আধুনিক ফুটবলে সারা বিশ্বের ফুটবলারদের কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা ইউরোপের প্রতিষ্ঠিত কোনো ক্লাব। সেখানকার তুমূল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ফুটবল এবং কাড়িকাড়ি অর্থের হাতছানিই মূল কারণ। ইউরোপের ক্লাবগুলোও খোঁজে থাকে বিশ্বের আনাচে কানাচে থেকে প্রতিভা দলে ভেড়াতে। তবে পেলের সময়ে ঠিক এমনটা ছিল না। তারপরও তাকে পেতে উঠেপড়ে লেগেছিল জুভেন্টাস, ইন্টার মিলান, রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো ক্লাবগুলো। কিন্তু কখনো ইউরোপে খেলা হয়নি পেলের। কারণ, তিনি যে ছিলেন ব্রাজিলের ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ’, সেটাই রুখে দিয়েছিল তার ইউরোপে পাড়ি দেয়ার সম্ভাবনাকে।
বিশ্ব ফুটবলে তারকা পেলের আবির্ভাব অল্প বয়সেই। জাতীয় দলের জার্সিতে অভিষেকেই করেছিলেন গোল, বয়স যখন মাত্র ১৬ বছর ৯ মাস। বছর খানেক পর বিশ্বকাপের মহারণে তার আগমণ এবং কী অবিশ্বাস্যভাবেই না রাঙিয়েছিলেন সেই উপলক্ষ্য। সুইডেনের সেই আসরে গ্রুপ পর্বে কেবল একটি ম্যাচ খেলেছিলেন, সেই সময়ের ১৭ বছর ৮ মাস বয়সি পেলে। নকআউট পর্বের শুরু থেকেই মূলত তার শ্রেষ্ঠত্বের পথে যাত্রার শুরু। কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসের রক্ষণ ভেঙে দলকে এনে দেন ১-০ গোলের জয়। সেমিফাইনালে তার হ্যাটট্রিকের ওপর ভর করে ফ্রান্সকে ৫-২ গোলে উড়িয়ে দেয় ব্রাজিল। আর ফাইনালে সুইডেনকেও একই ব্যবধানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্ব সেরার আসনে বসে সেলেসাওরা, পেলে করেন জোড়া গোল। ৪ ম্যাচে ৬ গোল, এমনই দাপুটে ছিল বিশ্বসেরার মঞ্চে পেলের আগমন।
প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে তখনও ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকার উপরের সারির ক্লাবগুলোর সেভাবে মুখোমুখি লড়াই দেখা যেত না। তাই মাঝেমধ্যে যা হতো, তার সবই প্রীতি ম্যাচ, কিন্তু সেখানেও থাকতো দারুণ লড়াকু মনোভাব। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে শুরু, প্রতি বছর ইউরোপ ও বিশ্বের নানা দেশে সফরে যেত সান্তোস। কারণ বিদেশি ক্লাবগুলো তাদের বড় অঙ্কের অর্থ দিত। সেই সফরগুলো ছিল ভীষণ কষ্টের, ঠাসা সূচির। কখনো কখনো তো তিন দিনে দুটি ম্যাচ খেলতে হতো পেলেদের এবং বিশ্রাম বা অনুশীলনেরও সুযোগ থাকত না। ছিল না ঠিকমতো খাওয়া বা বিশ্রামের সুযোগও। প্রায় সময়ই তাদের ঘুমাতে হতো রাতের ট্রেন যাত্রায়, আর ফল ও চকলেট খেয়ে পার করতে হতো দিন। তবে এসব কোনো বাধাই তাদের রুখতে পারেনি। মাঠে নামলেই গোল উৎসবে মেতে উঠতেন পেলে ও তার সতীর্থরা, লিসবন থেকে লিওঁ, বার্মিংহ্যাম থেকে বুয়েন্স এইরেস, সবখানে।
ফুটবল বিশ্বের এমন কোনো রক্ষণদুর্গ ছিল না, যেটা গুঁড়িয়ে দেননি পেলে। তিনি গোল করেছিলেন এসি মিলান, ইউভেন্তুস, নাপোলি; রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা এবং আতলেতিকো মাদ্রিদ; আন্ডারলেখট, ফেইনুর্ড ও রেড স্টার বেলগ্রেডের বিপক্ষে। ইন্টার মিলানের বিপক্ষে সাত ম্যাচে ৮ গোল, রোমার বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচে ৬ গোল এবং বেনফিকার বিপক্ষে সাত ম্যাচে ১০ গোল করেছিলেন পেলে। তাকে পেতে মরিয়া চেষ্টা করেছিল ইন্টার মিলান, ইউভেন্তুস, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও রিয়াল। তবে ১৯৬১ সালে এদসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো, পৃথিবী যাকে চেনে পেলে নামে, তাকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ঘোষণা করেন ওই সময়ের ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট জানু কুয়াদরুস। শেষ পর্যন্ত সেটাই রুখে দেয় পেলের ইউরোপিয়ান ফুটবলে পা রাখার পথ। ক্যারিয়ারের শেষলগ্নে অবশ্য বিদেশের মাটিতে খেলেছিলেন পেলে, নিউইয়র্ক কসমসে। ওখানেই ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত খেলে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি টানেন ফুটবলের রাজা।