এ লেখনিতে অতি সংক্ষিপ্ত আকারে এর কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

জন্ম : হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার অন্তর্গত টুঙ্গিপাড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান। তিনি অত্যন্ত সুফি চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মায়ের নাম ছিল সায়েরা খাতুন। তিনিও একজন ধার্মিক মহিলা ছিলেন।

শৈশব কাল : ছোটবেলা থেকে শেখ মুজিব ছিলেন খুব চটপটে, তার ছিল অদম্য প্রাণশক্তি। তিনি ছিলেন দয়ালু ও পরোপকারী একজন বন্ধুসুলভ বালক। বাড়ির সবাই তাকে খোকা নামে ডাকত। খোকা ছিলেন পাড়ার সকলের প্রিয় বন্ধু, দরিদ্র শিশু ও দরিদ্র মানুষের জন্য খোকা ছিলেন এক দয়াবান বালক। দরিদ্র মানুষ ও গরিব শিশু দেখলে তাদের সাহায্য- সহযোগিতা করার জন্য তার প্রাণকেঁদে উঠত। এমন কী গায়ের কাপড়, মাথার ছাতাও তিনি দান করে দিতেন, এরই নাম মানবতাবাদী খোকা।

ছাত্রজীবন : বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক ঘেঁষে একটা সরু খাল চলে গেছে, যে খাল বাইগার নদী ও মধুমতী নদীর সংযোগ রক্ষা করে। এই খালের পরই ছিল বড় কাচারি ঘর, আর এই কাচারি ঘরের পাশে বঙ্গবন্ধুর পড়ার ঘর। এখানে তাকে মাস্টার, পন্ডিত ও মৌলভী সাহেব পড়াতেন। মৌলভী সাহেব বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে জাইগির থাকতেন এবং তাকে পবিত্র কোরআন, নামাজ, রোজা ও আরবিসহ বিভিন্ন মাসআলা, ইমান, আকিদার শিক্ষা দিতেন। এজনই তিনি ধার্মিক ও শিশুকাল হতে ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত একজন মানুষ। ধর্মপ্রাণ মুসলিম জননেতা। তার কথায় কাজে সর্বদা আল্লাহর নাম বা ইনশাআল্লাহ থাকত। ৭ বছর বয়সে তিনি গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে পিতার কর্মস্থল গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ১৯৮২ সালে ভর্তি হন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর এখানে তিনি বিভিন্ন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ করেন এবং ন্যায্য দাবি আদায়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন।

রাজনৈতিক জীবন : ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে যুক্ত হন। ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি বহুবার কারাবরণ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উর্দুভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রসমাজ বিক্ষোভ করলে তিনি গ্রেপ্তার হয়। ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন করার জন্য শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তাকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। তখন কারাপক্ষ তাকে মুক্তি দেন। আওয়ামী লীগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল অসামান্য। এটা শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে। তাই ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে আবারও তাকে গ্রেপ্তার করে। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় অনশন পালন করেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ঘটলে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হন। ১৯৫৬ সালে আবার তিনি মন্ত্রী হন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৯৬৮ সালে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়। সেখান থেকেও তিনি মুক্তি লাভ করেন এবং ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষে তোফায়েল আহম্মেদ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাদিতে ভূষিত করেন।

মাতৃভাষা : ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত বঙ্গবন্ধুর মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা : মহানসৃষ্টি কর্তা আল্লাহ বিশ্বজগৎ এবং যাবতীয় জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন, তার এ বিশাল সৃষ্টির পেছনে সূক্ষ্ম পরিকল্পনা, নিখুঁত বৈজ্ঞানিক কৌশল ও গভীর তাৎপর্য রয়েছে। ফলে বিশ্বের সবকিছু যথানিয়মে পরিচালিত হচ্ছে। এ বিশ্বে অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে মানুষ অন্যতম, আশরাফুল মাখলুকাত। জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি ও বিবেচনায়, মানুষ শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টির মর্যাদা লাভ করেছে। মানুষ হযরত আদম (আ.) এর বংশধর বা সন্তান। আল্লাহ আদমকে শিক্ষা দিয়েছেন, আর জ্ঞান শিক্ষার মাধ্যম হলো ভাষা, অর্থাৎ আল্লাহ আদম (আ.)কে ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে ছিলেন। যুগে যুগে নবী-রাসুলগণের ওপর আল্লাহর বাণী যথা আসমানি কিতাব বা হেদায়েত এসেছে। সেই সব কিতাব নবী-রাসুলগণের ওপর নাজিল হয়েছে তাদের কাওমের মানুষের নিজ ভাষায়। একেক জাতীর ভাষা ছিল ভিন্ন ভিন্ন আসমানি কিতাব ও নাজিল হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায়। যেমনি করে হযরত মুসা, দাউদ, ঈসা, ইব্রাহীম এসব নবীদের ভাষা অনুযায়ী তিবরাণী, সুরিয়ানি, হিব্রু ও আরবি ভাষায় তাওরাত যাবুর, ইনজিল ও সহিফাসমূহ অবতীর্ণ হয়। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর আল-কোরআন নাজিল হয়েছিল আরবি ভাষায়। কারণ ছিল, নবী (সা.) ছিলেন আরবি, তার কাওমও ছিল আরবি ভাষার। সুতরাং, পবিত্র আল-কোরআন ও আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে রাসুল-আমি আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল করেছি। যাতে তুমি সহজে অনুধাবন করতে পার।’

উপরের আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মাতৃভাষার প্রতি আল্লাহ গুরুত্বারোপ করেছেন। মহানবী (সা.) ও মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন এবং মাতৃভাষা শিক্ষার জন্য জোর তাগিদ দিয়েছেন। মাতৃভাষা আল্লাহর দান, এটা মায়ের ভাষা, মানুষের মুখের ভাষা। এক জাতির ভাষা কখনো অন্য জাতির ভাষা হতে পারে না, হতে দেয়া যায় না। যেহেতু মাতৃভাষা আল্লাহর দান, সেহেতু এ ভাষা অন্য কাউকে কেড়ে নিতে দেয়া যায় না। মাতৃভাষার জন্য, মাতৃভূমির জন্য জিহাদ করা একান্ত কর্তব্য। যারা প্রাণ দেবেন তারা শহিদ, আর যারা বেঁচে থাকবেন তারা গাজী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত হয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা বুঝে, মাতৃভাষাকে সম্মান দিতে গিয়ে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য সেদিন যখন ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তখন বঙ্গবন্ধু তার প্রতিবাদে বলেছিলেন- ‘ঘড়, ঘড়’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ মার্চ পুনরায় ঘোষণা দিলে, সমস্তছাত্র সমাজকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভাষা হরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে আটক করে জেলে পাঠানো হয়। কারাবরণ করেন বঙ্গবন্ধু মাতৃভাষার জন্য। এরপর ১৯৫২ সালে খাজা নাজিম উদ্দীন জিন্নাহর অনুকরণে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ জানায় ৪ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ এবং ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী ধর্মঘট পালন করা হয়। পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলে, ছাত্রজনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করলে পুলিশ অনেককে আটক করে পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে অগ্রসর হলেই মিছিলের ওপর পুলিশ প্রথমে কাঁদনে গ্যাস, লাঠিচার্জ করে ও পরে গুলি চালায়। বুকের তাজা রক্ত দেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকরা; মাতৃভাষার সৈনিক সালাম, রফিক, শফিউর, বরকত ও জব্বাররা। আমরা তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করি।

মাতৃভূমি : ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত বঙ্গবন্ধুর মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ও দেশপ্রেম জাগ্রত হয়েছে। মহান আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে আত্মসম্মান বোধ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা একটি মানবীয় গুণাবলির অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃত পক্ষে দেশপ্রেমের উদ্ভব আত্মসম্মান বোধ থেকে, যে জাতির আত্মসম্মান বোধ যত প্রখর, সে জাতির স্বদেশ প্রেম তত প্রবল।

স্বদেশ প্রেম এক প্রকার পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ। ইসলাম নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমকেই প্রকৃত দেশপ্রেম বলে আখ্যায়িত করেছে। ‘দেশপ্রেম ঈমানেরই অঙ্গ। যার ঈমান যত মজবুত সে তত বেশি দেশ প্রেমিক।’ জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু ঈমানের বলে বলিয়ান হয়ে ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত হয়ে আপন মাতৃভূমিকে ভালোবেসেছেন। দেশকে ভালোবাসা মানে দেশের মানুষ ও সম্পদকে ভালোবাসা, দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা। দেশরক্ষার জন্য শত্রুর মোকাবিলা করা, যুদ্ধ করা জেহাদ করা, শিমানা পাহারা দেয়া ফরজ। বঙ্গবন্ধু এ কাজগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করেছেন এবং দেশ থেকে শত্রু বিতাড়িত করার জন্য সক্রিয় আন্দোলন করেছেন। দেশ লুটকারি হানাদার বাহিনী ও পাকিস্তান সরকারকে এদেশ থেকে তাড়াতে দেশের মানুষকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে রক্ষা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় জেল, জুলুম ও কারাবরণ করেছেন। তিনি এসব করেছেন আত্মসম্মান বোধ থেকে, ঈমানের দায়িত্ব বোধ থেকে, তিনি অবশ্যই একজন শহীদের মর্যাদা লাভ করে জান্নাতি হবেন। আমি তার এবং তার পরিবারের সকলের জন্য; মৃত ব্যক্তিদের জান্নাত ও জীবিত ব্যক্তিদের হায়াতে তাইয়্যেবা কামনা করি।

ইসলামের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা : বিশ্বের সকল অঞ্চলে, সকল মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা সহজাত ধর্ম; স্বাধীনতার জন্য আকাঙ্ক্ষা, উদ্বেগ এবং আকুতি স্বতঃস্ফূর্ত। এ কারণে মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই স্বাধীন প্রিয়। পরাধীনতাকে মানুষ মুহূর্তের জন্যও বরদাস্ত করতে রাজি নয়। তাই তার প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হলেই সে সর্বস্ব দিয়ে রুখে দাঁড়ায়। যেকোনো মূল্যে সেই স্বাধীনতা ছাড়া মানবজীবন কল্পনা করা যায় না। এক কথায় মানুষ শত বছর গোলামির গ্লানিময় জীবনের চাইতে একদিনের স্বাধীন জীবনকে বেশি মূল্য দেয়। ‘স্বাধীনতা হীনতায় বাঁচতে চায় হে, কে বাঁচতে চায়’ কবির এ উপলব্ধি মানবাত্মারই আদি উচ্চারণের প্রতিধ্বনি। মানুষ জন্মগত এবং প্রকৃতিগতভাবে স্বাধীনতা প্রয়াসী। এজন্য ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতির স্বাধীনতার জন্য মানুষ নিজেদের জীবন কোরবানি দিতেও কুণ্ঠিত নয়। মানুষের মুক্তির ধর্ম ইসলামে স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতার গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতা মানুষের স্বভাবের দাবি, স্ব-উপলব্ধিতে তা দেদীপ্যমান। সব সমাজব্যবস্থায় স্বাধীনতার জয়গান গাওয়া হয়েছে। স্বাধীনতা বিষয়টি মানব স্বভাবের সাথে এমনভাবে জড়িত এবং মানুষের মানবতাবোধ ও উপলব্ধির সাথে এমনভাবে সংশ্লিষ্ট যে, কোনো সময় তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মুখাপেক্ষী হয় না। স্বাধীনতা শব্দের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এর প্রকৃত অর্থ। নীল আকাশে মুক্ত বিহঙ্গ উড়ে যাওয়া, হৃদয়ের গভীরে আনন্দের ছোঁয়া, স্বদেশের ভূমিতে নিজেদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল বিষয়ে স্বচিন্তায় কর্ম করার নামই মুক্ত জীবনযাপন। মোট কথা; ব্যক্তি জীবন থেকে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন বাঁধামুক্ত থাকা। স্বাধীনতার অর্থ মুক্ত জীবন হলেও স্বাধীনতা তখন সঠিক বলে বিবেচিত হয়, তখনই তা হয়ে উঠে সামগ্রিক। স্বাধীনতা শব্দের সাথে আত্মবিশ্বাস কথাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্বাধীনতার অর্থ একদিকে শৃঙ্খল মুক্তি, অন্যদিকে পরনির্ভরশীলতা থেকেও মুক্ত হওয়া। সুতরাং, যার নিজের প্রতি বিশ্বাস নেই, আস্থা নেই, সে কখনো একটি জাতির বিকাশের জন্য দায়িত্ব পালন করে আত্মবিশ্বাস ও স্বনির্ভরতা চেতনায় অবিচল থাকতে পারে না....। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী এই সীমারেখা অতিক্রম করে যতবার অবিচার ও জোরজবরদস্তির আশ্রয় নিয়েছিল, ততবারই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়েছে। প্রতিবাদের এ প্রাচীর দাঁড় করিয়েছে স্বাভাবিক (ফিতরাত) ও ভারসাম্য বিনষ্টকারী শাসকচক্রের বিরুদ্ধে। বলা বাহুল্য এই যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তোলা, এটাই চিল এ দেশবাসীর স্বাভাবিক মানবিক অধিকার। মহান আল্লাহ বলেন- ‘আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না’। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী অন্যায়ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রাণপ্রিয় ভাষা মাতৃভাষা কেড়ে নিয়ে উর্দুভাষা জোরপূর্বক চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। শুধু তাই নয়, এদেশের জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, শোষণ করেছে বাংলার অর্থ সম্পদ। এদেশের অর্থ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে সমৃদ্ধ করেছে। জুলুম, অত্যাচার নিপীড়ন দিনের পর দিন বেড়েই চলছিল। এহেন পরাধীনতার শিকল থেকে বাঙালি জাতিকে রক্ষা করার জন্য এবং আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হয়ে ইসলামের আলোকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীকে নিয়ে পরা শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যান।

তিনি বিভিন্ন দাবি ও দফার মাধ্যমে স্বদেশি আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। সর্বশেষ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বাঙালি জাতীকে স্বাধীনতা ও দেশ শত্রুমুক্ত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ঘোষণায় তিনি বলে, তোমাদের কাছে যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। আমরা তাদের ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিবো তবুও এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।

বঙ্গবন্ধুর মহান আল্লাহর উপর এ বিশ্বাস থাকার কারণে মহান মুক্তিযুদ্ধের সৈন্যরা অল্পসংখ্যক হয়েও বিশাল শত্রু বাহিনীর ওপর মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ করে বিজয় লাভ করে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে হাজার মা-বোনের সম্ভ্রমের বদৌলতে আমরা পেয়েছি একটি লাল-সবুজের পতাকা, আমাদের তারা উপহার দিয়েছেন স্বাধীন নামক স্বর্ণপদক এবং স্বাধীন বাংলাদেশ। ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতার মর্মবাণী উপলব্ধি করে তার সারা জীবনের শ্রমের বিনিময়ে চেষ্টা ও সাধনার বিনিময়ে আমাদের যে স্বাধীন দেশটি উপহার দিয়েছেন আমরা জীবনের বিনিময়ে হলেও এদেশের মর্যাদা ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখব ইনশাআল্লাহ। ইসলাম প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদান : স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। ইতোপূর্বে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেশ কিছু দেশি-বিদেশি লেখক, সাংবাদিক তার রাজনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলো নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু একজন খাঁটি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তার ধর্মীয় জীবন ও ইসলাম ধর্মের প্রতি তার অনুরাগ এবং ইসলাম প্রচারে আজ অবধি তেমন কোনো লেখা হয়নি, যার ফলে আমরা বঙ্গবন্ধুর ধর্মীয় চেতনাবোধ ইসলাম প্রচার ও প্রসারে তার অবদান সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। আমি ইসলামে তার অসামান্য অবদানের কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। ধর্মীয় জীবনে তিনি একজন খাঁটি মুসলিম পরিবারের সন্তান। তিনি সর্বদা আল্লাহকে স্মরণে রাখতেন। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়, কোরআন তিলাওয়াত ও সাওম পালন করতেন। জাকাত ও দান-খয়রাতে তিনি অনন্য। গ্রামের কোনো লোক তার কাছে এলে তিনি কাউকে খালি হাতে ফেরাতেন না। রমজান মাসে তিনি দেশের আলেম-ওলামাদের দাওয়াত করে খাওয়াতেন, অধিকাংশ সময়ই তিনি ইসলামি পোশাক পরতেন এবং মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতেন। সামাজিক জীবনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন সমাজসেবক, গরিব, দরদি এবং দানশীল মানুষ। সকলের সাথে মিলেমিশে সবার বন্ধু হয়ে থাকার চেষ্টা করতেন। একজন মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের কষ্ট তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারতেন এবং কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করতেন- এটাই ছিল তার ধর্ম। ইসলাম প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসেই ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে এক নির্দেশে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। এতে প্রমাণিত হয় যে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আল্লাহর শক্তিতে বলীয়ান, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা ও অন-ইসলামিক কার্যকলাপ বন্ধ করে সঠিক ইসলাম প্রচার করার জন্য তিনি ঈমানি চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধিবাসীদের চাহিদা মোতাবেক সারা দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠিত এর শাখা অফিসসমূহের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠান সেবা দিয়ে আসছে। ১৯৭৩ সালে রবিউল আউয়াল মাসে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিল জাতীয় পর্যায়ে উদযাপন করা হয়। এ মাহফিলে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক প্রধান মেহমান হিসেবে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানমালার শুভ উদ্বোধন করেন। বায়তুল মোকাররম মসজিদের সৌন্দর্য বর্ধন ও এর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়! এছাড়া দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি ও চিন্তা-চেতনার অবাধ বিকাশের অনুকূল সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সদ্যস্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের অব মূল্যায়ন নিরসনকল্পে বায়তুল মোকাররম সোসাইটি ও ইসলামিক একাডেমীকে একীভূত করে বৃহত্তর পরিসরে জাতীয় পর্যায়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, যার কর্মকাণ্ড এখন সারাদেশের জেলায় জেলায় বিদ্যমান।

ইসলামী ফাউন্ডেশনের কর্মসূচিগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করা হলো

১। ইসলামিক মিশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা : ইসলামের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে সেবাভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনা যেমন- বিনামূল্যে চিকিৎসা, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র জনগণকে হালাল রিজিক উপার্জনের জন্য সহায়তা দান ইত্যাদি।

২। মক্তব শিক্ষক প্রশিক্ষণ : মুবাল্লিগ প্রশিক্ষণ, এর মাধ্য সর্বসাধারণের মধ্যে পবিত্র কোরআনের বিশুদ্ধ পাঠ শিক্ষা, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা পরিচালনা ইত্যাদি।

৩। ইসলামিক ফাউন্ডেশন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা : এখানে সব ধরনের ইসলামি বই ও কোরআন হাদিস পাওয়া যায়।

৪। জাকাত বোর্ড গঠন : মুসলিম দুস্থ মানবতার সেবায় এ প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত।

৫। ইসলামী প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠায় এর কার্যক্রম ব্যাপক।

৬। মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন।

৮। মসজিদভিত্তিক ইসলামী পাঠাগার স্থাপন।

৯। ক্যাসেট তৈরি কর্মসূচি গ্রহণ। এর মাধ্যমে কোরআন তেলাওয়াত ও ইসলামিক ওয়াজ, তাফসির ইত্যাদি মাধ্যমে সম্প্রচার করা।

১০। ফাউন্ডেশন পুরস্কার।

১১। গবেষণা বিভাগ প্রতিষ্ঠা, কোরআন ও হাদিসের অনুবাদ তাফসির ও গবেষণা পরিচালনা।

১২। অনুবাদ ও সংকলন বিভাগ প্রতিষ্ঠা।

১৩। ইসলামী বিশ্বকোষ সংকলন ও প্রকাশ এবং বিতরণ করা।

১৪। ইসলামী প্রকাশনা বিভাগ প্রতিষ্ঠা।

বঙ্গবন্ধুর ইসলামের আলোকে উজ্জীবিত হয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড পুনর্গঠন করেন। ইতিমধ্যে আমরা আলোচনা করেছি, ব্যক্তি জীবনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন খাঁটি ইমানদার মুসলিম। তিনি বাংলাদেশে ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পদক্ষেপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড গঠন। এর ফলে গোটা দেশের ছাত্রসমাজ অদ্যবধি ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ইসলামী আকিদাভিত্তিক জীবনযাপন করতে পারছে এবং মেধাবী আলেমগণ শিক্ষকতা ও ইসলাম প্রচার করছেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর এহেন মহান কাজের জন্য দোয়া প্রার্থনা করি।

ইসলাম প্রচারে তাবলিগ : বঙ্গবন্ধু ইসলামের শান্তিধারাকে সারা বিশ্বে পৌঁছে দেয়ার জন্য বাংলাদেশে তাবলিগ জামায়াতের বিশ্ব ইজতেমার সুব্যবস্থাপনা জন্য টঙ্গিতে বিশাল আকারের মাঠসহ জমি বরাদ্দ দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। হজের পর সারা বিশ্বের মুসলমানদের বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু স্বয়ং হেলিকপ্টার যোগে সেই টঙ্গী ইজতেমার ব্যবস্থাপনা ও সমাবেশ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকেও ইজতেমার মুনাজাতে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি।

বঙ্গবন্ধুর আরো অনেক ইসলামি কর্মকাণ্ড রয়েছে সবগুলো লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি বেতার ও টেলিভিশনে কোরআন তিলাওয়াত ও প্রচারের ব্যবস্থা করে গেছেন। বাংলাদেশকে তিনি ওআইসি’র অন্তর্ভুক্ত করেন এবং তিনি ১৯৭৪ সালে ওআইসি’র সম্মেলনে যোগদান করেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু দেশ থেকে অন্যায়, অত্যাচার ব্যভিচার, মদ ও জুয়া নিষিদ্ধ করেন। ফলে দেশের মানুষ শান্তিতে অবাদে ধর্মকর্ম করে ভালোভাবে বেঁচে থাকাতে পারছেন। সর্বশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যুগান্তকারী অবদানের কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে চির দিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমিন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাটিজ বিভাগ, হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত