বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণা বঙ্গমাতা
মোতাহার হোসেন
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯৪তম জন্মদিন ৮ আগস্ট। জন্মদিনে তার অমর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। জন্মদিন আনন্দের হলেও আগস্ট বাঙালির জন্য শোকের মাস হওয়ায় সেই আনন্দ ম্লান হয়ে যায় শোকের আবহে। তবুও এই মাসে বঙ্গমাতার জন্মদিনে আনন্দের পরিবর্তে শোককে শক্তিতে পরিণত করার শপথ নেয়ার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে সঠিক দিকনির্দেশনা এবং পরিবার ও আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে অন্যতম কাণ্ডারী হিসেবে সবসময় আলো ছড়ানো বঙ্গমাতার অনন্য সাধারণ ভূমিকা, আদর্শ, ত্যাগকে যথার্থভাবে স্মরণ ও অনুকরণের প্রত্যাশা করছি। ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯৪তম জন্মদিন ৮ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে নিষ্ঠুর, বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে তিনি শাহাদতবরণ করেন। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৪৫ বছর।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতালিপ্সু একদল নরপিশাচ কর্তৃক ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ সপরিবারে শহিদ হন। পার্শ্ববর্তী সোবহানবাগ মসজিদ থেকে যখন ফজরের নামাজের আজান হচ্ছে ঠিক তখনই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঘটে এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ ছিলেন পরিবারের অপরাপর সদ্যরা।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বঙ্গমাতার ব্যাপারে যথার্থ বলেই প্রতিয়মান। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার ভাষায় ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। কবিতাটি যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। এ কথা সত্য যে, প্রত্যেক সার্থক পুরুষের নেপথ্যে থাকেন একজন নারী। কথায় বলে ‘প্রত্যেক সফল পুরুষের সফলতার পেছনে একজন নারীর হাত রয়েছে’। আর এই ধারণাকে আরো একধাপ উপরে নিয়েছে একটি গবেষণা। যেখানে দেখা গেছে শুধু নারীর হাত নয়- সফল হওয়ার পেছনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহযোগিতামূলক মনোভাব। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসালভেনিয়ার দ্য কার্নেইগিমেলন ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানীদের দাবির ওপর ভিত্তি করে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সম্পর্কবিষয়ক একটি ওয়েবসাইট। সঙ্গী সহযোগী হলে মানুষ ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পায়। আর ঝুঁকি নেওয়ার সৎ সাহসই মানুষের জীবনে বয়ে আনে সফলতা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, মানসিক শান্তি এবং সুসম্পর্ক। ঠিক অনুরূপ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফলতার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ওরফে রেনু। শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব সংগ্রামী সেই মহীয়সী নারী, যিনি নিজেকে নেপথ্যে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার অভীষ্টের দিকে এগিয়ে যেতে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন।
বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব বাল্যকাল থেকে যে মানুষটিকে জীবনসঙ্গী করে আমৃত্যু সাহচর্যের পণ করেছিলেন তিনি বিদায়ও নিলেন তার সঙ্গে। আমৃত্যু মানবিক ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ডাকনাম ছিল রেনু। সারা জীবন চলেছেন সাধাসিধেভাবে, একজন বাঙালি গৃহবধূ। নিজের চেয়ে পরিবারের কথা, দলের কথা, দলের নেতাকর্মীদের কথা ভেবেছেন বেশি। বঙ্গবন্ধুর জীবনসঙ্গী হিসেবে সংগঠনের কথাও ভাবতে হয়েছে তাকে। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে স্বজনদের সঙ্গে বেড়ে ওঠেন তিনি। মাত্র ৩ বছর বয়সে বাবা শেখ জহুরুল হক ও ৫ বছর বয়সে মা হোসনে আরা বেগম পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ার সময় দাদা শেখ কাসেম চাচাতো ভাই শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ফজিলাতুন নেছার বিয়ে দেন। বিয়ের পর সামাজিক রীতিনীতির কারণে স্কুলের বদলে গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই গৃহিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব পরিবারের সদস্যদের প্রতি সব সময় দায়িত্বশীল ছিলেন। জীবদ্দশায় স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নানা পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে লড়াই-সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়েছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ তৎকালীন সব সংগ্রামে তিনি গণমানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সব কষ্ট সহ্য করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামময় জীবনে তিনি যেমন পরিবারের হাল ধরেছিলেন পরম মমতায়, তেমনি সাংগঠনিক দায়িত্বও পালন করেছেন যথেষ্ট সাহসিকতা, বিচক্ষণতা, দক্ষতার সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মহীয়সী নারী ফজিলাতুন নেছা মুজিব দিকনির্দেশনা দিয়ে দলীয় নেতাকর্মী ও অনুসারীদের সাহস জোগাতেন, অর্থ সহায়তা দিতেন। রাজনৈতিক জীবনে সময়ে সময়ে প্রায় ১১ বছরেরও বেশি সময় বঙ্গবন্ধু কারাজীবন কাটিয়েছেন। এই দীর্ঘ সময়ে কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ও নির্দেশনা নেতাকর্মীদের জানাতেন বঙ্গমাতা।
১৫ আগস্ট বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে হত্যাকারীদের এই জঘন্য কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিপুল বিক্রমে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গবন্ধুর সব সাহসী পদযাত্রায় বেগম মুজিব ছিলেন সক্রিয় সহযাত্রী। আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধু কারারুদ্ধ হওয়ার পর তার প্যারোলে মুক্তির জন্য সক্রিয় প্রস্তাবটি সফল হতে পারেনি বঙ্গমাতার জন্য। বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির চূড়ান্ত মাহেন্দ্রক্ষণে বঙ্গমাতাই তার জীবনসঙ্গী বঙ্গবন্ধুকে সঠিক পথ বাতলে দিয়েছিলেন। বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গে তার কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে অনেকে অনেক রকম পরামর্শ দিয়ছেন বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু আমার মা তাকে বলেছিলেন, তোমার যা মনে আসে তাই বলো।’ বঙ্গবন্ধুর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত ১৯ মিনিটের সে ভাষণটি শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনানুষ্ঠানিক ঘোষণাই ছিল না, পৃথিবীর ইতিহাসের একটি বহুল প্রচারিত ও সেরা ভাষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। বঙ্গমাতার জন্মদিনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাব উদ্দিন তার বাণীতে বলেছেন, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বাঙালির অহংকার, নারী সমাজের প্রেরণার উৎস। তিনি কেবল জাতির পিতার সহধর্মিণীই ছিলেন না, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামেও তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রদূত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন যোগ্য ও বিশ্বস্ত সহচর এবং বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সহযোদ্ধা। তিনি অসাধারণ বুদ্ধি, সাহস, মনোবল, সর্বাংসহা ও দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন এবং আমৃত্যু দেশ ও জাতি গঠনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।
বঙ্গবন্ধুর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে ছায়ার মতো অনুসরণ করে তার প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অফুরান প্রেরণার উৎস হয়েছিলেন বেগম মুজিব। বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ ছয় দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু যখন বারবার পাকিস্তানি শাসকদের হাতে বন্দি ছিলেন, তখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বঙ্গমাতার কাছে ছুটে আসতেন, তিনি তাদের বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিকনির্দেশনা বুঝিয়ে দিতেন এবং লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগাতেন। আগরতলা যড়যন্ত্র মামলায় প্যারোলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি নিয়ে একটি কুচক্রী মহল বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল, তখন প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে বেগম মুজিবের দৃঢ়চেতা অবস্থান। তখন কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে পল্টনের মিটিংয়ে জনতার সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে বঙ্গমাতা বলেছিলেন, ‘মানুষ তোমার সম্পূর্ণ মুক্তি চায়। তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে, তোমাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার জন্য। তুমি কোনো দিন প্যারোলে রাজি হবে না। বাংলার মানুষ তোমার প্যারোলে মুক্তি চায় না। বাংলার মানুষ তোমাকে ছাড়া গোলটেবিল বৈঠক চায় না। তোমার সম্পূর্ণভাবে মুক্তি না হলে প্যারোলে মুক্তির কোনো চেষ্টা যেন না হয়।’ বঙ্গবন্ধু তাই করেছিলেন। বাস্তবিক অর্থেই বঙ্গমাতা ছিলেন ত্যাগ ও সুন্দরের সাহসী প্রতীক’। আমৃত্যু নেপথ্যে থেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পরম মমতায় বঙ্গবন্ধুকে আগলে রেখেছিলেন এই মহীয়সী নারী। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলোতে জাতির জনককে বাস্তবোচিত ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত দিয়ে তিনি বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ায় ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বঙ্গমাতার দেখা হতো, বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে প্রাপ্ত দিকনির্দেশনা কর্মীদের মাঝে পেঁৗঁছে দিতেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি ছাত্রলীগও পরিচালনা করেছেন। তিনি বেঁচে থাকবেন তার কর্মে, তার আদর্শে, ত্যাগে।
লেখক : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।