ঢাকা ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্বর্গ পেল নতুন তারা, ফুটবল হারাল সম্রাট

স্বর্গ পেল নতুন তারা, ফুটবল হারাল সম্রাট

ডেভিড গোল্ডব্লাট বলেছেন ‘দ্য বল ইজ রাউন্ড : এ গ্লোবাল হিস্ট্রি অব ফুটবল অ্যান্ড দ্য গেম অব আওয়ার লাইভস’-এর লেখক ডেভিড গোল্ডব্লাট। তিনি লিখেছিলেন, ‘পেলে এমন একজন, যার দ্বারা ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করা হয়।’ মানে পেলে নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন- যেখানে তিনি অতুলনীয়, অনুপম, অদ্বিতীয়। পরে যারা এসেছেন, সামনেও আসবেন তারা কেবলই সমতুল?্য! তিনি কেবল ব্রাজিলের একজন দেবতা ছিলেন না, প্রথম সত্যিকারের বিশ্ব ফুটবল তারকা ছিলেন। এই অসাধারণ খেলার ওপর যারা দেবত্ব আরোপ করেছেন তাদের রূপকারও তিনি। এ নিয়ে ইয়োহান ক্রুয়েফের কথাটা নিশ্চয়ই কানে বাজছে, ‘পেলে একমাত্র খেলোয়াড় যে যুক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেছে।’

১৯৬২ বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ চিলিতে যাচ্ছিল বিমানটি। হাজার ফুট ওপরে আন্দেজ পর্বতমালার ওপর বিমান উড়ছে। পেটে ব্রাজিল ফুটবল দল। এয়ার পকেট টার্বুল্যান্সের প্যাঁচে পড়ে বিমানে শুরু হলো দুলুনি। সবাই ওপরওয়ালার নাম নিতে শুরু করল, শুধু একজন নির্বিকার! নিজ আসনে চুপচাপ। ওপরওয়ালার ওপর তাঁর বিশ্বাসের ধরনটা ঠিক বাকিদের মতো নয়। বিশ্বাসের সংযোগ তো মনে মনে, হুটোপুটি করে কী আর বিশ্বাসের নাগাল মেলে! বাঁচা-মরা যেহেতু সেই হাতে, তাই চুপচাপ বসে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। তিনি মারতে চাইলে তো আর কোনো কিছুতে ঠেকবে না। সতীর্থরা যারপরনাই অবাক। পেলে পাগল নাকি!

১৯৫৮ বিশ্বকাপ জিতে পেলে তত দিনে তারকা। কিন্তু নিজের শেকড় ভুলে যাননি। উঠে আসার পথ মনে থাকত। ছোটবেলায় গির্জায় ফাই-ফরমাশ খেটেছেন। বড় হয়ে ওঠা ক্যাথলিক বিশ্বাসে। ‘মারাকানাজ্জো’ বিপর্যয়ে পেলের ভেতরটা চুরমার হয়ে গিয়েছিল। দৌড়ে ছুটে গিয়েছিলেন বাবার রুমে। নোনা দেয়ালে লটকে থাকা ত্রাণকর্তা যিশুই তাঁর ভরসা। যখন কোথাও উত্তর মেলে না, কিছুই করার থাকে না, তখন ৯ বছরের ছেলেটির যিশুর কাছে যাওয়া ছাড়া পথ ছিল না। প্রশ্নটা ছিল, ‘কেন, আমাদের সঙ্গে এমন হলো?’

মরণব্যাধী ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে বৃহস্পতিবার রাতে সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফুটবল ইতিহাসের রেকর্ড গোলদাতা। একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ীর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। ফুটবলের মহারাজার বিদায়ে কাঁদছে ফুটবল, অশ্রু ঝরছে ফুটবল বিশ্বের। অন্য সবার মতো শোকাহত পোল্যান্ডের তারকা রবার্ট লেভানডভস্কি যেন ‘দা গ্রেটেস্টের’ মৃত্যুকে সত্যিকারের বিয়োগ হিসেবে দেখতে চাইছেন না, ‘দুনিয়া ছেড়ে পেলে এখন ওপারের তারা। লেভানদোভস্কির চোখে পেলে মানেই চ্যাম্পিয়ন, তার বার্তায়ও মিশে রইল, ‘শান্তিতে ঘুমান চ্যাম্পিয়ন। স্বর্গ আজ পেল এক নতুন তারকা, আর ফুটবল বিশ্ব হারাল একজন মহানায়ক।’ ব্রাজিলের ২০০২ বিশ্বকাপজয়ী রিভালদোর মতে, পেলের কারণেই ব্রাজিলের ফুটবল আজকের এই অবস্থানে, ‘পেলে ব্রাজিলিয়ান হওয়ায় ইশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি ফুটবল মাঠে যা কিছু করেছেন, তার জন্যই সারা বিশ্বে আমাদের ফুটবল পরিচিত এবং সম্মানিত, এটা কখনও মুছে যাবে না। আমি গর্বিত যে ১০ নম্বর জার্সি পরে দুটি বিশ্বকাপ খেলতে পেরেছি, যে জার্সি তার কারণে মহান হয়ে উঠেছিল।’

ক্যারিয়ারের শেষভাগে দুই বছর নিউইয়র্ক কসমসে খেলেছিলেন পেলে। দেশটির ফুটবলের উন্নয়নে রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেখানকার আরেক ক্লাব নিউইয়র্ক সিটি ফুটবল ক্লাব কিংবদন্তির প্রয়াণে জানিয়েছে শ্রদ্ধা, ‘আপনাকে ধন্যবাদ, পেলে। এখানে এবং সবখানে, এই খেলাটির জন্য আপনার চেয়ে বেশি কেউ করেনি। তার পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি সমবেদনা।’

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মতে, শুধু ফুটবলার নন, বিশ্বের সবচেয়ে নামী অ্যাথলেটদের একজন হলেন পেলে, ‘এই সুন্দর খেলাটির সবসময়ের সেরা পেলে, বিশ্বের সবচেয়ে স্বীকৃত অ্যাথলেটদের একজন পেলে। খেলাধুলার মাধ্যমে যে মানুষকে এক কাতারে আনা যায়, বুঝতেন। তার পরিবারের প্রতি, এবং তাকে যারা ভালোবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন তাদের সবার প্রতি সহমর্মিতা।

রোমাঞ্চকর চর্মগোলক নিয়ে দুপায়ের নিরুপম ছোঁয়ায় বিশ্বকে বুঁদ করে রাখার যে ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব, মাঠের এপার-ওপার অপার্থিব সৃষ্টিশীলতা, প্রতিপক্ষের দুর্গ ভেঙে গোলমুখে তার ক্ষিপ্র দৌড় পৃথিবীতে আঁকা সুন্দরতম ছবিগুলোর প্রতিচ্ছবি। যে ছবি আবেগে ভাসায়, ভালোবাসার জন্ম দেয়। মুগ্ধ করে প্রতিটি ক্ষণ, মুহূর্ত। শিল্পীর তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে আঁকা সেই চরিত্রটিই শেষ যাত্রায় পা বাড়ালেন। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। যেখানে তার অপেক্ষায় গারিঞ্চা, সক্রেটিস। কিংবা প্রতিদ্বন্দী দেশের দিয়েগো ম্যারাডোনা।

পেলের পর তার খুব নিকটে যেতে পেরেছিলেন শুধু আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ম্যারাডোনা। এখন সেই জায়গায় নিশ্চিতভাবে এই শতাব্দির লিওনেল মেসিও ঢুকে গেছেন। তাদের তিনজনকে এক আসনে বসালেও কোনও আপত্তি থাকবে না! যদিও নানা মুনির নানা মত তো থাকবেই! ম্যারাডোনা পরপারে পা বাড়িয়েছেন ২০২০ সালে। পেলে এ বছর।

জীবদ্দশায় ম্যারাডোনোর চিরকালীন আক্ষেপ ছিল, পেলের থেকে একটি পাস না পাওয়ার! এক টিভি শোতে আক্ষেপের কথা জানিয়ে ম্যারাডোনা পেলের হাতে বল তুলে দিয়েছিলেন। ভাগ্যবান সেই বল নিয়ে দুজনের হেডে হেডে ঠোকাঠুকির চিত্র হার মানায় মোনালিসার চিত্রকর্মকেও! দুজনের মুষ্টিবদ্ধ চার হাত এক হয়ে একে অন্যের আলিঙ্গনের দৃশ্যটি জানান দেয়, ‘ফুটবল শুধু কোনো খেলা নয়, এটা জীবন’, যা বলেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।

১৯৮২-তে থেমেছেন পেলে। ক্যানসার আর শরীরে নানাবিধ রোগ বাসা বাঁধায় শেষ লড়াইয়ে আর জিততে পারেননি। ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর পেলে বলেছিলেন, ‘আশা করি স্বর্গে একদিন একসঙ্গে ফুটবল খেলতে পারবো।’ দুজনের পথ মিলে গেল দুই বছর একমাস তিন দিন পর। এবার নিশ্চয়ই পেলের পাসটা পাবেন ম্যারাডোনা। ড্রিবলিং করে বাঁপায়ে গোলটাও দেবেন ষাটে পৃথিবী ছাড়া ম্যারাডোনা। তাদের আনন্দাশ্রুতে পৃথিবী ভিজে গেলে নিশ্চয়ই ফুটবল জিতে যাবে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর ফুটবল মানে পেলে আর ম্যারাডোনা। তাদের আগে-পারে অনেকেই বিশ্বকে তাক লাগিয়েছেন, ভক্তদের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। কিন্তু লাতিন আমেরিকার এই দুই মহা নায়ক নিজেদের আলাদা করেছেন অনন্য গুনে, মহিমায়, শ্রেষ্ঠত্বে, বৈভব আর আভিজাত্যে গোলাকার সেই বল ছিল তাদের পোষ মানা সৈনিক। যা চাইতেন, যেভাবে চাইতেন সেভাবেই যেন কথা শুনতো। প্রতিপক্ষকে দুমড়েমুচড়ে দিতো। তাতে ইতিহাসের অক্ষয় কালিয়ে বারবার লেখা হয়ে যেত পেলে-ম্যারাডোনার নাম।

হাজারেরও বেশি গোল, শোকেস ভর্তি শিরোপা, দিস্তার পর দিস্তায় তার স্তুতি; সব আজ থমকে গেলো ব্রাজিলে। তবে পেলে রেখে গেছেন তার অর্জন, দিয়ে গেছেন জীবন দর্শন। মানুষের হৃদয়ে চিরকালীন যেন থাকতে পারেন সেজন্য ১৯৯৯ সালে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সব বাচ্চারা যারা ফুটবলার হতে চায়, তারা পেলের মতো হতে চায়। তাদের কেবল ফুটবলার হওয়াই নয়, বরং কীভাবে একজন মানুষ হতে হয় সেটা দেখানোও আমার ওপর বড় দায়িত্ব।’ আর ১৯৭৭ সালে ফুটবল ও জীবনকে মিলিয়েছিলেন এভাবে, ‘পৃথিবীর উপরে হওয়া সবকিছুই একটি খেলা। পাসের মতো ব্যাপার। আমরা সবাই একসময় মারা যাবো। সবার অবস্থাই একইরকম হবে, তাই না?’

মৃত্যু অমোঘ জেনেও নায়করা এমন কীর্তি রেখে যান যা চিরকাল অমর থাকে। মহাকাল অবধি পৃথিবীও মনে রাখে। নশ্বর পৃথিবীতে অবিনশ্বর তাদের কীর্তি, শ্রেষ্ঠত্ব। ষোল আউন্সের বলে নিজেকে চিনিয়ে যাওয়া পেলে তাদেরই একজন। ৮২ বছর বয়সেও পেলের মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়াকে মনে হচ্ছিল, এই প্রস্থানের লগ্ন বড্ড অসময়। পৃথিবীর সব ভালোবাসা যে এখনো তাঁর পাওয়া হয়নি। এখনো যে ব্রাজিলের ‘হেক্সা’ জয় বাকি, যা কাতারে দেখার আশা করেছিলেন। কিন্তু সবার সব আশা পূরণ হয় না। এটাই বাস্তবতা। তবু পেলের মৃত্যু ঘিরে যে আবেগের স্ফুরণ, এটাই জাদু, বাস্তবতা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত