ঢাকা ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অন্তহীন শোক ও বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ

র, আ, ম, উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী
অন্তহীন শোক ও বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ

আগস্ট, করুণ আগস্ট। দুঃখ-বেদনা আর অন্তহীন শোক নিয়ে শোকের মাস আগস্ট আবার আমাদের জীবনে হাজির হয়েছে। শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের নয়, বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বেদনার মাসের নাম আগস্ট। এই মাসের ১৫ তারিখে পৃথিবীর মানব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল বাংলার বুকে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছিল একদল ঘৃণ্য হায়েনা, যাদের মধ্যে রাজনীতিবিদ আর সেনাবাহিনীর এক দলছুট ঘাতকদলও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করেছিল। তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে ফিরিয়ে নিতে, মুক্তিযুদ্ধের সুফল ও আদর্শকে মুছে ফেলতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। কারণ তারা জানত যে, বঙ্গবন্ধুকে সশরীরে হত্যা না করতে পারলে রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের হাতে আসবে না এবং ভাবাদর্শগতভাবে তারা সফলকাম হবে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মতাদর্শগতভাবেই পাকিস্তানি রাষ্ট্রনৈতিক ও রাজনীতির বিরোধী ছিলেন। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়া চীন’ যারাই মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেছেন, তারা সবাই আমার সঙ্গে একমত পোষণ করবেন।

১৯৩৯ সালে গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার রাজনীতির সূচনা হয়। এরপর থেকে শাহাদতবরণ পর্যন্ত তিনি ৩৬ বছর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি কখনও রাজনীতির সক্রিয় মাঠ থেকে সরে দাঁড়াননি বা বিচ্ছিন্ন হননি। এ সময়ের অতিক্রমনেই তিনি ছাত্র রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। ছিলেন একজন এজিটেটর, ক্রমেই হয়ে ওঠেন নেতা। টুঙ্গিপাড়া আর গোপালগঞ্জের ছাত্র-যুবকর্মীদের ‘মিয়া ভাই’ হয়ে যান ‘মুজিব ভাই’। চুয়ান্নের নির্বাচনের পর (১৯৫৪) হয়ে যান ‘শেখ সাহেব’। এই মুজিব ভাই আর শেখ সাহেবই আমাদের বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা। পরিবার-পরিজন বা আত্মস্বার্থ নয়, মানুষের কল্যাণ তথা বাঙলার মানুষের কল্যাণই যার স্বপ্ন, সাধনা আর ধ্যান-জ্ঞান। তার ভাষায় ‘As a man, what concerns mankind concerns me. As a Bengalee, I am deeply involved in all that concerns Bengalees. This abiding involvement is born of and nourished by love, enduring love, which gives meaning to my politics and to my very being. Sheikh Mujibur Rahman 30.05.73

তার এ জীবনদর্শন তিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে প্রমাণ করে গেছেন। ছাত্র রাজনীতির হাতেখড়ি মুসলিম লীগ দিয়ে হলেও সাম্প্রদায়িকতা কখনও তাকে স্পর্শ করেনি।

অথচ পাকিস্তানের ভিত্তিই ছিল সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি। সে কারণেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর অতিক্রম করার আগেই তার মোহভঙ্গ হয়েছিল। নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রতি অবিচল আস্থাবান থাকলেও শিষ্য শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মোহমুক্ত। তাই তো ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ৬ দফা দাবিনামা নিয়ে বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূচনা করতে পেরেছিলেন।

অসাম্প্রদায়িক চিন্তা, গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থা, বাঙালির সার্বভৌম ক্ষমতায় বিশ্বাসী শেখ মুজিব রাজনীতি থেকে, রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে ধর্মকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মূলনীতি হিসেবে (বাঙালি) জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র (শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ) ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে স্থান দিয়েছিলেন। এ মূলনীতি চতুষ্টয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরও ভিত্তি। বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য।

পনের আগস্টের ঘটনাবলির শুধু একটা ঘৃণ্য দিকই উন্মোচিত হয়েছে। দলছুট সামরিক কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করে শায়েস্তা করা সম্ভব হয়েছে। ঘাতকদের কেউ কেউ এখনও পর্যন্ত শাস্তি ভোগ না করলেও আদালতে তাদের শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিবিদের চক্রান্তকে আজ অব্দি পুরোদস্তুর পাদপ্রদীপের আলোতে আনা সম্ভব হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগও তা করেনি। গতানুগতিকতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। চক্রান্তকারীদের দোসররা এখন বঙ্গবন্ধুর নাম জপতে জপতে হয়রান হয়ে পড়ছে।

পঁচাত্তরের (১৯৭৫) পনের আগস্টে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তার আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় দাঁড় করাতে অপপ্রয়াস পায়। দুর্ভাগ্যবশত সাংগঠনিক ও অন্যান্য জাতীয় ও আন্তজার্তিক রাজনীতির কূটকৌশলের কারণে আওয়ামী লীগ এবং সদ্য গঠিত বাকশাল কোনোটাই বঙ্গবন্ধু হত্যার (তার পরিবার-পরিজন ও রাজনৈতিক সহকর্মী যারা শাহাদতবরণ করেছিলেন) বিরুদ্ধে কোনোরূপ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। কিছু ছাত্র-যুবকর্র্মী (যারা ছিলেন নেতৃত্বের তৃতীয়-চতুর্থ স্তরে) ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতিবাদের যে ক্ষুদ্র প্রয়াস পায়, তাতেও প্রথম ও দ্বিতীয় সারির আওয়ামী নেতৃত্বের কাছে থেকে কোনো সাড়া ও সমর্থন পায়নি। আমরা মুষ্টিমেয় কয়েকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সারা দেশে ভ্রমণ করেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাঙ্গনের অন্যান্য স্থানে মিছিল সংগঠিত করার প্রয়াস পেয়েছি (যদিও আমাদের অনেকেই সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও মিছিলে যাননি) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে যাত্রা করে ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ পর্যন্ত রাজপথের মিছিল সংগঠিত করেছি।

আমাদের কতিপয় বন্ধু কাদের সিদ্দিকীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধও গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এ সময়ে আমরা যারা সক্রিয় ছিলাম, দেশের অভ্যন্তরে তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভারতে আশ্রয় নেই। (ভারতে আমাদের আশ্রয় সময়ের ঘটনাবলি নিয়ে পৃথক একটি রচনা তৈরি করার ইচ্ছা আছে)। এ সময়টাতে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা সপরিবারে ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন। তিনি নির্বাসনে থেকেও দেশের অভ্যন্তরে কী ঘটছে তা জানার চেষ্টা করেছেন। সেনাশাসক জিয়া ঘরোয়া রাজনীতির অনুমোদন দিলে আওয়ামী লীগের বড় বড় সাহেবরা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং মূলধারার আন্দোলনকারীদের (পঁচাত্তর-পরবর্তী আন্দোলনকারীদের) বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে নানা তৎপরতায় লিপ্ত হন। ঘরোয়া রাজনীতির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ধানমন্ডিতে রংপুরের মতিউর রহমান সাহেবের বাড়িতে। শোক প্রস্তাবে শেখ কামালের নাম নেই। কথা বলতে হলো আমাকে। তার নাম শোক প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দলকে ‘বাকশাল’ নয় আওয়ামী লীগ হিসেবে পুনর্গঠনের প্রস্তাবও আমার এবং তা গ্রহণ করা হয়।

তৎপরতা শুরু হলো সেনাশাসক জিয়ার ইচ্ছা অনুযায়ী আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র তৈরির অপপ্রয়াস। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শামসুদ্দিন মোল্লা ও মোল্লা জালালউদ্দিনের নেতৃত্বে ছাত্র-যুব নেতাকর্র্মীদের প্রবল বাধার মুখে মিজান চৌধুরী, মালেক উকিল গংয়ের অপতৎপরতা ব্যর্থ হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ভিত্তিতে দেশ পুনর্গঠনের প্রত্যয় ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র সরকারের বরাবর জমা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, সরকারের অনুমোদন উপেক্ষা করেই সাংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা মাঠে থাকার প্রত্যয় দৃঢ়সংকল্প নিয়ে কর্মতৎপর হয়ে উঠি। পরবর্তী ও আজকের আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেরই সেদিন কোনো খোঁজ ছিল না। পাকিস্তানি ভাবধারাপুষ্ট মোশতাকপন্থিরা পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ যেমন দখল করে নিয়েছিল অনেকাংশেই (যা ১৫ আগস্ট-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহই প্রমাণ করে), অনুরূপ পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতিও অনেকের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে লালিতপালিত হয়ে ক্রমে মহিরুহের রূপ ধারণ করছে।

ফলাফল রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও দুষ্টচক্রের দাপট।

এ দাপটের কারণে সর্বত্র আজ অন্ধকারের কালো ছায়া। ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে সীমিত আকারের প্রতিরোধ আন্দোলন-সংগ্রামে যারা সেদিন ঘরে বসে বসে কাজ করেছে, তারা আজও ঘরে বসে বসেই রাজা-উজির মারছে। কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। রাজনীতি এখন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে নেই। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র আর ধনিক-বণিকদের হাতে চলে গেছে রাজনীতি। রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে গেছে। পাকিস্তানি ধারায়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছে ক্রমান্বয়ে।

যে কারণে আজ থেকে প্রায় অর্ধশতক আগে বঙ্গবন্ধুর শাহাদৎ হয়েছিল, সব লক্ষণই আজকের বাংলাদেশে দৃশ্যমান। নেত্রীর শ্রম, নিষ্ঠা, একাগ্রতার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না যারা, তারাই দলের কাণ্ডারি।

রাষ্ট্র আর সরকার পরিচালনায় অরাজনীতির প্রাধান্য। সমৃদ্ধি হয়তো আসছে; কিন্তু সে সমৃদ্ধির স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় আছে। রাজনীতি আর অর্থনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তায়ন সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তবে সময় হয়তো এখনও চলে যায়নি। লাগাম টেনে ধারার সময় এখনও আছে। কিন্তু কাজটা একাই করতে হবে তাকে, নেত্রী শেখ হাসিনাকে। কেননা, তার চারপাশে অর্থগৃধœু মৌলোভী লোকেদের ভিড়ে যোগ্য ও সফল রাজনীতিকের বড়ই অভাব (অবশ্য পদ প্রাপ্তি যদি যোগ্যতার মাপকাঠি হয়, তবে ভিন্ন কথা)। এরা শুধু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদেরই পৃষ্ঠপোষক এবং রাজনীতির বাণিজ্যিক কারবারিদের সহায়ক।

তাই, আমরা মনে করি- দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, যাতে করে রাজনীতির মাঠটা আদর্শিক রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত হয় এবং রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় রাজনীতির সুস্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কেননা, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা রাজনীতির বিষয়। ব্যবসায়িক বিষয় নয়। সংসদ, মন্ত্রিসভা, প্রশাসনের যেখানে রাজনীতিকীকরণের সুযোগ আছে, সেসব জায়গায় রাজনীতির প্রাধান্য সুনিশ্চিত করতে হবে। দলকে সুসংগঠিত করার যোগ্যতা রাখে, এমনদের দিয়ে দলকে ঢেলে সাজানো দরকার। আদর্শহীন কাণ্ডজ্ঞানহীন দরবারিদের হাত থেকে রাজনীতিকে উদ্ধার করা দরকার। লুটেরা ও তঞ্চক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের হাত থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধার করা দরকার। যার যা কাজ, তাকে সে কাজ করতে দেওয়া উচিত এবং এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত তাকেই, শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে। আমরা বাংলাদেশের পতাকা আর জাতীয় সংগীতের আড়ালে পাকিস্তানি ভাবধারার পুনর্বাসন চাই না। বৈষম্যহীন অর্থনীতি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, গণতান্ত্রিক আর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ার সংগ্রামই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ। এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাব, ১৫ আগস্টের শহীদদের রক্তের শপথ এটাই।

লেখক : যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, সংসদ সদস্য ও পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রতিরোধ যোদ্ধা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত